গত সপ্তাহে অগ্রজ একজন অ্যাডভোকেট ফোন করলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্তরের দশকের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও সেদিন ক্যাম্পাসেই ছিলাম। সহকর্মীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ বেশ জমে উঠেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি ফোনটা করলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া মেয়ের ক্লাস শুরুর খোঁজখবর নিতে। স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যাপারেও প্রশ্ন করলেন।

অল্প সময়ের মধ্যে আলোচনা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা বা ক্লাস শুরুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের আবেগ, উৎকণ্ঠা, ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহানের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি। তার কথাগুলো শুনে চুপ করে থাকা ছাড়া তেমন কোনো উপায় ছিল না। সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল-মন্দ বিষয়গুলো আমাকে আবেগাপ্লুত করে, তাড়িত করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটা অর্জন যেমন আমাকে গর্বিত করে, ঠিক তেমনিভাবে এর বিফলতায় আমি বিষণ্ন বোধ করি, ব্যথিত হই।

বেশ কিছুদিন ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটছে তাতে ব্যথিত না হয়ে উপায়ই বা কী? বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে শিরোনাম হতে দেখছি। সবশেষে যুক্ত হয়েছে ৫ মে ২০২১ তারিখে ১৩৮ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর অ্যাডহক নিয়োগের বিষয়টি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহান দ্বিতীয়বার উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পরে যেন বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। জড়িয়ে পড়লেন বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে।

ব্যক্তিগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিয়োগের বিরোধী আমি নই। যেকোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সাম্প্রতিক এই নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে। আর এই প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলতে গেলে অবশ্যই একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহান ২০১৭ সালের ৭ মে, মাঝে প্রথম মেয়াদের বিরতির পর দ্বিতীয়বারের মতো উপাচার্য হয়েছিলেন। প্রথম মেয়াদে তিনি ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত চার বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার উপর আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পরে তিনি যেন বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। জড়িয়ে পড়লেন বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে। শুরুতেই ২০১৫ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করলেন এবং এই শিথিলতার সুযোগ নিয়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তার মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করলেন। তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত এসব অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি গঠন করে।

ইউজিসির তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। মন্ত্রণালয় গত ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ নানাজনের বিরুদ্ধে ১২টি পৃথক নোটিশ জারি করে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয় এবং কিছু বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করে। এসব নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে জানানোর বিষয়টিও নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে আমরা যেটুকু দেখেছি সদ্য সাবেক উপাচার্য এসব নির্দেশনার অধিকাংশই আমলেই নেননি।

এমনকি ওই সময় তিনি ইউজিসির এসব অভিযোগ তদন্ত করার এখতিয়ার নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। এসব নির্দেশনার মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু তার কার্যকালের শেষ দিনে এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রীতি-প্রথা-প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর ১২(৫) ধারায় প্রদত্ত উপাচার্যের ক্ষমতাবলে তিনি শেষ পর্যন্ত ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়ে গেলেন।

বাংলাদেশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম) চলে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ (যা পরে আইনে পরিণত হয়েছিল) অনুযায়ী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কোনো আইন দ্বারা নয়, বরং তাদের নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। সে কারণেই তিনি এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে তখনকার চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই স্বায়ত্তশাসন দিয়ে গিয়েছিলেন, যার মর্মার্থ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পঠন-পাঠনসহ নতুন নতুন জ্ঞান সৃজন ও জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলবে। এই আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে যেমন অসীম ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি ক্ষমতা চর্চার সীমাও নির্ধারণ করেছে। এই আইনের ১২(২) এবং ১২(১০) উপ-ধারায় উপাচার্যদের অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ইদানীং অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। ইউজিসি অন্তত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে। কোনো কোনো অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনও পেশ করেছে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত উপাচার্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা তাদের পদ থেকে অপসারণের মতো কোনো সিদ্ধান্ত চোখে পড়ছে না। যেমনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ক্ষেত্রেও ঘটেনি।

যিনি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে সঠিকভাবে চালাতেও পারছেন না, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগের একটি কারখানা এবং দুর্নীতির আস্তাকুঁড়।

সম্প্রতি সাবেক এই উপাচার্যসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একটা কথা মনে রাখা দরকার, দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পর বিচার না হওয়া কিন্তু পরবর্তীতে আরও দুর্নীতিকে উসকে দেয়। এর পরম্পরাও কিন্তু আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাচ্ছি, যা কখনোই জাতির কিংবা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। একজন উপাচার্যও তো শিক্ষক। তিনি তো জাতি গঠনের কারিগর। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘তিনজনই পারেন একটি দেশ বা জাতিকে বদলাতে। তারা হলেন বাবা, মা ও শিক্ষক।’

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন লালিত ১৯৭৩ সালের আইনে অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের একটি প্রক্রিয়ার কথা বর্ণিত রয়েছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া ভিন্ন হলেও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটে ভোটাভুটির মাধ্যমে উপাচার্য হিসেবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করার কথা বলা হয়েছে এই আইনে। এই তিনজনের মধ্যে থেকে আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেবেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারই উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে আসছে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতি গঠনের কারিগর এবং এসডিজি-এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা অবশ্যই একটি নিয়ামক শক্তি, সেহেতু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত, যুগোপযোগী তথা বিশ্বমানের করতে না পারলে এসজিডি-এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন। এ কারণে এমন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া উচিত যিনি জাতি ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষমুক্ত করতে পারেন।

বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, নির্লোভ শিক্ষকদের খুঁজে বের করে উপাচার্য হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তার সময় তিনি প্রফেসর এ আর মল্লিক, খান সারওয়ার মুরশিদের মতো বরেণ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এ কথাও শোনা যায় যে, অনেক বরেণ্য অধ্যাপক নাকি সে সময় উপাচার্য পদ গ্রহণে বিনয়ের সাথে অসম্মতি জানিয়েছিলেন।

কিন্তু বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, কোনো রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক তদবির ছাড়া নাকি উপাচার্য হওয়া যাচ্ছে না। উপাচার্য হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহলকে খুশি করতে হচ্ছে বলে আমরা প্রায়শই শুনতে পাই। এ কারণে অনেক সময়ই শিক্ষানুরাগী, শিক্ষার্থীবান্ধব, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তথা সৎ ও দক্ষ শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে বাছাইয়ের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। আবার যিনি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে সঠিকভাবে চালাতেও পারছেন না, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগের একটি কারখানা এবং দুর্নীতির আস্তাকুঁড়।

আমরা এরূপ বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চাই না। আমরা চাই এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় যা শিক্ষা ও গবেষণায় জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবে। এ জন্য দরকার দক্ষ, ন্যায়নিষ্ঠ, বিবেকবান, সৃষ্টিশীল, গণতন্ত্রমনস্ক, আধুনিকমনা একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক। আমরা এমন উপাচার্য চাই যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হারিয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে পারবেন, এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন জনগণের স্বপ্নের বাতিঘর বিশ্ববিদ্যালয়কে। আর উপাচার্য হিসেবে এ ধরনের শিক্ষককে বেছে নেওয়ার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়