কেমন দেশে বাস করছি আমরা? খবর শুনলেই রক্তচাপ বাড়ে। পত্রিকার শিরোনাম দেখলেই হাইপ্রেসার বাড়ে। শিরোনামগুলো এমন, ‘মাদকে ভেজাল: বিষের মধ্যেও ভয়ংকর বিষ’; ‘নিম্নমানের ভেজাল ও নিষিদ্ধ ওষুধ!’ মাদকেও ভেজাল; ওষুধেও ভেজাল। কোনটাই সুখকর নয়। ভাবা যায় প্রাণ রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল! ওষুধে ভেজালের সংবাদ জনমনে শঙ্কা তৈরি করে। আর মাদকতো এমনিতেই আমাদের দৃষ্টিতে বিষ তাতেও ভেজাল হলে উপায় কী! উপরের সংবাদগুলো আমাদের অনেক বেশি ভাবিয়ে তুলে বৈকি!

বাজারে সয়লাব ভেজাল, নিম্নমান ও নিষিদ্ধ ওষুধে। কিছুতেই ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। একের পর এক ভেজাল ওষুধ ধরা পড়ছে। শুধু তাই নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির ঘটনাও ঘটছে। আর নিষিদ্ধ ও অপরীক্ষিত অনেক বিদেশি ওষুধ দেশে এনে নতুনভাবে প্যাকেটজাত করে তা বিক্রি করা হচ্ছে।

সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, ওষুধ বিশেষজ্ঞ অনেক ব্যক্তির পক্ষেও এসব ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ শনাক্ত করা সম্ভব না। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওষুধের উৎপাদন, মজুদ, বিক্রয়, বিতরণ ও বিপণন স্থগিত করেই দায়িত্ব শেষ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তাদের কোনো মনিটরিং কার্যক্রম নেই।

দেশে বর্তমানে ১৫৪টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশই নিম্নমানের ওষুধ বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের আবেদন করেই ওষুধ প্রস্তুত করে চলেছে। ওষুধের মান নির্ণয় করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তিশালী ল্যাব নেই। এতে চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে দেশের জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা।

মাদকের কথা আর কী বলব? আমরা জানি ধ্বংসের অপর নাম মাদক। তার উপর সেই মাদক যদি হয় ভেজাল, তাহলে তো আর কথাই নেই। ভেজাল মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে দেশের বাজারগুলো। ভেজালের কারণে আরও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে মাদকও। আর এসব সেবনে জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। মাদক সেবনে মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ছে যুব সমাজ।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর দেশের চারটি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ছ'টি ওষুধের উৎপাদন, মজুদ, বিক্রি, বিতরণ ও বিপণন স্থগিত করেছে এর আগে। এসব ওষুধ এখনো বাজারে মিলছে।

ভেজাল পরিহার করতে মাদকসেবীরা বারবার পরিবর্তন করছে মাদক। কিন্তু তাতেও ভেজাল পরিহার করতে পারছে না তারা। ফলে মাদকসেবীরা বিকল্প হিসেবে ঝুঁকে পড়ছে হেরোইন, ফেনসিডিলের দিকে। হেরোইন সেবনকারীরা দ্রুতই বিকল্প হিসেবে ইয়াবাকে বেছে নিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অতি লোভী একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে মাদকে ভেজাল মেশাচ্ছে। দেশের মাদকসেবীদের একটি অংশ এখন ব্যাপক হারে ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

ইয়াবা এমন একটি মাদক, যা মানুষকে শুধু মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না, মৃত্যুর আগেই ওই মাদক সেবনকারীকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে। অথচ প্রাথমিকভাবে সেবনকারী বা তার আত্মীয়দের কেউ তা বুঝতেই পারেন না। দীর্ঘদিন ইয়াবা সেবনকারী ব্যক্তি বাবা-মাকে শত্রু মনে করতে থাকে, এমনকি এক সময় নিজেকেই শত্রু ভাবতে শুরু করে। সে তখন শব্দ না হলেও শব্দ শুনতে পায় এবং কেউ উপস্থিত না থাকলেও কারো উপস্থিতি অনুভব করে। তার সামনে কোনো ছবি টাঙানো থাকলে সে মনে করে ওই ছবি তাকে হত্যা করবে। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না সে। এমনকি নিজেকেও না।

মাদকদ্রব্যে ভেজালের কারণে মাদকসেবীদের মধ্যে ভয়ংকর সব পরিবর্তন ঘটছে। ভেজাল মাদক সেবন করায় নতুন নতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক আগে থেকে দেশে মাদকের প্রচলন থাকলেও মূলত আশির দশকে নারকোটিকস জাতীয় ড্রাগের অনুপ্রবেশের পর থেকে মাদক সমস্যা ব্যাপকতা লাভ করে। পরে নব্বইয়ের দশকে ফেনসিডিলে ভেজাল মেশানোতে এর গুণগত মান কমে যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক ফেনসিডিলসেবী হেরোইনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ওই সময় দেশে শুরু হয় হেরোইনের রমরমা ব্যবসা। এরপর হেরোইনেও ভেজাল মেশানো হয়। দিন দিন কমতে থাকে হেরোইনের গুণগত মান। এসব ভেজাল মাদক সেবনে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয় সেবনকারীদের শরীরে, যা আগে কখনো হয়নি।

ধীরে ধীরে মাদকসেবীরা কাছে টেনে নেয় আরেক মরণ নেশা ইয়াবাকে। মাদকাসক্ত রোগীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, ধরন ও প্রকৃতি দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা ভেজাল মাদক গ্রহণ করছে। ভেজাল মাদক গ্রহণের ফলে মাদকাসক্তরা হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে, শরীরে প্রচণ্ড খিঁচুনি হচ্ছে, হাত-পাসহ বিভিন্ন স্থানে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এছাড়া তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি সংক্রমণ মারাত্মক হারে বেড়েছে। বর্তমানে মাদক ও মাদকসেবীদের পরিবর্তন খুবই ভয়ংকর দিকে যাচ্ছে। তাই সমাজ থেকে মাদক দূর করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদক এবং ভেজাল মাদক মুক্ত করতে হবে দেশ।

আবারও ওষুধ প্রসঙ্গে আসা যাক। ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ি গোটা দেশে। বেশি মফস্বল এলাকায়। কোভিড-১৯ এর কারণে ওষুদের ব্যবহার বাড়ায় নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির মাত্রা আরও বেড়েছে। ওষুধ বিক্রেতা ও গ্রহণকারীর অনেকেই নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি জানে না। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর দেশের চারটি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ছ’টি ওষুধের উৎপাদন, মজুদ, বিক্রি, বিতরণ ও বিপণন স্থগিত করেছে এর আগে। এসব ওষুধ এখনো বাজারে মিলছে।

বিগত বছর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দুটি দল অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ও নকল ওষুধ উদ্ধার করে। যে পরিমাণ ভেজাল ওষুধ বাজারে আছে তার এক আনাও উদ্ধার করতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। অধিদফতরের এমন দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভেজাল ওষুধ। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইয়াবা এমন একটি মাদক, যা মানুষকে শুধু মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না, মৃত্যুর আগেই ওই মাদক সেবনকারীকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে। অথচ প্রাথমিকভাবে সেবনকারী বা তার আত্মীয়দের কেউ তা বুঝতেই পারেন না।

ভেজাল ওষুধ বন্ধে দেশে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাড়াতে হবে মনিটরিং কার্যক্রম। পরীক্ষার আওতার বাইরে থাকা ওষুধগুলো অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল ও কর্মদক্ষতাও বাড়াতে হবে। দেশে আরও ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা দরকার। প্রতিটি ওষুধ কোম্পানির কাজ নিজস্ব উপায়ে মান নিয়ন্ত্রণ করা। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দায়িত্ব খারাপ ওষুধ যেন বাজারে না আসে তা দেখা। আমাদের যত কোম্পানি আছে তার বিপরীতে আমাদের ন্যাশনাল ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি দুর্বল, জনবলের অভাব আছে তা বলতেই হয়। যেকোনো ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর এ জাতীয় ওষুধ তৈরি এবং বাজারজাত বন্ধ করা জরুরি।

এদিকে মাদকের ভেজাল আমাদের আরও দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। প্রাণঘাতী ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, অ্যালকোহল ও হেরোইনের দখলে দেশের মাদকের বাজার। সর্বনাশা এ দ্রব্যগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যেমন আসছে, তেমনিভাবে দেশেও সমানতালে ভেজাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন অপদ্রব্যের সংমিশ্রণে অলি-গলিতে এগুলো তৈরি হচ্ছে। সেবনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাথায় রেখেই এতে ভেজাল মেশানো হয়। এগুলো দেখতেও প্রায় একই রকম, দামও কম। সহজলভ্যতার কারণে সেবনকারীও প্রচুর। বাস্তবে এগুলো আসলের চেয়েও ভয়ংকর। একইসঙ্গে মাদক ও ভেজাল দুই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে সেবনকারীরা। মাদকের বিষ এবং ভেজাল বিষের ভয়াল থাবা এক হয়ে কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন।

মাদকদ্রব্য উদ্ধারকারী সংস্থার তথ্যমতে, দেশে এখন অন্তত ২৫ ধরনের মাদক রয়েছে। এর মধ্যে এক সময় ফেনসিডিলই ছিল প্রধান। ইয়াবা আসার পর এর ব্যবহার কিছুটা কমেছে। দেশের মাদক সেবনকারীর বড় অংশই এখন ইয়াবায় আসক্ত। সহজলভ্য হওয়ায় গাঁজা সেবনকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি মদের বাজারও রমরমা। হেরোইন অল্প পরিমাণে আসলেও এর সেবনকারীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে।

তবে চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকেই নেশার থাবা থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ভেজাল মেশানো মাদক মৃত্যু ও পঙ্গুত্বকেই ত্বরান্বিত করে। এক্ষেত্রে চিকিৎসারও তেমন সুযোগ নেই। সব মিলিয়ে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। মানুষের অজ্ঞতা, অসচেতনতার ফলে এই অবস্থার তৈরি হয়েছে।

গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, মাদকদ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেজাল মেশানো হচ্ছে ইয়াবায়। বিশ্বের কোথাও ইয়াবার কোনো রেজিস্ট্রার্ড ফর্মুলা নেই। ফলে যে যেভাবে খুশি সেভাবেই এটি তৈরি করছে।

সম্প্রতি সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেজাল অ্যালকোহল। দেশে ভেজাল মদ খেয়ে প্রায়শই মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আসল মদ অতিরিক্ত সেবনের ফলে প্রতিবন্ধী হওয়া, লিভার সিরোসিস, কর্মক্ষমতা হারানোসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সেখানে ভেজাল মেশানো মদ সেবনে মৃত্যু ডেকে আনা।

হেরোইন এখন অন্যতম ভয়ের কারণ। যা সেবনে লিভার সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, তীব্র কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনি রোগ, হার্ট ও ত্বকে সমস্যা, হেপাটাইটিস, নারীদের সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, গর্ভপাত হতে পারে। দেশে উদ্ধার হওয়া এই হেরোইনেও পাওয়া গেছে মারাত্মক ভেজাল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশে যে হেরোইন পাওয়া যায় সেখানে ৩-৫ ভাগ হেরোইন থাকে। বাকিটা অপদ্রব্য থাকে।

ফেনসিডিল ভারতে ৩৭৫ টাকা আর ঢাকায় আড়াই হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। অবৈধ ব্যবসায়ীরা এ লোভ ছাড়তে পারে না। তাই ফেনসিডিলে ভেজাল মেশায়। এ মাদক সেবনে দেহের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

দেশ থেকে ভেজাল মাদক, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন এবং বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রশাসনকে ভেজাল রোধে সচেষ্ট হতে হবে। অবৈধ ভেজাল ওষুধ এবং মাদক বিক্রি বন্ধে সকল পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। তা না হলে অকাল মৃত্যুসহ মানব দেহের যে ক্ষতি হচ্ছে তা আমাদের ভাবায় বৈকি।

মীর আব্দুল আলীম ।। সাংবাদিক ও কলামিস্ট।