সোশ্যাল মিডিয়া কি আমাদের সময়, সৃজনশীলতা, সক্ষমতা গিলে খাচ্ছে?
কানাডিয়ান গণযোগাযোগ তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহান (Marshall McLuhan) গত শতকের ৬০-এর দশকে বিশ্বগ্রাম ধারণাটি প্রকাশ করে আলোড়ন তৈরি করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত আন্ডারস্ট্যান্ডিং মিডিয়া দ্য এক্সটেনশন অফ ম্যান (Understanding Media: The Extensions of Man) গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছিলেন প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ গোটা দুনিয়াকে একটি গ্রামে পরিণত করেছে। যেখানে সবাই খুব কাছাকাছি বাস করেন, সবাই পড়শি।
প্রযুক্তির এই বিকাশ এখনো চলমান। ২০২৫ সালে মার্শাল ম্যাকলুহান (ম্যাকলুহানের মৃত্যু ১৯৮০ সালে) বেঁচে থাকলে হয়তো নতুন তত্ত্ব হাজির করতে বাধ্য হতেন। কারণ বর্তমানে ইন্টারনেট সংযোগ ও স্মার্টফোনের এই বিশ্ব এখনো চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। স্মার্ট ডিভাইসের ছোট্ট পর্দায়। পৃথিবী এখন আরও সংকুচিত, আরও কাছাকাছি। যেখানে পৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষের সাথে অপর প্রান্তের মানুষকে মুহূর্তে যুক্ত করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
বিজ্ঞাপন
প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য বিকাশের এই যুগকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কাল বললে ভুল হবে না। একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। উইআরসোশ্যাল (wearesocial) নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল ২০২৪: ৫ বিলিয়ন সোশ্যাল মিডিয়া ইউজার (DIGITAL 2024: 5 BILLION SOCIAL MEDIA USERS) শিরোনামের একটি পরিসংখ্যান ভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে ৮০০ কোটির বেশি (৮.০৮ বিলিয়ন) মানুষ বাস করেন যাদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ৫৬১ কোটি (৫.৬১ বিলিয়ন) মানুষ।
যার অর্থ হচ্ছে, বর্তমান পৃথিবীতে ৬৯. ৪ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। আর বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ৫৩৫ কোটি (৫.৩৫ বিলিয়ন) মানুষ। রিপোর্ট প্রকাশের আগেরবারের সাথে তুলনা করলে এই হার বেড়েছে প্রায় ১০০ কোটি (৯৭ মিলিয়ন)। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০০ কোটির (৫.০৪ বিলিয়ন) বেশি মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে যুক্ত। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বে মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন।
বিজ্ঞাপন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই সর্বগ্রাসী আধিপত্য মানুষে মানুষে অভূতপূর্ব দ্রুত যোগাযোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে তৈরি হয়েছে নতুন ঝুঁকি। যার সাথে যুদ্ধ করতে করতে সারাবিশ্বের মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে প্রাণঘাতী ধ্বংসাত্মক ঘটনা। মানুষে মননে, মগজে ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। একটু বিস্তারিত গবেষণাভিত্তিক তথ্য উপাত্তে আসা যাক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বলা হয় নতুন প্রজন্মের মাধ্যম। অর্থাৎ শিশু, তরুণ, যুবকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের উন্মাদনা বেশি। তাই বিশ্বের নানা প্রান্তে তরুণদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বেশি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক দপ্তর ও বিশ্বখ্যাত পিউ রিসার্চ সেন্টার (Pew Research Center) ইউরোপের শিশুদের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা সম্পন্ন করেছে। টিনস, স্ক্রিনস ও মেন্টাল হেলথ (Teens, screens and mental health) শিরোনামের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনে এক জন কিশোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সমস্যায় ভুগছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই সর্বগ্রাসী আধিপত্য মানুষে মানুষে অভূতপূর্ব দ্রুত যোগাযোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে তৈরি হয়েছে নতুন ঝুঁকি। যার সাথে যুদ্ধ করতে করতে সারাবিশ্বের মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন।
আর কিশোরীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা কয়েক গুণ বেশি। এছাড়া ৩৬ শতাংশ তরুণ সবসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুদের যুক্ত (constant contact with friends) থাকার তাড়না বোধ করেন। এছাড়া ৩৪ শতাংশ তরুণ অনলাইনে গেইমে যুক্ত থাকেন যাদের মধ্যে সমস্যাপূর্ণ আচরণ অনেক প্রকট।
এ তো গেল সমাজের শিশু-কিশোর-তরুণদের অনলাইনে যুক্ত থাকার মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রভাব নিয়ে সামান্য আলোচনা। কিন্তু এর বাইরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি সর্বগ্রাহী রূপ এরমধ্যে বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে। যাতে কমছে মানুষে সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতা।
আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের টিনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্লেন রেনল্ডস (Glenn Reynolds) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান (Social Media Upheaval, 2019) শিরোনামের এক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাতে তিনি নানা তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে দেখিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষকে অথর্ব, রাগী ও আসক্ত (dumb, angry and addicted) করে তুলছে। যা বিশ্ববাসীকে সৃজনশীলতা থেকে দূরে সরিয়ে অথবা হিসেবে গড়ে তুলছে।
এখন অনেকেই আর ঠাণ্ডা বা গরম পানীয় সাথে বইয়ের পাতায় মনসংযোগ করতে চান না বা পারেন না। অনেকেই আর দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তরের সামনে রং তুলি হাতে সাদা ক্যানভাসে রংয়ের খেলা খেলতে আগ্রহী হন না। দুটো কবিতার লাইন লেখা, একটা গানের লাইনে সুরারোপ এমনকি সমালোচক দৃষ্টিভঙ্গিতে কেউ আর ইতিহাসের কোনো অধ্যায় পড়তে আগ্রহী হন না। এর বিপরীতে মানুষের ব্যস্ততা এখন লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট ঘিরে।
আসক্তি, মানসিক স্বাস্থ্য ও ভার্চুয়াল জগতের মায়াবী আহ্বান
এক সময় বিশ্বে কোকেইন ও হিরোইনের আসক্তি নিয়ে বেশ আলোচনা হতো। যে আলোচনার জায়গা এখন অনেকটা দখল করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গোটা বিশ্বের নানা প্রান্তে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে এই আসক্তি শুধু মানুষের কর্মক্ষমতাই হ্রাস করছে না, তৈরি করছে মারাত্মক সব স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ঘুমে ব্যাঘাত (Sleep Deprivation), পৃথিবীর বাস্তবতা অনুধাবনে অক্ষমতা (Neglect for Real-World Obligations), পড়াশোনা (Academics), ব্যক্তিগত সম্পর্ক (Relationships), নিজেকে সুন্দর দেখানোর প্রতিযোগিতা (Body Image Issues), নিজের ক্ষতি সাধান বা নিজেকে শাস্তি দেওয়া (Self-Harm), অবসাদ (Depression), উদ্বেগ (Anxiety), এমনকি আত্মহত্যা (Suicide)—এই সবকিছুই ঘটছে বাস্তবিক পৃথিবীর বাইরে অধিক সময় ভার্চুয়াল জগতে বসবাসের কারণে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বলা হয় নতুন প্রজন্মের মাধ্যম। অর্থাৎ শিশু, তরুণ, যুবকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের উন্মাদনা বেশি। তাই বিশ্বের নানা প্রান্তে তরুণদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বেশি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে...
একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক বাংলাদেশের দিকে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ডাটা রির্পোটাল (DataReportal – Global Digital Insights)-এর প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশে সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২৯ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ।
এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিদিন কত ঘণ্টা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকেন তা নির্ধারিত না হলেও ধারণা করা হয় এই হার গড়ে ৩ ঘণ্টার কম নয়। বিপুল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের উৎপাদন কাজে মনোযোগ না দিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটানো উৎপাদন ও সৃজনশীলতার জন্য যে বড় হুমকি তা বলাইবাহুল্য। যার প্রতিফলন এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়।
সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের পাঠ অভ্যাস কমে গেছে, সৃজনশীলতা কমে গেছে, বিপরীতে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও শ্রদ্ধাবোধ। যা ধীরে ধীরে বাংলাদেশেকে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। এই বিপর্যয় ঠেকাতে সতর্ক হওয়া, কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি।
সহায়ক:-
১। DIGITAL 2024: 5 BILLION SOCIAL MEDIA USERS, Retrieved on: 27th September 2025 https://wearesocial.com/uk/blog/2024/01/digital-2024-5-billion-social-media-users/
২। Teens, screens and mental health, Retrieved on: 27th September 2025 https://www.who.int/europe/news/item/25-09-2024-teens--screens-and-mental-health
৩। Digital 2024: Bangladesh, By DataReportal – Global Digital Insights, Retrieved on: 27th September 2025, https://datareportal.com/reports/digital-2024-bangladesh
রাহাত মিনহাজ : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়