দুর্গাপূজা : ধর্মীয় সম্প্রীতিতে উৎসবের ভূমিকা
একটা দেশে যখন বহুধর্মীয় ও বহু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ থাকে তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার অন্যতম প্রধান মূলমন্ত্র হলো পরস্পরকে ভালোমতো জানা। পরস্পরের ধর্মীয় সংস্কৃতি, লোকাচার, মিথ, ভাষাগত ঐতিহ্য ও অভিব্যক্তি প্রভৃতি বিষয় জানার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক বিভ্রান্তি দূর হয়।
রাজনৈতিকভাবে বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য যেসব অপপ্রচার চালানো হয় ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, সেগুলো ধরতে পারে সাধারণ মানুষ। সহজে বিভ্রান্ত করার সুযোগ থাকে। তাছাড়া পরস্পরকে জানার মধ্য দিয়ে এক ধরনের সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়, যে কারণে একে অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে না। এগুলো নতুন কথা না।
বিজ্ঞাপন
কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশে সেই বাস্তবতা ছিল। আমরা সম্ভবত শেষ প্রজন্ম যারা দেখে এসেছি, ধর্মীয় উৎসবগুলো স্ব স্ব ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ঈদ যেমন হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে উদযাপন করেছে, পূজাও তেমনি সবার উৎসব হয়ে উঠেছে।
আমি মেহেরপুর শহরে বড় হয়েছি। শৈশবে এই শহরে হিন্দু-মুসলিম বলে আলাদা কোনো বোধ বা বিচার আমি বড়দের মধ্যে দেখিনি। আমার মনে পড়ে, আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, আমার ধর্মপ্রাণ বাবা একদিন আমাকে শহরের এক বাড়িতে নিয়ে গেলেন। শিক্ষক শাশ্বত নিপ্পন চক্রবর্তীর বাড়ি।
বিজ্ঞাপন
আমাকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে তাকে বললেন, ‘আমার ছেলেকে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। তাকে মানুষ করার দায়িত্ব তোমার’। আজ এত বছর পর, সেই শাশ্বত নিপ্পনের পরিবার এখন আমার পরিবারের অংশ, কিংবা আমার পরিবার তার পরিবারের অংশ। সম্প্রীতির ঐতিহ্যটা এভাবেই পরিবারের হাত ধরে তৈরি হয়েছে।
আমাদের শহরে বিখ্যাত সংস্কৃতিজন বলতে ছিলেন বাবুয়া বোস। টুপি-পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা আমার পরহেজগার বাবা একদিন তার কাছেও আমাকে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘দাদা, ছেলে মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। আশীর্বাদ করে দেন’। বাবুয়া বোস আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে দিলেন। অনেক পরে জেনেছি, এই বাবুয়া বোস হলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী প্রসেনজিৎ বাবুয়া বোস।
দেখতাম, আমার মা ঈদে নিমন্ত্রণ করছেন আমার শিক্ষক শাশ্বত নিপ্পন চক্রবর্তীকে। পিঠাপুলি রান্না হলে বাবা সেটা পৌঁছে দিচ্ছেন বাবুয়া বোসের বাড়িতে। এই ছিল আমাদের মুসলিম পরিবারের পারিবারিক ঐতিহ্য। অথচ আমার বাবা খুব সাধারণ মুসলিম পরিবারের সন্তান। নিজে যে খুব সংস্কৃতিমনা তা কিন্তু না; সর্বক্ষণ ধর্মেকর্মে নিয়জিত থাকতেন।
আসলে, ধর্মীয় সম্প্রীতির ব্যাপারটি তখন সহজাত ছিল। এখনকার মতো ট্যাগ লাগানো ‘প্রগতিশীল মানুষ’রাই শুধু অসাম্প্রদায়িক ছিলেন না, সাধারণ মুসলিম বা সাধারণ হিন্দু পরিবারের অশিক্ষিত শিক্ষিত কারওই তখন ধর্মীয় বিভাজনের মন্ত্র জানা ছিল না। ছিল হয়তো কোথাও না কোথাও।
উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ও বিদ্বেষের ইতিহাস তো আজকের না। আমি বলছি আমার শৈশবে দেখা মেহেরপুরের কথা। কিন্তু একথা সবাই মানবেন যে, হিন্দু-মুসলিম ঐতিহাসিক বিভাজনের উৎসমূল ছিল গোটা ভারতবর্ষের রাজনীতি। তখন বিশাল ভারতবর্ষের অধীনে ছিলাম আমরা সবাই। পরবর্তীতে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ আলাদা আলাদা রাষ্ট্র হয়।
ভারতবর্ষের অতি সাধারণ মানুষের হৃদয় থেকে এই বিষবাষ্প উৎসারিত না। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক ফাঁক সেটা ধর্মের ভেতর থেকে আসেনি। এই উপমহাদেশের বৃহত্তর নিরক্ষর বা অল্পশিক্ষিত জনগণ নিজেদের ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারে না।
অধিকাংশ শিক্ষিত জনগণও ধর্মগ্রন্থসমূহ পড়ে দেখে না। ফলে ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে যে উন্মাদনা সেটা বাইরে থেকে আসে। সমাজ এবং রাজনীতি সেটা সৃষ্টি করে। তবে আমি নিজে সৌভাগ্যবান আমার শহরে সেই বিষবাষ্প শৈশবে টের পাইনি। পূজার সময় পুরো শহর সেজে উঠতো, মনে হতো এটা শহরের সবার উৎসব। আমার শহরে আমি কখনো পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটতে শুনিনি। এ ধরনের চিন্তা কারও মাথায় আসবে, সেটাই ছিল অকল্পনীয়।
শৈশবে এই শহরে হিন্দু-মুসলিম বলে আলাদা কোনো বোধ বা বিচার আমি বড়দের মধ্যে দেখিনি। আমার মনে পড়ে, আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, আমার ধর্মপ্রাণ বাবা একদিন আমাকে শহরের এক বাড়িতে নিয়ে গেলেন। শিক্ষক শাশ্বত নিপ্পন চক্রবর্তীর বাড়ি।
উৎসবের মধ্য দিয়েই ধর্মের ডি-থিওলাইজেশন ঘটে। ধর্মীয় উৎসবগুলো শুধু একক ধর্মীয় উৎসব থাকে না, সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উৎসব হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ধর্মীয় উৎসব থেকে সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপ নেয়। অথচ কয়েক দশকে উৎসবের সেই সাংস্কৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য আস্তে আস্তে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। ধর্মীয় উৎসবগুলো হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উৎসব। পূজামণ্ডপে যদি প্রহরা বসাতে হয়, এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! প্রহরা বসিয়েও যখন দেশের সব মণ্ডপ রক্ষা করা যায় না, এর চেয়ে অপমানের আর কী হতে পারে!
আলোচনার এ-পর্যায়ে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ইতিহাস যারা সামনে তুলে আনার চেষ্টা করবেন, তাদের আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দুটি সম্প্রদায়ের মধ্য সৃষ্ট দাঙ্গা ছিল এই উপমহাদেশের নষ্ট রাজনীতির সহিংস ভাষা। সাধারণ মানুষকে লাকড়ি হিসেবে জ্বালানো হয়েছে এই বিভেদ-সৃষ্টিকারী রাজনীতির চুল্লিতে। আমরা সাধারণ মানুষ সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারি। আমার পারিবারিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাকে সেই শিক্ষা দিয়েছে।
এই শিক্ষাটা আসবে পরস্পরকে জানার মধ্য দিয়ে। ভারতবর্ষে এ দুটি সম্প্রদায় অতি কাছাকাছি বাস করে। শতশত বছর ধরে অত্যন্ত নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে এই ভূমিতে হিন্দু-মুসলমান বাস করে আসছে। আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়েছে সম্পর্ক। কিন্তু এত কিছুর পরও এইদুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় সবচেয়ে কম জানে পরস্পরকে।
বিশেষত আজকের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু এই বাস্তবতাও নতুন বাস্তবতা না। একটু পেছনে ফিরে গেলে দেখতে পাবো, ভারতবর্ষে সর্বধর্মীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করা ব্রাহ্ম সমাজ প্রথম সেই উদ্যোগ গ্রহণ করে। রামমোহন-পরবর্তী সময়ে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ‘নববিধান’ নামে এক সর্বজনীন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন।
আরও পড়ুন
‘নববিধান’ তত্ত্বের মূলকথা ছিল সমন্বয়ধর্ম বা ‘রিলিজিয়ন অফ হারমোনি’। গিরিশচন্দ্র সেন মূলত তারই শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ইসলামচর্চায় ব্রত হন। এবং পবিত্র আল কুরানের অনুবাদসহ ২৫টির বেশি ইসলামি গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। গিরিশচন্দ্র মুসলমানদের কাছ থেকে ‘ভাই’ ও ‘মৌলানা’ খেতাব পান। কিন্তু এই মহৎ উদ্যোগ পরবর্তী সময়ে আন্তঃধর্মীয় অনুশীলনের ক্ষেত্রে চর্চিত হয়নি। উল্টো হিন্দু-মুসলিম বিরোধ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর অবলম্বন। ভুলপথে পরিচালিত হয়েছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষেরা।
শত বছর ধরে যে বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তির চাষ হয়েছে এই উপমহাদেশে মাটিতে, তা কেবল পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে দূর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে উৎসব পার্বণ সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে। উৎসব হিংসা বিদ্বেষ দূর মনে মানুষের মনে নির্মল আনন্দ নিয়ে আসে। সব ধর্মীয় উৎসবের মূলে থাকে মানুষের মনের অশান্তি ও অসুরকে দূর করে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
আমাদের জাতীয় জীবনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যও আমাদের সেই শিক্ষা দেয়। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি যে সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য বাংলার মানুষ লড়াই করেছে সেই বাঙালি সংস্কৃতিরও কোনো একক ধর্মীয় পরিচয় নেই। বহুত্ববাদী ধর্মীয় চেতনা বাংলার সম্পদ। একাত্তরে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ক্ষমতা ও বিভেদের রাজনীতি চায় এই ঐক্য নষ্ট করতে।
আমাদের উচিত তাই ধর্মের বাইরের ডাকে নয়, ভেতরের ডাকে সাড়া দেওয়া। ঘৃণা ও বিদ্বেষের ভাষা আমাদের মুখে তুলে দিয়ে লাভটা হচ্ছে কার? সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এটা তো নিশ্চিত, এটা সর্ব কল্যাণময় সৃষ্টিকর্তার ভাষা না। বরঞ্চ আমাদের হৃদয়ের সংকীর্ণতা দিয়ে আমরা স্রষ্টাকে বড় করতে গিয়ে অপমানই করি। সে কথায় বলছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আমি নিজে সৌভাগ্যবান আমার শহরে সেই বিষবাষ্প শৈশবে টের পাইনি। পূজার সময় পুরো শহর সেজে উঠতো, মনে হতো এটা শহরের সবার উৎসব।
ময়মনসিংহের করিমগঞ্জের জুট রেজিস্ট্রেশনের সহকারী ইন্সপেক্টর কাজী আহমদকে লেখা চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘ধর্ম যদি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে খর্ব করে তার চেয়ে শোচনীয় কিছু হতে পারে না। যারা সব মানুষের এক ঈশ্বরে যথার্থ বিশ্বাস রাখেন তারা কোনো কারণেই মানবকে অপমান করে নিজের ধর্মকে অপমানিত করতে পারে না। এই আমার মত। ক্ষুদ্র হৃদয় যাদের ঈশ্বরের সিংহাসনকে তারা সংকীর্ণ করে—এটা অপরাধ।’
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে আমরা নতুন করে ভাবতে পারি এই কথাগুলো। দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন দুর্গা। দুর্গতি নাশ করেন তিনি। মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে মা দুর্গা আবির্ভূত হয়ে মানুষকে আত্মশক্তিতে জাগরূক করে তোলে।
শুভশক্তি আবাহনের এই পূজা তার ধর্মীয় তাৎপর্য ছাড়িয়ে আমাদের জাতীয় জীবনেও বয়ে আনতে পারে সম্মিলিত শক্তির জয়গান। বাংলার বহু মত ও ধর্মের মানুষ যূথবদ্ধ হতে পারে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসায়, শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতায়।
পৃথিবীর আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত হোক, শারদীয় উৎসবে সেই কামনা।
মোজাফ্ফর হোসেন : কথাসাহিত্যিক