কিছুদিন আগে মুনিয়া নামে ২১ বছরের একজন যুবতীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আলোচনায় গরম ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সেই ঘটনার কোনো সুরাহা হয়নি এখন পর্যন্ত। এরই মাঝে আবারও আলোচনায় এসেছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। এবার বাংলা সিনেমার অতি পরিচিত মুখ পরীমণি তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন।

পরীমণি তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সম্পূর্ণ বর্ণনা করেছেন সাংবাদিকদের কাছে। পুরো বর্ণনার যে অংশটি আমার কাছে অত্যন্ত নির্মম মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে, তিনি একজন সাধারণ নারী হয়েই বিচার চাইতে গিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট থানায় অথচ থানা সে মামলাটি নেয়নি। বিচারের আশায় ঘুরেছেন অনেকের কাছে কিন্তু কোনো সাড়া তিনি পাননি। এবারেও আলোচনায় আরও একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি যিনি বিভিন্ন ক্লাবে উচ্চপদ ধারণ করেন।

পরীমণি যখন বলেন যে, তিনি সাধারণ নারী হয়ে যখন বিচার চাইতে গেলেন তখন কোনো সাহায্য পাননি বা কেউ তার কথা শুনেনি অথচ যখন তিনি সিনেমার নায়িকা ‘পরীমণি’ হিসেবে ঘটনাকে তুলে ধরলেন তখন সংবাদমাধ্যম থেকে নানাজন মনোযোগী হয়ে উঠল। ভাবতে বসলাম আমি। কতটা নির্মম সত্য তিনি তুলে ধরেছেন। দিনের পর দিন নারীর প্রতি হিংস্র আচরণ যেন বেড়েই চলেছে অথচ এর একটিরও সুরাহা হচ্ছে না।

একজন প্রতিষ্ঠিত নায়িকা যখন ন্যায় বিচার চেয়ে পায় না, থানা মামলা নিতে চায় না, তখন আনাচে কানাচে এমন হাজারো পরীমণিদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সরকার নারী নির্যাতন বিরোধী আইন করে দিচ্ছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করছেন অথচ ডিজিটাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে নারীকে হেনস্তা করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এর উদাহরণ অসংখ্য।

এই সরকারের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। একের পর এক ঘটনা যেভাবে ঘটে যাচ্ছে তার ফলে আমরা কি ধরে নেব যে, আইনের শাসন কেবল পুরুষের জন্য প্রযোজ্য?

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনা আক্রান্তের খবরের নিচে হাজারো বাজে মন্তব্য তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। বিশ্ব মা দিবসে নায়িকা ভাবনার ছবির নিচে করা জঘন্য আক্রমণাত্মক মন্তব্যের ঘটনা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি।

কপালে টিপ পরি বলে বিভিন্ন সময়ে আমার লেখার নিচে বাজে মন্তব্য পেয়েছি। টিপ পরা, স্লিভলেস পোশাক পরা নারীদেরকে ‘বেশ্যা’ বলা তো রোজকার ঘটনা। ডিজিটাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে নারীকে পতিতালয়ে বিক্রি বা পাচারের ঘটনা তো মাত্র কয়েকদিনের আগের ঘটনা।

টিকটক হৃদয়ের নারী পাচারের ঘটনাও আমরা কেউই আগে টের পেলাম না। কেন? কী উত্তর হতে পারে এসব অভিযোগের? উত্তর একটাই। সেটা হচ্ছে আমাদের সমাজে বেড়ে ওঠা নারীবিদ্বেষী মানসিকতা। মৌলবাদী গোষ্ঠী ক্রমশ প্রচার চালাচ্ছে নারীকে হেয় করে। ধর্ম প্রচারের নামে চলছে নারীকে যাচ্ছে তাই ভাষায় গালিগালাজ। ওয়াজের নামে চলছে নারীর প্রতি অশ্লীল কথন। এর বিপরীতে যে পরিমাণ মামলা বা বিচার হওয়ার কথা ছিল সেটি কি আমরা পাচ্ছি? না। বিচার হচ্ছে না একটিরও।

খুব সচেতন হলে হয়তো মামলা পর্যন্ত গড়ায় কিন্তু সঠিক বিচার আসে না কোনো ঘটনারই। সর্বশেষ কবে নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনার বিচার হয়েছে সেটিও এখন গবেষণার অংশ। এই যে বিচারহীনতার জঘন্য উদাহরণ এটিই উসকে দিচ্ছে একের পর এক ঘটনাকে। দুর্বৃত্তরা পাচ্ছে সাহস।

একজন পরীমণিকে যখন কেঁদে কেটে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইতে হয় তখন সমাজের বাদ বাকি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এই সরকারের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। একের পর এক ঘটনা যেভাবে ঘটে যাচ্ছে তার ফলে আমরা কি ধরে নেব যে, আইনের শাসন কেবল পুরুষের জন্য প্রযোজ্য? নারীর জন্য আইন বা বিচার বলতে কিছুই নেই?

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে সরকারের যেসব কমিটি করা আছে সেগুলোতেও আছে ঝামেলা। কিছুদিন আগেই আইন মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি থেকে সুপারিশ করা হলো বিয়ের ক্ষেত্রে নারী রেজিষ্ট্রার না রাখতে, যেটি পরে হাইকোর্টের একটি রুলে বাতিল হয়ে যায়।

ওয়াজের নামে চলছে নারীর প্রতি অশ্লীল কথন। এর বিপরীতে যে পরিমাণ মামলা বা বিচার হওয়ার কথা ছিল সেটি কি আমরা পাচ্ছি?

সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করল, মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনারের সময় যেন নারী ইউএনও না রাখা হয়। কারণ কী? কারণ হচ্ছে, নারীরা জানাজা পড়ে না এবং এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক কথা হচ্ছে। কী আশ্চর্যের কথা, তাই না?

জানাজা আর গার্ড অব অনার যে এক বিষয় নয় এটিও তারা ভাবলেন না, অথচ এইসব কমিটির উচিত ছিল এমন মানসিকতাকে কেমন করে বন্ধ করা যায় বা দূর করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনা ও নীতিমালার সুপারিশ করা। সেটি না করে তারা উল্টো নারীর জন্য দুয়ার বন্ধ করার সুপারিশ করল। এসব কাণ্ডকারখানা কি সমাজে বিদ্যমান নারীবিদ্বেষী মানসিকতাকে উসকে দিচ্ছে না?

এই যে নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি ডিজিটাল সন্ত্রাসের বিচার হয় না বা হচ্ছে না, এর পেছনের কারণটি কি কেউ আলোচনা করেছেন কোনোদিন? সংসদীয় কমিটি কি কখনো ভেবেছেন যে কেন এগুলো ঘটছে বা কীভাবে এমন সন্ত্রাসকে বন্ধ করা যায়? আমি নিশ্চিত তারা ভাবেননি। ভাবলে আজকে এমন একটি উদ্ভট ও নারীবিদ্বেষী সুপারিশ করতে পারতেন না।

এমন শত শত ঘটনার উল্লেখ করা যাবে কিন্তু লাভ কী হচ্ছে? সরকার একদিকে বলছে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তারা বদ্ধপরিকর অথচ তাদের কার্যক্রম এমন প্রতিশ্রুতির পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে না। নারীর প্রতি মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন  আন্তরিকতা ও কমিটমেন্ট।

সরকারের সকল অংশে একই ধারার মানসিকতা থাকতে হবে। আইন ও বিচার বিভাগের অধীনে যারা কাজ করবে তাদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে করে তারা জেন্ডার সেনসেবল হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে কার্যকরভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সকল প্রকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে এগিয়ে চলার প্রতিশ্রুতি।

লীনা পারভীন ।। কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট