অ্যানথ্রাক্স কি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়?
বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স (Anthrax) রোগটি একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। এটি ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ যা মূলত গবাদিপশুকে (গরু, ছাগল, ভেড়া এবং মহিষ) আক্রান্ত করে। তবে মানুষও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। ১৯৫০-এর দশক থেকে এই রোগের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের দিকে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া এবং মানিকগঞ্জ জেলায় এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
সেই সময়ে গবাদিপশু এবং মানুষ উভয়ই বেশি সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছিল যা তখন জনমনে অত্যন্ত ভীতি সৃষ্টি করেছিল। এরপর থেকে সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
বর্তমানে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে এটি সম্পূর্ণ নির্মূল হয়নি। প্রতি বছর বিশেষত বর্ষাকালে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে যখন গবাদিপশু এবং মানুষের মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সম্মিলিতভাবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। নির্দিষ্ট এলাকাগুলোয় গবাদিপশুর টিকা প্রদান, আক্রান্ত পশুর মাংস বিক্রি বন্ধ করা এবং জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমেও এই রোগ মোকাবিলার চেষ্টা চলছে।
২০২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে অন্তত ৫০ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে জানা যায়। এই ঘটনার পর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (IEDCR) পীরগাছায় তদন্ত শুরু করে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করে।
অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মাটিতে সুপ্ত অবস্থায় বা স্পোর হিসেবে বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে। যখন কোনো প্রাণী কোনোকিছুর সাথে এই স্পোরযুক্ত মাটি খায় বা শ্বাস নেয় তখন তারা আক্রান্ত হয়।
এটি মূলত একটি জুনোটিক রোগ (Zoonotic Disease) যা আক্রান্ত প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত, মল বা অন্যান্য শারীরিক তরলের মাধ্যমে এই স্পোর ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানুষ এই সংক্রমিত প্রাণীর মাংস, চামড়া বা পশম, বর্জ্য স্পর্শ করলে বা কাঁচা মাংস খেলে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে।
অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মাটিতে সুপ্ত অবস্থায় বা স্পোর হিসেবে বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে। যখন কোনো প্রাণী কোনোকিছুর সাথে এই স্পোরযুক্ত মাটি খায় বা শ্বাস নেয় তখন তারা আক্রান্ত হয়।
তবে অ্যানথ্রাক্স মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। সংক্রমণের জন্য সরাসরি স্পোরের সংস্পর্শে আসতে হয়। যারা পশুসম্পদ নিয়ে কাজ করেন (কৃষক, কসাই এবং পশুপালক) তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
অ্যানথ্রাক্স চার ধরনের হতে পারে যা সংক্রমণের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। তবে ধরন অনুযায়ী উপসর্গ ভিন্ন হয়।
১। ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্স (Cutaneous Anthrax)
২। শ্বসনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স (Inhalation Anthrax)
৩। পাকস্থলীর অ্যানথ্রাক্স (Gastrointestinal Anthrax)
৪। ইনজেকশন অ্যানথ্রাক্স (Injection Anthrax)
১। ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্স (Cutaneous Anthrax): এটি সবচেয়ে সাধারণ। ত্বকের ক্ষত দিয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে এই রোগ হয়। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর মাংস কাটা, চামড়া ছাড়ানো বা তার সংস্পর্শে আসলে জীবাণু ত্বকের কাটা বা ক্ষতের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে, তখন এই সংক্রমণ হয়। আক্রান্ত স্থানে প্রথমে একটি লাল ফোস্কা দেখা যায় যা পরে কালো হয়ে যায়। এই ধরনের অ্যানথ্রাক্স সাধারণত প্রাণঘাতী নয়।
আরও পড়ুন
২। শ্বসনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স (Inhalation Anthrax): এটি মারাত্মক প্রকার। এই ক্ষেত্রে মানুষ অ্যানথ্রাক্স স্পোরযুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলে এই রোগ হতে পারে। সাধারণত এমনটা হয় যখন পশম বা চামড়ার কারখানায় কাজ করা হয় যেখানে সংক্রমিত পশুর চামড়া থেকে স্পোর বাতাসে মিশে যায়। একে ‘উল সোর্টারস ডিজিজ (Wool sorter's disease)’ বলা হয়।
অ্যানথ্রাক্সের স্পোর নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করলে প্রাথমিক উপসর্গগুলো সাধারণ সর্দি বা ফ্লুর মতো হলেও, দ্রুত শ্বাসকষ্ট এবং শকের মতো মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। এটি প্রায়শই প্রাণঘাতী।
৩। পাকস্থলীর অ্যানথ্রাক্স (Gastrointestinal Anthrax): অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণীর মাংস ভালোভাবে না রান্না করে খেলে এই ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। এই ধরনের অ্যানথ্রাক্স খুব বিরল হলেও এটি গুরুতর অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত বমি, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা এবং জ্বর নিয়ে রোগী হাসপাতালে আসে। যদি সময় মতো চিকিৎসা না করা হয় তবে যে কোনো সময় এটাও মারাত্মক হতে পারে।
৪। ইনজেকশন অ্যানথ্রাক্স (Injection Anthrax): নতুন আবিষ্কৃত একটি প্রকার যা সাধারণত মাদকদ্রব্য সেবনকারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। দূষিত সূচ ব্যবহার করলে এই রোগ হয়। আক্রান্ত স্থানে ফোলা ও লালচে ভাব দেখা যায়।
অ্যানথ্রাক্স রোগ নির্ণয়ের জন্য সাধারণত রোগীর রক্ত পরীক্ষা, ত্বক পরীক্ষা (বায়োপসি) এবং বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান করা হয়। এছাড়াও মেরুদণ্ডের ফ্লুইড বা স্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষাও করা যেতে পারে। তবে এটি নির্ভর করে রোগের ধরনের ওপর।
অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত কারণ রোগ নির্ণয়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শুরু করার আগে নমুনা সংগ্রহ করা উচিত।
অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত কারণ রোগ নির্ণয়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শুরু করার আগে নমুনা সংগ্রহ করা উচিত।
অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে করা হয়। রোগ নির্ণয় যত দ্রুত হয় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। সিপ্রোফ্লক্সাসিন, ডক্সিসাইক্লিন এবং পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে শিরায় অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়।
কখনো কখনো এই জীবাণু এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধীও হয়ে ওঠে। তখন সঠিক চিকিৎসা করা খুব সমস্যা হয়ে যায়। তবে সময় মতো চিকিৎসা না হলে অ্যানথ্রাক্স মস্তিষ্কের প্রদাহ (মেনিনজাইটিস), রক্তে সংক্রমণ (সেপসিস) এবং শকের মতো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে যা প্রায়শই মৃত্যুর কারণ হয়।
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ খুব কঠিন কিছু না। তবে সচেতন থেকে নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে বিশেষ করে যাদের ঝুঁকি বেশি। এরমধ্যে গবাদিপশুকে নিয়মিত অ্যানথ্রাক্স টিকা দেওয়া সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
সোশ্যাল মিডিয়া, পোষ্টার, মাইকিং এবং বিভিন্ন এনজিওগুলোর মাধ্যমে কৃষক, কসাই এবং সাধারণ জনগণকে অ্যানথ্রাক্স সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি। সংক্রমিত পশুর সংস্পর্শে আসার আগে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা উচিত এবং স্পর্শ করার পরে হাত সাবান পানি দিয়ে নিয়মমতো ৩০-৪০ সেকেন্ড ধরে ধুতে হবে।
এছাড়া যদি কোনো পশু অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয় তবে তার মাংস খাওয়া বা বিক্রি করা যাবে না। মৃত পশুকে পুড়িয়ে বা গভীর মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।
আশা করা যায় এই রোগ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা থাকলে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ডা. রাজীব কুমার সাহা : এমবিবিএস, এমআরসিপি (ইউকে), এমসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (বক্ষব্যাধি), মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারভেনশনাল পালমনোলজিস্ট, কনসালট্যান্ট-রেসপিরেটরি মেডিসিন, আজগর আলী হাসপাতাল
saha.ssmc@yahoo.com