গত কয়েক মাস যাবৎ কিশোর গ্যাং-এর ভয়াবহতার যে চিত্র মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। কৈশোরে পদার্পণ করা যুবক-যুবতিরা যেভাবে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম, খুন, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছে সেটি সত্যিই চিন্তার বিষয়। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন কিশোর গ্যাং-এর ভয়াবহতায় বেশকিছু প্রাণ অকালে ঝরে গেছে।

দিন দিন এই সকল গ্যাং-এর নৃশংসতা এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। অপরাধবিজ্ঞানী এবং মনোচিকিৎসকদের মতে, বিভিন্ন কারণে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে এবং তারা ভয়াবহ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

গত এক বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে কিশোর-কিশোরীরা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘An idle brain is a devil's workshop’। অফুরন্ত অবসর তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করছে।

সর্বস্তরে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠাকে প্রভাবিত করছে। আমরা সকলেই জানি পরিবার হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ চর্চার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পরিবার থেকে একটি শিশু ভালো বা মন্দের পার্থক্য বুঝতে শিখে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারাও কিশোর গ্যাং বিস্তারের জন্য দায়ী। গত দুই দশকে আমরা যদি তৃণমূল পর্যায় থেকে শহর অঞ্চলের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করি তাহলে দেখব যে, রাজনীতিবিদরা এই কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা শুরু করেছেন।

আমাদের দেশের অনেক পরিবার রয়েছে যাদের শিশুদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাছাড়া শিশুরা ছোটবেলা থেকে যদি পিতা-মাতাকে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত থাকতে দেখে, তবে সেই সকল শিশু কখনোই প্রকৃতপক্ষে সুস্থ ভাবে বড় হয়ে উঠতে পারবে না। ফলে, এই শিশুরা বিভিন্ন গ্যাং-এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে কৈশোর থেকেই।

অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে শিশুরা অল্প বয়স থেকেই বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস এবং মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই ধরনের আসক্তির জন্য পিতা-মাতা অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী। নিজেদের ব্যস্ততার কারণে পিতা-মাতা শিশুকে ডিভাইস দিয়ে বসিয়ে রাখে। সময়ের পরিক্রমায় শিশুরা এগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ে।

আসক্তির এক পর্যায়ে তারা বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নেশা এবং টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের গেমস খেলা। কিশোর গ্যাং এর সর্বশেষ কয়েকটি ঘটনা যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যাবে যে সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। অথবা জুয়ার টাকা জোগান দিতে না পারায় অথবা ফেরত দিতে না পারায় খুনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে, অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে শিশুদের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

একদিকে যেমন শিশুদের জন্য অবাধ তথ্যপ্রবাহ সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, তেমনি পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন এবং অবাধ-তথ্যপ্রবাহের প্রবেশাধিকার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

কিশোর গ্যাং শুধুমাত্র একটি জেনারেশনকেই ধ্বংস করে দেবে না বরং দেশের সার্বিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে আজকে যে কিশোর, সে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি সরকারের তরফ থেকে কয়েকটি গেমস নিষিদ্ধ করার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তবুও দেরিতে হলেও এই সমস্ত আসক্তিকর গেমসগুলোকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা গেলে কিছুটা হলেও কিশোর গ্যাং-এর বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং-এর বিকাশ ও বিস্তৃতিকে প্রভাবিত করছে টিকটকসহ বিভিন্ন ধরনের মোবাইল অ্যাপস। এগুলোকে এখনই বন্ধ করে দেওয়া উচিত কারণ অল্প বয়সের তরুণ-তরুণীরা নিজেদেরকে জনপ্রিয় করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল এবং কুরুচিপূর্ণ ভিডিও ধারণ করে সেগুলোকে অনলাইনে ছেড়ে দিচ্ছে। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপের দ্বন্দ্ব। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে বিভিন্ন গ্যাং-এর সদস্যরা। এরই ধারাবাহিকতায় কখনো কখনো নিজেদের গ্যাং-এর মধ্যে আবার কখনো কখনো অন্য গ্যাং-এর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে এবং খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারাও কিশোর গ্যাং বিস্তারের জন্য দায়ী। গত দুই দশকে আমরা যদি তৃণমূল পর্যায় থেকে শহর অঞ্চলের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করি তাহলে দেখব যে, রাজনীতিবিদরা এই কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা শুরু করেছেন।

অল্প বয়স থেকেই কিশোর- কিশোরীরা ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে দেখে নিজেরাও বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া প্রত্যেক গ্যাং কোনো না কোনো রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় রয়েছে। যেকোনো অপকর্ম করে দায় মুক্তি পাওয়ার এক ধরনের সংস্কৃতির মধ্যে তারা বেড়ে উঠছে। সুতরাং, দেশের রাজনীতিবিদদের নিজেদের স্বার্থে এই কিশোর-কিশোরীদের ব্যবহার করার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

কিশোর গ্যাং শুধুমাত্র একটি জেনারেশনকেই ধ্বংস করে দেবে না বরং দেশের সার্বিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে আজকে যে কিশোর, সে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তারাই দেশকে নেতৃত্ব দেবে। দেশে এই কিশোর গ্যাং-এর ভয়াবহতাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুধু রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব না। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজকে একসাথে কাজ করতে হবে।

পরিবার থেকে শিশুদের শেখাতে হবে কোনটি ভালো এবং কোনটি মন্দ। একইসাথে সামাজিক মূল্যবোধ, যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, আরও সুসংহত করতে হবে। তাছাড়া, জনগণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামাজিক নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আর রাষ্ট্রের তরফ থেকে যে সমস্ত নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেগুলো কার্যকর করতে হবে। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা কিশোর-কিশোরীদের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি।

ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।। অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়