দুর্গতিনাশিনী দুর্গা : দেবী বন্দনা, সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্য
দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা হলেন হিন্দু ধর্মের এক পরাশক্তি যিনি সব ধরনের দুঃখ, কষ্ট, পাপ, ভয় ও অশুভ শক্তির বিনাশ করেন। 'দুর্গা' শব্দের অর্থ যিনি দুর্গ অর্থাৎ দুর্গম স্থানকে অতিক্রম করতে পারেন। পুরাণ অনুযায়ী, 'দুর্গম' নামের এক অসুর ব্রহ্মার কাছ থেকে বর লাভ করে খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দেবতাদের ওপর অত্যাচার করতে শুরু করে। দেবতাদের অনুরোধে, দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হন এবং তাকে বধ করেন।
অসুরকে বধ করার এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই দেবী 'দুর্গা' নামে পরিচিত হন। তিনি জীব ও দেবতাদের দুর্গতি নাশ করেন এবং মানুষকে শুভ পথে চালিত করেন, তাই তিনি 'দুর্গতি-নাশিনী' বা সব দুর্ভাগ্যের বিনাশকারিণী। দুর্গতি বলতে জীবনের সব প্রতিকূলতা, যেমন রোগ, পাপ, ভয়, দুঃখ, দারিদ্র্য এবং অশুভ শক্তির প্রভাবকে বোঝায়।
বিজ্ঞাপন
শরৎকালে অর্থাৎ দক্ষিণায়নে সব দেব-দেবীর মতো দেবী দুর্গা বিষ্ণুমায়ায় নিদ্রিত থাকেন। শারদীয় দুর্গাপূজায় বোধনের মাধ্যমে নিদ্রিত দেবীকে জাগ্রত করা হয়। শরৎকালে অকাল বোধনের দ্বারা দেবীকে জাগ্রত করা হয় বলে দেবী দুর্গার আরেক নাম শারদীয়া এবং শরৎকালের দুর্গাপূজাকে শারদীয় দুর্গাপূজা বলা হয়।
হিন্দু ধর্মে বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন করা হয়। এসব পূজা অর্চনার মাধ্যমে দেবদেবীর সাথে প্রকৃতিকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। তাই দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয় বরং প্রকৃতি এবং প্রাণের একটি বাস্তব প্রতিচ্ছবি। নবপত্রিকাকে কেন্দ্র করে দেবী মহাস্নানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক জল ও অন্যান্য উপাদান (মধু, দুধ, তিলের তেল) ব্যবহার করে প্রকৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
আবার দেবী দুর্গা এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যের জন্য পৃথক পৃথক বাহন রয়েছে। যার অর্থ দেবদেবীর অর্চনার সাথে সাথে দেবদেবীর বাহন তথা প্রাণীদের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেবী দুর্গার বাহন হলো সিংহ। তবে দুর্গাপূজার প্রতি বছর দেবী কোন বাহনে মর্ত্যে আসবেন তা পূর্ব নির্ধারিত থাকে না।
দেবীর আগমন ও গমনের বাহন হিসেবে সাধারণত হাতি, ঘোড়া, নৌকা বা দোলা ব্যবহৃত হয়। এই বাহন পরিবর্তন দেবীর আগমনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। এটি শুভ-অশুভের ইঙ্গিত নির্দেশক। গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্তিকের বাহন ময়ূর, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা এবং সরস্বতীর বাহন হাঁস।
মাটির প্রতিমা, ফুল, ফল, ধান, দুর্বা, কলাপাতা সবই প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত। মাটি ব্যবহার করে দেবীর মূর্তি নির্মাণ করে তাতে দেবীকে কল্পনা করা হয়। ভক্তরা মাটির মূর্তির মাঝেই সাকার রূপী দেবদেবীকে পূজা করে থাকেন। মাটিকে জীবনের আধার মনে করা হয়।
পূজার উপকরণ ও রীতিতে বন্যপ্রাণী ও গাছপালা সংরক্ষণের ইঙ্গিত বহন করে। যেমন তুলসী, বেল, বট এবং অশ্বত্থসহ অনেক বৃক্ষকে পবিত্র মনে করা হয়। এর মাধ্যমে তাদের সংরক্ষণ করা হয়। শরতের শিউলি আর দেবীর আগমনী বার্তা যেন একে অপরের পরিপূরক। শিউলি ফুল ছাড়া দুর্গাপূজা একেবারেই অকল্পনীয়। সেজন্য হিন্দু বাড়িতে শিউলি গাছ দেখা যায়।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেবীকে আবাহন করা হয়, যা সাধারণত মহালয়ার দিনে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে শুরু হয়। মহালয়া হলো পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরুর মধ্যবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের স্মরণ করে তর্পণ করা হয়।
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হলো দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত প্রধান হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। এটি বাংলা বর্ষপঞ্জির আশ্বিন ও কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এবারের দুর্গাপূজা আশ্বিন মাসে হচ্ছে। এবছর দেবী দুর্গা হাতির পিঠে চড়ে মর্ত্যে আগমন করবেন এবং দোলায় অর্থাৎ পালকিতে গমন করবেন।
দেবীর গজে আগমন সমগ্র বিশ্বজুড়ে শান্তি, সমৃদ্ধি ও শস্য-শ্যামলা বসুন্ধরার প্রতীক। অন্যদিকে দোলায় গমন মহামারির ইঙ্গিত বহন করে। দুর্গাপূজা সাধারণত পাঁচ দিনের একটি ধর্মীয় উৎসব। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে ‘দুর্গাষষ্ঠী’, ‘দুর্গাসপ্তমী’, ‘মহাষ্টমী’, ‘মহানবমী’ ও ‘বিজয়াদশমী’ নামে পরিচিত।
দুর্গাষষ্ঠী: দুর্গাষষ্ঠী হলো দুর্গাপূজার প্রথম দিন, যা নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে দেবী দুর্গার অকাল বোধন করা হয় এবং কল্পারম্ভ দিয়ে মূল উৎসবের সূচনা করা হয়। বোধন মানে জাগরণ বা উদ্বোধন। দুর্গাপূজার শুরুতে ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গাকে আহ্বান করে যে পূজা করা হয়, তাকে বোধন বা অকাল বোধন বলা হয়।
এটি দুর্গাপূজার প্রথম আনুষ্ঠানিক সূচনা, যেখানে দেবীকে মূর্তিরূপে স্থাপন করে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে পূজার কাজ শুরু করা হয়। যেহেতু এটি অকালে (অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের বাইরে) করা হয়েছিল, তাই এটিকে 'অকাল বোধন' বলা হয়। কিংবদন্তী অনুসারে, রামচন্দ্র যখন দেবীর বোধন করেন, তখন ব্রহ্মা পরামর্শ দিয়েছিলেন যে দেবীর জাগরণের জন্য বেল গাছের প্রয়োজন হবে। দেবীর আরাধনায় বেল গাছের বিশেষ গুরুত্ব ও ওষধি গুণের কারণে এবং দেবীর জাগরণকে সম্মান জানানোর জন্য বেল গাছের নিচে বোধন পূজা করা হয়।
শরৎকালে অর্থাৎ দক্ষিণায়নে সব দেব-দেবীর মতো দেবী দুর্গা বিষ্ণুমায়ায় নিদ্রিত থাকেন। শারদীয় দুর্গাপূজায় বোধনের মাধ্যমে নিদ্রিত দেবীকে জাগ্রত করা হয়। শরৎকালে অকাল বোধনের দ্বারা দেবীকে জাগ্রত করা হয় বলে দেবী দুর্গার আরেক নাম শারদীয়া এবং শরৎকালের দুর্গাপূজাকে শারদীয় দুর্গাপূজা বলা হয়।
বেল গাছ দেবী দুর্গার নবপত্রিকা-র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই আবাহনের মাধ্যমে দেবীকে মর্ত্যে স্বাগত জানানো হয়। ষষ্ঠীর দিন থেকে পরবর্তী চার দিন সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং বিজয়া দশমী অনুষ্ঠিত হয়, যা দুর্গাপূজার মূল অংশ। বাঙালি নারীরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই দিন ষষ্ঠী দেবীর পূজা করেন। ষষ্ঠী দেবী দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অংশ হিসেবে বিবেচিত হন এবং তিনি সন্তান ও প্রজননের দেবী হিসেবে পূজিত হন।
দুর্গাসপ্তমী: দুর্গাসপ্তমী হলো দুর্গাপূজার দ্বিতীয় দিন। এই দিনে ভক্তরা দেবী দুর্গার উদ্দেশে আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, ধূপ ও দীপ নিবেদন করেন। দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপে গেলে গণেশের পাশে লাল পাড় সাদা শাড়িতে ঘোমটা দেওয়া একটি কলাগাছ দেখা যায়। অনেকেই একে কলাবউ ও গণেশের স্ত্রী বলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি গণেশের স্ত্রী নয়।
এটি মা দুর্গা অর্থাৎ গণেশের জননী এবং নবপত্রিকার অংশ। নবপত্রিকার আক্ষরিক অর্থ বোঝায় নয়টি পাতা। কিন্তু এখানে নয়টি উদ্ভিদ দিয়ে নবপত্রিকা গঠন করা হয়। এই নয়টি উদ্ভিদ মা দুর্গার নয়টি শক্তির প্রতীক। এই নয়টি উদ্ভিদ হলো—কদলী বা রম্ভা (কলাগাছ), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মান ও ধান।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে সাদা অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে দুর্গা ও গণেশের ডানপাশে রাখা হয়। দুর্গাপূজায় দেবীর মহাস্নান সাধারণত মহাসপ্তমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়, যার আগে নবপত্রিকা বা কলাবউকে স্নান করানো হয়।
এই স্নানে দেবীর বিশ্বরূপা রূপকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করা হয়। স্নানে তিলের তেল, বিষ্ণু-তেল, দুধ, দই, ঘি, মধু, ডাবের জল ও ইক্ষুরস সহ বিভিন্ন পবিত্র জিনিস ব্যবহার করা হয়। মহাস্নানের পর জলকে চরণামৃত রূপে ভক্তরা পান করেন। দুর্গাপূজার সময় অনেক ভক্তই দেবীর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা জানাতে উপবাস পালন করেন।
পূজা শেষে অঞ্জলি দেওয়া হয় এবং চরণামৃত গ্রহণের মাধ্যমে উপবাসের সমাপ্তি ঘটে। দুর্গাসপ্তমী কেবল একটি আনুষ্ঠানিক উৎসবই নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনে দেবী দুর্গা ভক্তদের কাছে শক্তি নিয়ে উপস্থিত হন এবং মণ্ডপগুলোয় ভক্তদের সমাগম ঘটে।
দুর্গাষ্টমী: শারদীয় দুর্গাপূজার তৃতীয় দিন হলো অষ্টমী পূজা, যা দুর্গাষ্টমী নামেও পরিচিত। এই দিনে দেবী দুর্গার পূজা করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয় উদযাপন করা হয় এবং দেবী দুর্গার মহিমাকে স্মরণ করা হয়। দেবী দুর্গার মহিষাসুর নামক অসুরকে বধ করার বিজয়কে উদযাপন করার দিন।
মহিষাসুর ছিলেন একজন বলশালী ও পরাক্রমশালী অসুর রাজা, যিনি হিন্দু পুরাণে দেবী দুর্গার হাতে পরাজিত হন। তিনি মূলত মহিষের রূপ ধারণ করতেন এবং মানবজাতির ওপর অত্যাচার চালাতেন, যার ফলে দেবতারা একত্রিত হয়ে দেবী দুর্গার রূপে তাঁর বিনাশ ঘটান। দেবী দুর্গা তাঁকে বধ করার পর মহিষাসুরমর্দিনী নামে পরিচিত হন।
আরও পড়ুন
এই ঘটনাটি হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিতে দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপে মহিমামণ্ডিত হওয়ার প্রতীক। এটি অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক। প্রবল পরাক্রমশালী মহিষাসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা মহাজাগতিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। অষ্টমীর অন্যতম প্রধান আচার হলো সন্ধিপূজা ও কুমারী পূজা। এই দিন ভক্তরা নির্জলা উপবাস থেকে অঞ্জলি প্রদানের মাধ্যমে দেবীর প্রতি তাদের ভক্তি নিবেদন করেন। অষ্টমীতে ভক্তরা নারী শক্তি, অর্থাৎ দেবী দুর্গার ঐশ্বরিক শক্তির আরাধনা করেন। এই শক্তি সাহস, সমৃদ্ধি এবং সুরক্ষা প্রদান করে।
সন্ধিপূজা এবং কুমারী পূজা: অষ্টমীর সমাপ্তি এবং মহানবমীর শুরুর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এটি অষ্টমী ও নবমীর সংযোগস্থলে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ পূজা। সন্ধিপূজা হলো দুর্গাপূজার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমীর প্রথম ২৪ মিনিটের সন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত হয়।
এই পূজায় দেবী দুর্গাকে চামুণ্ডা রূপে পূজা করা হয়, কারণ এই সময়ে তিনি চণ্ড ও মুণ্ড নামের দুই অসুরকে বধ করেছিলেন। এই সময়কালকে তন্ত্রমতে একটি বিশেষ পবিত্র সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। সন্ধিপূজার মাহাত্ম্য হলো এটি অত্যন্ত শুভ ও ফলপ্রসূ সময়, যখন অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। পুরাণ অনুসারে, অষ্টমী ও নবমীর এই সন্ধিক্ষণের পূজা এক বছরের পূজার সমতুল্য ফল দেয়।
দেবীশক্তির প্রতীক হিসেবে পদ্ম ফুল অপরিহার্য। বিশেষ করে সন্ধিপূজায় দেবীর চরণে ১০৮টি পদ্ম অর্পণের রীতি রয়েছে। কথিত আছে যে, রামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকাল বোধন করার সময় দেবীর চরণে ১০৮টি নীল পদ্ম নিবেদন করেছিলেন। দেবী পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রামের ভক্তি দেখে খুশী হয়ে পূজা গ্রহণ করে তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন।
এই ঘটনা রামায়ণে বর্ণিত আছে। তাই ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, পদ্ম নিবেদনে মনস্কামনা পূরণ হয় এবং দেবীর আশীর্বাদ লাভ করা যায়। পাশাপাশি পদ্মকে পবিত্রতা, জ্ঞান ও সমৃদ্ধির প্রতীক মনে করা হয় এবং দুর্গা পূজার আচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কুমারী পূজায় দেবী দুর্গার নয়টি রূপকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এক থেকে ষোল বছর বয়সী অবিবাহিত কুমারী মেয়েদের দেবী জ্ঞানে পূজা করা হয়। এটি স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে প্রথম প্রবর্তিত হয়। এই দিনে কুমারী মেয়েদের দেবী দুর্গার প্রতিমূর্তি হিসেবে সম্মান জানানো হয়।
কুমারী পূজার প্রধান মাহাত্ম্য হলো দেবীর মধ্যে নারীশক্তির প্রকাশকে উপাসনা করা। এই পূজার মাধ্যমে ত্রিদেবী অর্থাৎ দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী প্রসন্ন হন এবং ভক্তদের বর প্রদান করেন বলে মনে করা হয়। শাস্ত্রমতে, কুমারী পূজার মাধ্যমে দেবী দুর্গা এতটাই প্রসন্ন হন যে, যজ্ঞ ও দান-ধ্যানের চেয়েও বেশি সন্তুষ্টি লাভ করেন।
দুর্গাপূজা বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় উৎসব, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাঙালি সমাজে অসাম্প্রদায়িক ও প্রীতিময় আনন্দ উৎসব হিসেবে পালিত হয়। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয় বরং সামাজিক সম্প্রীতি, ঐতিহ্য ও বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির এক অনুপম মেলবন্ধন।
দুর্গানবমী: নবমী বা দুর্গানবমী দুর্গাপূজার চতুর্থ দিন। এই দিনে দেবী সিদ্ধিদাত্রীর পূজা, বলিদান ও নবমী হোম অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডপে-মণ্ডপে ভক্তদের বিশেষ ভিড় দেখা যায়। নবমী পূজার প্রধান মাহাত্ম্য হলো এই দিনে দেবী দুর্গার কৃপা ও আশীর্বাদ লাভের মাধ্যমে সব মনস্কামনা পূরণ হয়।
এই দিনে দেবী দুর্গাকে চণ্ডিকা রূপে আরাধনা করা হয়। এটি আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নয় রাত্রি ধরে দেবীর নয়টি রূপের আরাধনা। নবমীর দিনটি দেবীর আরাধনার সমাপ্তি এবং নবমী হিসেবে পালিত হয়, যেখানে দেবীকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজা করা হয়।
এই ব্রতের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কৃপা লাভ করা যায় এবং মানবজীবনে সম্পদ ও সমৃদ্ধি আসে। যখন দেবী দুর্গার বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করে এবং ভক্তদের জন্য দেবীকে প্রাণভরে দেখে নেওয়ার শেষ সুযোগ থাকে। এরপরই আসে বিজয়া দশমী, যখন দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
বিজয়া দশমী: দুর্গোৎসবের শেষ বা বিজয়া দশমী মূলত দেবী দুর্গার কৈলাসে ফিরে যাওয়ার দিন। বিজয়া দশমী হলো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক, যা দুর্গা ও রাম উভয়েরই আখ্যানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। দশমী তিথিতে সকালে পূজা শেষে দেবীর দর্পণ বিসর্জন হয়। দর্পণ বিসর্জন হলো দুর্গাপূজা উৎসবের একটি আনুষ্ঠানিকতা, যেখানে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের আগে একটি আয়না জলে ডুবিয়ে দেবীর প্রতীকী বিদায় জানানো হয়।
এর মাধ্যমে একদিকে পূজার শাস্ত্রীয় আয়োজন শেষ হয় এবং অন্যদিকে দেবীর প্রতিমাকে বিদায় জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। দর্পণ বিসর্জনের পর এবং প্রতিমা বিসর্জনের আগে কলা বউয়ের বিসর্জন হয়। বিজয়া দশমীর সিঁদুর দান, যা সিঁদুর খেলা নামে পরিচিত, দুর্গাপূজার সমাপ্তি উপলক্ষে বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে একাত্মতা ও সৌভাগ্য প্রকাশ করার একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি।
এই অনুষ্ঠানে মহিলারা প্রথমে দেবীর প্রতিমা বা প্রতিমার সিঁথিতে ও পায়ে সিঁদুর ও মিষ্টি দিয়ে দেবীকে বিদায় জানান এবং তারপর একে অপরের মুখে সিঁদুর লাগিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় ও সৌভাগ্য কামনা করেন।
প্রতিমা বিসর্জনের সময় নানা রকম শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়, যেখানে প্রতিমাগুলি বিসর্জনের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্গাপূজার সমাপ্তি হিসেবে দেবীর প্রতিমা নদী, পুকুর বা সাগরে বিসর্জন দেওয়া হয়। ‘আসছে বছর আবার হবে’ উচ্চারণের মাধ্যমে দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয়।
এর মাধ্যমে মর্ত্যে শান্তি স্থাপন করে দেবী দুর্গা তাঁর পিতৃ গৃহে পাঁচ দিনের উৎসব শেষে কৈলাসে স্বামী গৃহে ফিরে যান। এই দিন শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে একে অপরের সাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার রীতি রয়েছে। এই শুভেচ্ছা বিনিময় ‘বিজয়া’ নামে পরিচিত, যেখানে ‘আসছে বছর আবার হবে’ এই কথাটি বলা হয়।
বিজয়া দশমীর দিন সকলে অথবা পরের দিনও একে অপরের বাড়িতে গিয়ে মিষ্টিমুখ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয় এবং ‘শুভ বিজয়া’ বলে একে অপরের প্রতি মঙ্গল কামনা করা হয়।
দুর্গাপূজা বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় উৎসব, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাঙালি সমাজে অসাম্প্রদায়িক ও প্রীতিময় আনন্দ উৎসব হিসেবে পালিত হয়। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয় বরং সামাজিক সম্প্রীতি, ঐতিহ্য ও বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির এক অনুপম মেলবন্ধন।
স্বামী বিবেকানন্দের উক্তি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। জীবের প্রতি ভালোবাসা ও সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই পূজা অর্চনার এই চিরায়ত সংস্কৃতির সাথে সাথে প্রকৃতির প্রেমে নিবিষ্ট হতে হবে।
হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে আমাদের এক হাতে থাকবে ধর্ম আর অন্য হাতে থাকবে প্রকৃতি প্রেম। তাহলেই পূজার মূল উদ্দেশ্য সাধিত হবে। বর্তমান অস্থির সমাজে দুর্গাপূজার মাধ্যমে শান্তির বাতায়ন খুলে যাক—দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার নিকট এই প্রার্থনা রইল।
জয় হোক সত্যের, জয় হোক মানবতার।
শুভ বিজয়া!
ড. মিহির লাল সাহা : অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ ও সাবেক প্রাধ্যক্ষ, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়