সেই কবেকার এক ভাড়াটে বাড়ির উঠানে একটা শিউলি গাছ লাগিয়েছিলেন দাদু। গাছটা কিন্তু ভাড়াটেদের মতো মাথা তুলতে গিয়ে কুণ্ঠা বোধ করেনি। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে এক টালমাটাল সময়ে গাছটা তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে ফুল দিতেও শুরু করল।

শরতের হালকা হিম ছোঁয়া আকাশে ভোরবেলা যখন আলো ভালো করে মুখ দেখায়নি তখন বন্ধুদের সঙ্গে রমনা পার্কে চলে যেতাম। দরজা আস্তে টেনে দিয়ে উঠানের দেয়াল টপকে রাস্তায় নামার আগে দেখতাম শিউলি গাছটা টুপটাপ করে সাদা আর কমলা ছোপ লাগা ফুল ঝরিয়ে যাচ্ছে।

জানতাম, একটু পরেই দাদু ঘুম থেকে উঠে একটা ছোট্ট কাঁসার ট্রেতে একটা একটা করে শিউলি ফুল কুড়াবেন। তারপর থালার ওপর পাতা এক খণ্ড কাপড়ে ফুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যাবেন। সারাদিন তার ঘরের টেবিলের ওপর থালাটা রাখা থাকবে।

আমাদের উঠানটাকে সাদা রঙের নিবেদনে ভরে দিয়ে ফুলগুলো আমাকে জানান দিতো দুর্গাপূজার সময় চলে এসেছে। দাদু বলতেন, শিউলি ফুলের সাতটা সাদা পাপড়িতে মনে হয় সাত রাজ্যের জ্ঞান আর আনন্দ জড়িয়ে আছে। কথাটা যে কেন বলতেন তা কখনো জানতে চাইনি।

তখন শরৎ এত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসতো না। আকাশ নীল শীতের স্পর্শ মেখে ছড়িয়ে থাকতো মাথার ওপর। ভোরে উঠানের ঘাস ভিজে যেত সারা রাত হিম পড়ে। দুপুরে কমলা রঙের রোদে বাড়ির ছাদে কেউ শীতের পূর্ব প্রস্তুতিতে লেপ-কাঁথা ছড়িয়ে দিয়ে জমা করতো সূর্যের উত্তাপ। সন্ধ্যার আগে পাশের বিশাল জায়গাওয়ালা বাড়িটার বাগানে জড়ো করা পাতায় আগুন জ্বালতো কেউ। তখন হালকা ধোঁয়ার অদ্ভুত সুঘ্রাণে কেমন পূজার অকারণ আনন্দ ছড়িয়ে যেত মনে।

জন্মাবধি শহুরে প্রাণী বলে আমার স্মৃতির সঞ্চয়ে গ্রাম অথবা মফস্বল শহরের পূজার মধুর স্মৃতি জমা নেই। এই রাজধানীর যে পাড়াটায় আমি বেড়ে উঠেছি সেখানে খুব পুরোনো একটা কালী মন্দির আজও আছে। কৈশোরে সেই মন্দিরে দুর্গাপূজা হতো। তবে এখনকার মতো জাঁকজমক ছিল না সেই পূজায়।

পূজার সময়ে এখন চারপাশে যত হইচই পড়ে যায়, মণ্ডপে মণ্ডপে ঝকঝকে আলো জ্বলে ওঠে, মানুষের ভিড় উপচে পড়ে, তাদের অবিরল হাসি-কথায় ভাসতে থাকে চারপাশ, তখন এরকম হতো না।

পুরোনো মন্দিরের গা বেয়ে কোথাও বটের চারা জেগে উঠেছে। কোথাও শুধুই ফাটল মাকসার জালের মতো ছড়িয়ে গিয়ে অনেক পুরোনো সময়ের গল্প বলতে চাইছে যেন। মন্দিরের সামনে সামান্য ঘাসে ঢাকা একটা চাতাল। সেখানে একটা হাড়ি-কাঠ বসানো ছিল। কালচে হয়ে যাওয়া কাঠের কাঠামো। কবেকার ছিল কে জানে? বুঝতে পারতাম একদা মন্দিরে পশুবলির ব্যাপারটার প্রচলন ছিল। চাতাল ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলে ছোট একটা পুকুর। পুকুরের জলেও তখন ছায়া ভাসতো উৎসবের।

রাজধানী হলেও ঢাকা শহরটা আমার কৈশোরে এখনকার মতো আলো ঝলমল ছিল না। পূজার সময়ে এখন চারপাশে যত হইচই পড়ে যায়, মণ্ডপে মণ্ডপে ঝকঝকে আলো জ্বলে ওঠে, মানুষের ভিড় উপচে পড়ে, তাদের অবিরল হাসি-কথায় ভাসতে থাকে চারপাশ, তখন এরকম হতো না।

দুর্গাপূজা কেমন এক অবসর নিয়ে আমার মনে ডালপালা মেলে দিতো। আমাদের পাড়ার মন্দিরে কিন্তু পূজার পাঁচটা দিনে উৎসবের কমতি থাকতো না। পাশের বাড়িতে থাকতেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবার। ছেলেরা আমার বন্ধু। সকালবেলা তাদের বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আগেই ঠিক করে নিতাম ওখানে কত বার খাবো এবং কখন কখন খাবো।

ফোড়ন আর তেজপাতা দেওয়া নিরামিষ তরকারি আর লুচি ভাজার গন্ধ ভেসে থাকতো কিশোর বয়সে সুখাদ্যের তীব্র আগ্রহের মতো। সকালবেলা তাদের বাড়িতে ধূপ-ধুনো দেওয়া হতো। সেই সুগন্ধের স্মৃতিতে ভর করে আজও কত ছবি, কত বন্ধুর মুখ, কত আড্ডার স্মৃতি ফিরে আসে। যখন দেখি, ঢাকে কাশ ফুল বেঁধে ঢুলিরা দূরের কোনো মাঠের পথ বেয়ে চলছে মনের মধ্যে আনন্দের সুর আজও গুনগুনিয়ে ওঠে।

বন্ধু অমরদের লন্ড্রিটা পূজার কয়েকটা দিন হয়ে উঠতো আমাদের স্থায়ী আড্ডাখানা। অমরের বাবা পূজায় গ্রামে যেতেন। তখন বন্ধুর কল্যাণে আমরাই লন্ড্রির পরিচালক হয়ে বসতাম। সেখান থেকে সামান্য দূরে কালী মন্দির আর মন্দির লাগোয়া পরেশদার মুদি দোকান।

মন্দিরের দেয়াল ঘেঁষে বসতো মেলা। কত কী টুকিটাকি জিনিস সাজিয়ে বসতো অজানা মানুষেরা। সন্ধ্যা হয়ে গেলে মন্দির থেকে কাঁসর-ঘণ্টার ধ্বনি ভেসে আসতো। দুপুরে মাইকে ভেসে আসতো গান, লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘ওগো আর কিছু তো নাই’।

মেলায় পাড়ার মানুষদের ভিড় বাড়তো। দোকানিরা মোমবাতি অথবা হ্যারিকেন জ্বেলে দিতো পথের ওপর। মনে হতো, আকাশ থেকে বিকালের আলো খণ্ড খণ্ড হয়ে রয়ে গেল রাস্তার ওপর। ঘুরে বেড়াতাম আমি তখন সেই আলোর চারপাশে, মানুষের মৈত্রী ও মমতার চারপাশে।

পূজার সময়ে পরেশদার দোকানে আমাদের চা ফ্রি ছিল। মন্দিরের চাতালে মাটির চুলায় বিশাল কড়াই বসিয়ে ভাজা হতো নিমকি। ডুবো তেলে অসংখ্য নক্ষত্রের মতো ভেসে থাকা নিমকির লোভে কতবার যে মন্দিরে আসা যাওয়া করতাম তার ইয়ত্তা নেই। কখনো বন্ধুরা দলবেঁধে চলে যেতাম গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশনের পূজা দেখতে। তখনো জায়গাটা অনেক কিছুতে ভরে ওঠেনি। বিশাল প্রাঙ্গণে এত স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। বাসে চেপে আসা-যাওয়ার পথে আমাদের আনন্দের বুদবুদ যেন শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়তো।

কখনো বন্ধুরা দলবেঁধে চলে যেতাম গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশনের পূজা দেখতে। তখনো জায়গাটা অনেক কিছুতে ভরে ওঠেনি। বিশাল প্রাঙ্গণে এত স্থাপনা গড়ে ওঠেনি...

শিউলি সামান্য এক ফুল। দ্রুত ঝরে যায়, তারও আগে থালায় শুকায়। অপরাজিতা ও পদ্ম ছাড়া দশভুজা-বন্দনা হয় না। তবুও কবি ও শিল্পীর ভালোবাসায় কেউ কেউ এই ফুলকে ‘শরতের হাসি’ বলে জানে। এই হাসির মতোই আমাদের মিলেমিশে থাকার গল্পটা এই শহরে হয়তো অতীত হয়ে গেছে।

এখন হোল্ডিং আর স্ট্রিট নম্বর দেখে মানুষের নিবাস খুঁজে বের করতে হয়। ভুলে গেছি সবুজ রঙ করা দরজাওয়ালা বাড়িতে ওমুক থাকেন, বড় জাম গাছের ছায়ায় ঘেরা বাড়িতে তমুকের বসবাস। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকে উৎসব ভাগ করে নেওয়ার আনন্দও এভাবেই হয়তো একদিন হাতছাড়া হয়ে গেছে আমাদের।

শিউলি ফুলের গাছও আজকাল খুব বেশি চোখে পড়ে না। শরতের দিন যায় বৃষ্টি-বাদল মাথায় নিয়ে। এই জীবনের ভেতরে যৌথ ভাবনার জায়গাটাও ভাগাভাগি হয়ে গেছে। উধাও হয়ে গেছে শিউলি গাছের তলায় অজস্র ফুল ঝরে পড়ে থাকার দৃশ্য। ভাবি, আমি খুব ভাবি, কোথায় গেলে আচমকা কোনো বাড়ির উঠানে দেখতে পাবো দাদুর হাতে লাগানো সেই শিউলি গাছ? মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পূজার সময় আসার আগে?

যে বাড়িতে এখন থাকি সেখানে শিউলি গাছ নেই। পদ্ম নেই। ফুলগাছ লাগানোর যে সামান্য জায়গাটুকু আছে তা দখল করে রেখেছে অদ্ভুত অচেনা সব গাছ। দাদুও চলে গেছেন সেই কবে। তার সাদা থান শাড়ি আর পানের মশলার দাগ লাগা কমলা ঠোঁট শিউলি ফুলের মতোই উধাও।

তবু আজও শরৎকালের ভোরবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কখনো স্পষ্ট শুনতে পাই দাদু প্রশ্ন করছেন, ‘ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে এখন আর ঝরে পড়া শিউলি ফুল দেখতে পাস না তুই?’ উত্তর দিই, দেখতে পাই না তো। এই শহর আমার স্মৃতির ভেতরে সেই ঝরে পড়া শিউলির ঘ্রাণটুকুও মুছে দিয়েছে। পূজার আগে আগে সেই শীতের সম্ভাবনাময় হাওয়া, নীল আকাশ মুছে দিয়েছে। শহর মুছে দিয়েছে না আমরাই মুছে ফেলেছি? স্মৃতি মুছে ফেলতে ভীষণ দক্ষ আমরা।

ভাবি, কোথাও একটা শিউলি ফুলের চারা লাগাবো। দুঃসময় ভেদ করে গাছটা বেড়ে উঠবে তরতর করে। রাত্রির আকাশ থেকে ঝরে পড়া হিমের মায়া মেখে ফোটাবে সে অসংখ্য শিউলি ফুল। আমি আবার দেয়াল টপকে ভোরবেলা পার্কে যাবো। দরজাটা আলগোছে বন্ধ করে যাওয়ার সময় দেখতে পাবো উঠানে ছড়িয়ে আছে শিউলি ফুল।

আমার মনের মধ্যে অকারণে বাজতে থাকবে পূজার সময় চলে আসার সুর। ছুটি হয়ে যাবে আমার। বন্ধু অমরের লন্ড্রিতে বসে শুনতে পাবো মাইকে ভেসে আসা গান, লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘ওগো আর কিছু তো নাই...’

ইরাজ আহমেদ : কবি