করোনা দ্রুত রূপ বদলায় কেন, জনস্বাস্থ্যে এর প্রভাব কী?
কোভিড-১৯ যে প্রকারের করোনাভাইরাস দিয়ে হয় তার অফিশিয়াল নাম সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2)। ভাইরাসটি চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম শনাক্ত হয় এবং খুব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটি প্রথমে ‘উহান করোনাভাইরাস’ এবং পরে ‘2019-nCoV’ নামে পরিচিতি পেলেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একে ‘সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2)’ হিসেবে এবং এ ভাইরাসঘটিত রোগের নাম ‘কোভিড-১৯’ হিসেবে নামকরণ করে।
তবে, সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটি সার্স-কোভ-২-এর বদলে ‘কোভিড-১৯ ভাইরাস’ এবং অনেক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আরও সহজ করে ‘করোনাভাইরাস’ অথবা আরও সহজ করে ‘করোনা’ নামটিই বেশি ব্যবহার করে। আর সাধারণ মানুষ ‘করোনা’ বলতে কোভিড-১৯ কেও বোঝায়।
বিজ্ঞাপন
অন্যান্য অনেক ভাইরাসের মতো এ ভাইরাসও রূপ বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উপধরন। আজকের এ লেখায় কোভিড-১৯ ভাইরাসের রূপ বদলের কারণ, নতুন উপধরনের বৈশিষ্ট্য ও এর প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করব।
কোভিড-১৯ ভাইরাসসহ সব করোনাভাইরাস একধরনের আরএনএ (RNA) ভাইরাস। এই অতিক্ষুদ্র ভাইরাসটির জিনোমের আকার খুব ক্ষুদ্র এবং জিনোমে মাত্র ৩০ হাজার নিউক্লিওটাইড থাকে যেগুলো সবমিলিয়ে ১০-১৪ টি জিনের তথ্য বহন করে। ব্যাকটেরিয়ার জিনোমের সাথে তুলনা করলে এর ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ, E. coli ব্যাকটেরিয়ায় নিউক্লিওটাইডের জোড়ার সংখ্যা প্রায় ৪৬ লাখ এবং এর মধ্যে প্রায় ৪,৪০০ জিন থাকে।
বিজ্ঞাপন
প্রশ্ন হলো, কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোমে কেন এত পরিবর্তন হয়? এর কারণ নিহিত রয়েছে এর জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের ওপর। কোভিড-১৯ ভাইরাসের কপি তৈরি করে RNA Polymerase নামে এক ধরনের এনজাইম। এ এনজাইমটির প্রুফ রিডিং ক্ষমতা দুর্বল অর্থাৎ, এটি RNA-এর কপি তৈরি করার সময় কোন ভুল করে থাকলে সেটি সংশোধন করতে তেমন সক্ষম নয়। যদিও এতে nsp14 exonuclease নামে আরেকটি প্রুফ রিডিং এনজাইম থাকে, কিন্তু সেটিরও কার্যক্ষমতা তেমন ভালো নয়।
অবশ্য, প্রুফ রিডিংয়ে ভুল থাকার কারণ হিসেবে ভাইরাসটির দ্রুত কপি তৈরি করার সক্ষমতাকেও দায়ী করা যেতে পারে। করোনাভাইরাস মানবদেহে বা অন্য কোনো উপযুক্ত জীবদেহে যেমন- বাঁদুরের দেহকোষে প্রবেশের পর প্রতিদিন লাখ লাখ কপি বা প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। RNA Polymerase যখন RNA-এর কপি তৈরি করে তখন এটি ভুল করে এক নিউক্লিওটাইডের পরিবর্তে আরেক নিউক্লিওটাইড বসিয়ে ফেলে যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘মিউটেশন’ (mutation) বলে। দ্রুত কাজ করলে মানুষের যেমন কাজে ভুল থাকার সম্ভাবনা থাকে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই হয়। তাই, করোনার নতুন বংশধর অনেক সময় প্যারেন্টের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে থাকে।
করোনার হাজার হাজার মিউটেশন পাওয়া গেছে কিন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবমিলিয়ে ১৫টি উপধরনকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। এ ভেরিয়েন্টগুলোর মধ্যে আছে—Alpha, Beta, Gamma, Delta, Omicron, BA.1, BA.2, BA.5, XBB.1.5, XBB.1.9.1, XBB.1.16, EG.5, JN.1 এবং NB.1.8.1(Nimbus) উপধরন।
তবে, করোনাভাইরাসের এরকম পরিবর্তিত প্রতিলিপি বা কপি পরে সফলভাবে টিকে থাকবে কিনা তা নির্ভর করে ভাইরাসের জিনোমে কী ধরনের মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়েছে তার ওপর। এখানেও প্রাকৃতিক নির্বাচন বা ন্যাচারাল সিলেকশনের থিওরি কাজ করে। যে মিউটেশনগুলো ভাইরাসকে কোনো সুবিধা দেয় যেমন- টিকে থাকতে বা ছড়াতে সাহায্য করে, সেগুলো বিস্তার করে, আর বাকিগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
মিউটেশনের ফলে তৈরি করোনার নতুন নতুন উপধরন তৈরির পেছনে আরেকটি কারণ হলো এর দ্রুত বিস্তার ও সংক্রমণের ক্ষমতা। ভাইরাসের কপি তৈরি হতে যেহেতু উপযুক্ত জীবকোষের প্রয়োজন হয়, তাই এটি যত বিস্তারের সুযোগ পাবে তত বেশি মিউটেশন ঘটবে এবং নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হবে।
অনেক সময় এক দেহকোষে দুটি ভিন্ন ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ হলে, তাদের মধ্যে জেনেটিক রিকম্বিনেশনের সুযোগ তৈরি হয়। এর ফলেও তৈরি হয় নতুন ভেরিয়েন্ট বা উপধরন যেগুলো রিকম্বিন্যান্ট ভেরিয়েন্ট বলা হয়। করোনার NB.1.8.1 ভেরিয়েন্টটি (ডাকনাম "নিম্বাস") এ ধরনের একটি রিকম্বিন্যান্ট ভেরিয়েন্ট যেটি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশে অনেক দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সবমিলিয়ে ২২টি দেশে এ উপধরনটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।
তবে, জিনোমে অল্প পরিবর্তন হলেই সেটাকে উপধরনের মর্যাদা দেওয়া হয় না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা শুধুমাত্র সে সব পরিবর্তিত প্রতিলিপিকে উপধরনের মর্যাদা দেয় যেগুলো তাদের পূর্ববর্তী জেনারেশন থেকে বেশ আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।
এ পর্যন্ত করোনার হাজার হাজার মিউটেশন পাওয়া গেছে কিন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবমিলিয়ে ১৫টি উপধরনকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। এ ভেরিয়েন্টগুলোর মধ্যে আছে—Alpha, Beta, Gamma, Delta, Omicron, BA.1, BA.2, BA.5, XBB.1.5, XBB.1.9.1, XBB.1.16, EG.5, JN.1 এবং NB.1.8.1(Nimbus) উপধরন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ভেরিয়েন্টগুলো চারটি ক্লাসে ভাগ করেছে। এগুলো হলো—Variants Under Monitoring (VUM), Variants of Interest (VOI), Variants of Concern (VOC) এবং De-escalated Variants। জনস্বাস্থ্যের ওপর ঝুঁকি তৈরি করার সক্ষমতা এবং তার প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এ ভেরিয়েন্টগুলোর ক্লাস পরিবর্তন হয়।
আরও পড়ুন
Variants Under Monitoring (VUM) হল এমন ভেরিয়েন্ট যেগুলোর জিনগত পরিবর্তন ভাইরাসটি জনস্বাস্থ্যের ওপরে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে কিন্তু এর পক্ষে এখনো উল্লেখযোগ্য প্রমাণ নেই। এর মধ্যে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের ছড়িয়ে পড়া উপধরন NB.1.8. (Nimbus), BA.2.86, XBB.1.5, XBB.1.9.1, XBB.1.16 এবং EG.5। উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হাতে পেলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভবিষ্যতে এগুলোকে Variants of Interest (VOI) বা Variants of Concern (VOC) হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে পারে।
Variants of Interest (VOI) হলো এমন ভেরিয়েন্ট যেগুলোর জিনগত পরিবর্তন জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলার প্রমাণ মিলেছে এবং যেগুলো বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বা ক্লাস্টার সৃষ্টি করছে। যে বৈশিষ্ট্যগুলো একটি ভাইরাসকে VOI স্ট্যাটাস দেয় তার মধ্যে আছে এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা, গুরুতর রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা, অথবা এটি কত সহজে শনাক্ত বা চিকিৎসা করা যায় তার সক্ষমতার উপর।
বর্তমানে একটি মাত্র উপধরন Variants of Interest (VOI) হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকয় আছে। সেটি হলো- JN.1। এ ভেরিয়েন্টটি BA.2.86 (Pirola) ভেরিয়েন্টের উত্তরসূরি এবং এটি ২০২৩ সালের শেষ থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
Variants of Concern (VOC) হলো সেসব কোভিড-১৯ ভাইরাস যেগুলোর মধ্যে VOI এর বৈশিষ্ট্য থাকে এবং এর পাশাপাশি যেকোনো একটি অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য যেমন রোগের তীব্রতা বাড়ানো, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি বা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেওয়ার মত সক্ষমতা থাকে। করোনার বহুল পরিচিত Alpha, Delta, Omicron এগুলো একসময় VOC তালিকাভুক্ত ছিল কিন্তু এখন এগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা হারিয়ে De-escalated Variants এর শ্রেণীভুক্ত হয়ে গেছে।
করোনার উপধরন NB.1.8.1 যেটিকে নিম্বাস নামে ডাকা হচ্ছে সেটি বাংলাদেশ ও ভারতসহ প্রায় ২২টি দেশে শনাক্ত হয়েছে এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। JN.1 উপধরনের তুলনায় এ নতুন উপধরনটির স্পাইক প্রোটিনে মোট সাতটি নতুন পরিবর্তন ধরা পড়েছে। এগুলো হলো- T22N, F59S, G184S, A435S, F456L, T478I, and Q493E।
স্পাইক প্রোটিনে এ মিউটেশনগুলোর কারণে এটি মানবদেহের ACE2 রিসেপ্টরের সাথে তুলনামূলক শক্তভাবে বন্ধন তৈরি করতে পারে এবং এর ফলে এটি বেশি সংক্রমণক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে এটি মূল কারণ। তবে, এ উপধরনটির সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হলেও এর ঝুঁকি কিছুটা কম, কারণ, প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে এটি টিকা করোনার টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের জটিল রোগ তৈরি করতে ততটা সক্ষম নয়।
নিম্বাসের পাশাপাশি করোনার আরেকটি রিকম্বিন্যান্ট ভেরিয়েন্ট কানাডা ও ভারতসহ অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ উপধরনটির বৈজ্ঞানিক নাম XFG যাকে 'স্ট্রাটাস' নামেও ডাকা হচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) দেশে XFG উপধরন শনাক্তের কথা নিশ্চিত করেছে। XFG উপধরনটি LF.7 এবং LP.8.1.2 উপধরনের জেনেটিক রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এবং এর স্পাইক প্রোটিনে চারটি মিউটেশন রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এখনো এটি শ্রেণিবদ্ধ করেনি। এটি নিম্বাস উপধরনের তুলনায় এটি কম সংক্রমণক্ষম, তবে এর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকে বাইপাস করার ক্ষমতা নিম্বাসের চেয়ে একটু বেশি।
করোনাভাইরাস তার প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তিত হবে এটাই স্বাভাবিক। মিউটেশনের মাধ্যমে কিছু ভেরিয়েন্ট দুর্বল হয়ে পড়বে এবং কিছু শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
করোনাভাইরাস তার প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তিত হবে এটাই স্বাভাবিক। মিউটেশনের মাধ্যমে কিছু ভেরিয়েন্ট দুর্বল হয়ে পড়বে এবং কিছু শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আশার কথা হলো, যে ভেরিয়েন্টগুলো এখন বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেগুলোর তীব্র রোগ তৈরি করার সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে এবং দেখা গেছে এদের বিরুদ্ধে করোনার প্রচলিত ভ্যাকসিন অনেকটাই কার্যকরী।
তবে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে আরও কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে। তাই, সাবধানতার বিকল্প নেই। তাই সবার উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যাতে এটি বেশি ছড়াতে না পারে। কারণ, এটি যত বেশি ছড়াবে, তত নতুন ভেরিয়েন্ট তৈরি হবে এবং শক্তিশালী ভেরিয়েন্টের আবির্ভাব হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
আর, করোনাভাইরাস ও কোভিড-১৯ নিয়ে অনেক গুজবও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। সবার এসব গুজব থেকে সাবধান থাকতে হবে। ‘সিঙ্গাপুর বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত মৃতদেহের পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) সম্পন্ন করেছে। গভীর তদন্তের পর তারা আবিষ্কার করেছে যে কোভিড-১৯ কোনো ভাইরাস নয়, বরং এটি এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যা রেডিয়েশনের সংস্পর্শে এসে মানুষের মৃত্যু ঘটায় রক্ত জমাট বাঁধার মাধ্যমে’- এ ধরনের গুজবও ছড়িয়ে পড়ছে।
অনেক সচেতন মানুষ এটি বিশ্বাস করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ারও করছেন, যা খুব ভয়ানক। করোনাভাইরাসে আরেকটি মহামারি থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সঠিক সময়ে পরীক্ষা করা, ভ্যাকসিন নেওয়া ও আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
ড. মো. আজিজুর রহমান ।। অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ajijur.rubd@gmail.com