শক্তি, সৌন্দর্য ও মমতার প্রতীক দেবী দুর্গা
দুর্গা অর্থাৎ যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন। বাংলার দুর্গাপূজা নিছক একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও ঐতিহ্যের এক প্রতিচ্ছবি।
মা দুর্গা কেবল এক দেবী নন, তিনি একাধারে মহাবিশ্বের শক্তি, সৌন্দর্য ও মমতার প্রতীক। প্রায় ৩০০০ বছর ধরে চলে আসা দুর্গাপূজা, মূলত একটি শাক্ত উৎসব। বৈদিক যুগে শক্তির উপাসনা শুরু হলেও, দুর্গাপূজার বর্তমান প্রতিমাতাত্ত্বিক উপাসনা শুরু হয় মধ্যযুগে।
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন সময়ে বিবর্তন হলেও মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী মাহাত্ম্য অংশে দুর্গার যে রূপের বর্ণনা আছে, সেটিই বাংলার প্রতিমা নির্মাণের মূলভিত্তি। এই বর্ণনায় দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছেন, যেখানে অসুর মহিষের রূপ ধারণ করেছিলেন। এটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী লড়াই।
শরৎকালীন দুর্গাপূজাকে শারদ উৎসব বলা হয়। পাল ও সেন যুগে দেবী দুর্গাসহ অন্যান্য দেব-দেবীর ধাতব মূর্তির প্রচলন ছিল। মধ্যযুগে কৌলীন্য প্রথা এবং বৈষ্ণব ধর্মের উত্থানের পর দুর্গা পূজা আরও বিস্তার লাভ করে এবং দুর্গা প্রতিমা একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পরূপ পরিগ্রহ করে। এই সময়েই দেবী দুর্গার সাথে প্রতিমায় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ-এর মূর্তি যুক্ত হয়, যা বর্তমানে দুর্গা প্রতিমার একটি অপরিহার্য অংশ।
বিজ্ঞাপন
বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতিতে দেবী দুর্গা হলেন শূন্য থেকে সৃষ্টি, পাপ ও অশুভ নাশ, ন্যায় ও ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রতীক। ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ এই শব্দগুচ্ছ তার মূল সার যা আখ্যায়িত করে যে দেবী তার সব সত্তার মধ্যে শক্তিরূপে অবস্থিত। ‘মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ এই শব্দগুচ্ছ তার মূল সার যা আখ্যায়িত করে যে দেবী তার সব সত্তার মধ্যে মাতৃরূপে অবস্থিত।
এই ভাবধারা শুধু তত্ত্বগত নয়- সাহিত্য, পূজা-অনুষ্ঠান, মন্ত্র, ভক্তি ও সামাজিক জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। দেবীর শক্তি কোনো বাহ্যিক শক্তি নয়-বরং অভ্যন্তরীণ, সৃষ্টিকারী ও সংহিত শক্তি যেটি সব সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
দেবী দুর্গার প্রতিমাকে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে এই ধারণা স্পষ্ট হয় যে সব শক্তির আধার এই দেবী। দশভুজা মা দুর্গার দশটি হস্তে রয়েছে ১০টি অস্ত্র, যার প্রতিটি বিভিন্ন দেব-দেবী থেকে প্রাপ্ত এক একটি শক্তির প্রতীক।
চক্র: শ্রীবিষ্ণু থেকে প্রাপ্ত চক্র দৃঢ়তা ও সংহতির প্রতীক, যা প্রকাশ করে সব সৃষ্টির কেন্দ্রে দেবীর অবস্থান।
প্রায় ৩০০০ বছর ধরে চলে আসা দুর্গাপূজা, মূলত একটি শাক্ত উৎসব। বৈদিক যুগে শক্তির উপাসনা শুরু হলেও, দুর্গাপূজার বর্তমান প্রতিমাতাত্ত্বিক উপাসনা শুরু হয় মধ্যযুগে।
ত্রিশূল: দেবাদিদেব মহাদেব থেকে প্রাপ্ত ত্রিশূলের তিনটি ফলা—সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রকাশক।
শঙ্খ: দেবতা বরুণ প্রদত্ত শঙ্খের ধ্বনিতে স্বর্গ, মর্ত্য ও নরকের সব অশুভ শক্তি ভীত ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
বজ্র: দেবরাজ ইন্দ্র প্রদত্ত বজ্র দৃঢ়তা ও সংহতির প্রতীক, যা দেবীর লক্ষ্যে পৌঁছানোর ইঙ্গিতবাহী।
গদা: যমরাজ প্রদত্ত গদা আনুগত্য, ভালোবাসা এবং ভক্তির প্রতীক।
তীর-ধনুক: পবন দেবতা প্রদত্ত তীর ধনুক ইতিবাচক শক্তির প্রতীক।
খড়্গ: গণেশ প্রদত্ত খড়্গ বুদ্ধির প্রতীক, যা দিয়ে সব বৈষম্য ও অশুভকে বিনাশ করা যায়।
ঘণ্টা: দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত কর্তৃক প্রদত্ত ঘণ্টা অশুভ শক্তি বিনাশের ইঙ্গিত প্রদানকারী।
পদ্ম: পরমেশ্বর ব্রহ্মা প্রদত্ত পদ্ম ফুল জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক চেতনা উত্থানের প্রতীক।
নাগপাশ: শেষ নাগ প্রদত্ত সাপ শুদ্ধ চেতনার প্রতীক।
আরও পড়ুন
সুতরাং, দেবী দুর্গার দশটি হস্ত শক্তির দশটি রূপকে প্রকাশ করে। এটি এই ধারণাকে সমর্থন করে যে, অশুভ শক্তিকে দমন করার জন্য সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি প্রয়োজন। দেবী দুর্গার সঙ্গে পূজিত সবাই কোনো না কোনো শক্তির আধার।
সিংহ: দেবীর বাহন সিংহ শক্তি, সাহস ও বীরত্বের প্রতীক।
লক্ষ্মী: মা দুর্গার ডানদিকে অবস্থান করেন লক্ষ্মী, যিনি ধন, সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক। আর, যা নির্দেশ করে শক্তির উপাসনা করলে জীবনে অর্থ ও প্রাচুর্য আসে।
সরস্বতী: মায়ের বামদিকে অবস্থানরত দেবী সরস্বতী জ্ঞান, বিদ্যা ও শিল্পের প্রতীক, যা বোঝায় শক্তির সঙ্গে জ্ঞান ও শিল্পকলার সংযোগ অপরিহার্য।
কার্তিক: কার্তিক যুদ্ধ ও শৌর্যের প্রতীক, যা নির্দেশ করে শক্তির উপযুক্ত প্রয়োগের জন্য শৌর্য ও সামরিক দক্ষতার প্রয়োজন।
গণেশ: বিঘ্নহরণকারীরূপে খ্যাত গণেশ বার্তা দেয় যে, সব শুভ কাজের প্রারম্ভে বিঘ্ননাশের জন্য গণেশের আশীর্বাদ প্রয়োজন।
মহিষাসুর: মহিষাসুর দম্ভ, লোভ ও অশুভ শক্তির প্রতীক। তার বধ মানবজাতির মধ্যে বিরাজমান নেতিবাচক শক্তির বিনাশকে নির্দেশ করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে মা দুর্গার প্রতিমার প্রতিটি অংশই বিভিন্ন শক্তির প্রতীক ও প্রকাশ। আর, তাই মন্ত্রোচ্চরিত হয় ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’। যে দেবী শক্তিরূপে সংস্থিতা, তিনিই আমাদের পূজিতা। এই মন্ত্রপাঠে তাই মন শান্ত হয়, সংযুক্তি ও একাত্মবোধ গড়ে ওঠে।
সর্বভূতে দেবীশক্তির অবস্থান মানুষের প্রতি করুণা, সহমর্মিতা ও ন্যায়বোধের বিকাশ ঘটায়। কারণ সব প্রাণে, সব বস্তুতে, মানুষের অন্তরে দেবীশক্তি বর্তমান।
স্ব-বিভাজিত ও বিভক্ত মানসিক অবস্থা ভয়, দুশ্চিন্তা, নিরাশা ইত্যাদির বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ শক্তি উদ্দীপিত হয়। সর্বভূতে দেবীশক্তির অবস্থান মানুষের প্রতি করুণা, সহমর্মিতা ও ন্যায়বোধের বিকাশ ঘটায়। কারণ সব প্রাণে, সব বস্তুতে, মানুষের অন্তরে দেবীশক্তি বর্তমান।
দেবী দুর্গা দশটি অস্ত্র দিয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন। প্রতিমায় অবস্থিত সম্মিলিত শক্তির প্রতীক ভক্তদের মাঝেও অধিষ্ঠিত হয়ে ওঠে এবং মানুষ সকল অশুভ শক্তির বিনাশ করতে পারে। তাই ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ আমাদের মাঝে অভ্যন্তরীণ সাহস ও ধৈর্যের বৃদ্ধি ঘটায়, ভয় দূর করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, অপরের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করে, দেবী দুর্গা নারীররূপে, মায়ের রূপে, যোদ্ধা রূপে, সর্বোপরি শক্তিরূপে প্রতিভাত হয়।
সব নিপীড়ন, অবিচার, অসমতা ও স্বৈরাচার বিরোধী শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে দেবীশক্তি, যা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশেষত বর্তমান সময়ের নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের মোকাবিলা করার জন্য দেবী দুর্গার শক্তিরূপেণ সংস্থিতা এক মহৌষধ।
নারীই শক্তি, নারীর মাঝেই বিরাজমান সব শক্তির আধার, এই আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হতে পারলেই নারীশক্তি হবে জাগ্রত। আর, এই জাগরণের ফলে নারী একদিকে যেমন আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারবে, তেমনি সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নির্বিঘ্নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেও সমর্থ হবে।
ড. সঞ্চিতা গুহ : অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়