১৭ মার্চ ২০২০। সেদিনের কথা কারও কি মনে আছে? সেদিন থেকে কয়েকদিনের জন্য স্কুল, কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কারণ একটাই মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সেই ছুটি অনির্দিষ্ট কালের আবরণে ঢাকা পড়েছিল। সহজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দেশসহ গোটা পৃথিবী।

বাংলাদেশে একটা সময় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শহরকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় শহর থেকে উপজেলায়, সেখান থেকে মফস্বলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বলা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বড় সময়ের জন্য স্থবির ছিল।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ২০২০ সালের এসএসসি, এইচএসসি এমনকি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও বাতিল করতে হয়েছিল। সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী ক্লাসে অটো প্রমোশন দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে ২০২১ সালের পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করতে হয়েছে যা সত্যিই দুঃখজনক। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। একজন শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন দীর্ঘ প্রতীক্ষার ফসল। কিন্তু করোনার কারণে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি ও গ্রিন ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনলাইনে সম্পন্ন হয়েছে।

করোনাকালে আমাদের শিক্ষকরা কেমন ছিলেন? আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও মাসিক বেতন, উৎসব বোনাসসহ প্রায় সব সুযোগ সুবিধা পেয়েছিলেন। এমনকি মিটিং করেও মিটিং ভাতা নিয়েছে অনেকেই, যা গণমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু সারা দেশের অসংখ্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রকৃতপক্ষে কেমন ছিলেন? অনির্দিষ্টকাল বন্ধের মধ্যে শিক্ষকদেরও খেতে হয়েছে, বাসা ভাড়া দিতে হয়েছে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে হয়েছে, ঈদ আনন্দ তো উনাদেরও থাকার কথা, পূজা-পার্বণ, বড়দিন সবই তো উপস্থিত ছিল, কোভিড থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় করতে হয়েছে, চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের ফি দিতে হয়েছে, হাসপাতালে যেতে হয়েছে, ওষুধ কেনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এতসব চাওয়ার মধ্যে প্রয়োজন ছিল আয়ের নিশ্চয়তা। কিন্তু আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদের সেই আয়ের নিশ্চয়তা কি ছিল সেই করোনাকালীন সময়ে?

তৎকালীন সরকারের নির্বাহী প্রধানের ঐকান্তিক ইচ্ছায় শিক্ষকদের জন্য কিছু ইনসেন্টিভ দেওয়ার ব্যবস্থা করে হয়েছিল। যা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই কম। টানা ছুটির কারণে সারাদেশের কিন্ডারগার্টেনসহ প্রি-প্রাইমারি স্কুলগুলো প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষকরা যারপরনাই কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। এসব কিন্ডারগার্টেন ও প্রি-প্রাইমারি স্কুলগুলো পরিচালনা করার জন্য যেসব বিনিয়োগকারী ছিলেন, তারাও নিঃস্ব প্রায়!

যেসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা সচ্ছল ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা করোনার শুরু থেকেই অর্ধেক বেতনে অনলাইনে শিক্ষকতা করে গেছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই কম। প্রতিটি স্কুলে, ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। যথারীতি শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতনও সেভাবে কর্তৃপক্ষ পায়নি, ফলস্বরূপ শিক্ষকরাও বেতন পুরোপুরি পায়নি। করোনার কারণে আয়ের উপায়গুলোও সংকুচিত হয়েছিল। ফলে অভিভাবক সেইভাবে উপার্জন করতে না পারার কারণে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে কিছুটা উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে।

করোনার থাবা শিক্ষাব্যবস্থায় যে নানা ত্রুটি তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে, আর সেসব ত্রুটি আমাদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনলাইনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিশু-কিশোর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ।

শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো চালিয়ে নিতে পেরেছে কিন্তু প্রান্তিকে সেইভাবে কি পেরেছিল? সব ছাত্রছাত্রীদের কি মোবাইল ফোন সংগ্রহ করার সামর্থ্য ছিল? বৈষম্যের বিভাজনে কোটি প্রাণ কীভাবে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হবে? একটি জেনারেশন কি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে? শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কো-কারিকুলাম, খেলাধুলায় পারঙ্গমতারও রয়েছে অপরিপূর্ণতা। পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ গঠন প্রশ্নের সম্মুখীন।

শিক্ষকদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল ভালো মানের অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার তেমনি প্রয়োজন ছাত্র-ছাত্রীদের। এখানেও ছিল অর্থকষ্টের নানা গল্প-কষ্ট। শুধু মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ কিনলেই হতো না সাথে প্রতি মাসের জন্য নির্ধারিত ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ। আয় যেখানে সংকুচিত সেখানে খরচ কি সংকুচিত থেকেছে?

অনেক অভিভাবকদের কিছু অযৌক্তিক কথামালাও দেখতে পেয়েছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ায়। শিক্ষকরা তো অনলাইনে ক্লাস নেন- উনাদের কেন পূর্ণ বেতন দিতে হবে? আপনাকে ভাবতে হবে অনলাইনে ক্লাস নিলেও শিক্ষকরা আপনার সন্তানের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আপনি অন্যান্য খরচের খাত ঠিক রেখে শিক্ষকদের বেতন দিতে কার্পণ্য করছিলেন। যা কখনোই সুচিন্তিত কর্মের ফল নয়।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে শিক্ষকদের যেকোনো অধিকার বাস্তবায়নের জন্য রাজপথের আন্দোলনকেই বেছে নিতে দেখা গেছে। যা অতি দুঃখজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেখা গেছে শান্তিপূর্ণ শিক্ষকদের মিছিল মিটিং-এ জলকামান, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেটের মাধ্যমে জোরপূর্বক পণ্ড করে দেওয়াই যেন মূল লক্ষ্য। যা অত্যন্ত অমানবিক। অথচ অনেক রাজনৈতিক দলের মিছিলকে সফল করে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঠান্ডা পানির ফোয়ারা ছিটিয়ে দিতেও দেখা গেছে। তা শুধু বৈষম্য নয় অতি অকল্পনীয় ঘটনাও।

শিক্ষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ কারিগর হিসেবে। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষকদের পাশে থাকুন। সন্তানের ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় করবে আপনি কিংবা আমি নই, করবে শিক্ষক। আমার সব শিক্ষক, আমার সন্তানের সব শিক্ষকদের প্রতি সম্মান রেখে জানাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

যেকোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের সম্মান করুন। সর্বাগ্রে শিক্ষকদের প্রাপ্যটুকু দিতে কার্পণ্য করবেন না। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি পূরণে সহায়তা করুন, ফলে মানবিক জাতি গঠনে এর সুফল পাবেন অতি সহজেই।

মো. কামরুল ইসলাম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট