ম্যারাডোনাও নাই আর্জেন্টিনার শিরোপাও নাই, এরকম একটি কথা অনেকদিন ধরেই উচ্চারিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আসরে লিওনেল মেসিরা একটি করে ফাইনাল ট্রাজেডির শিকার হন, আর এই অভিযোগ শতবজ্রসম বিঁধে আর্জেন্টাইন ভক্তদের হৃদয়ে।

একবার বিশ্বকাপ ছাড়াও আরও তিন তিনবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠেও শিরোপা জয়ের দুঃস্বপ্ন ঘোচাতে পারেনি মেসিরা। এর মধ্যে মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা কোপায় দুই দু’বার টাইব্রেকারে হেরে শিরোপা স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়েছে তাদের।

দেশের হয়ে ফুটবলের যুবরাজ মেসির শিরোপা জয়ের শাপমোচন কি কোনদিনই হবে না? এই আক্ষেপ আসে ঘুরে ফিরেই। মেসির বয়স ৩৪। সোজা কথায় ধীরে ধীরে বয়স তার বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। এবারের কোপার পর বড় জোর সামনের বিশ্বকাপ হয়তো খেলতে পারবেন সেরা ছন্দে। আর চলতি কোপায় শিরোপার নাগাল না পেলে বিশ্বকাপের মতো আরও কঠিন মিশনে মেসিদের জন্য উদ্দীপ্ত হওয়াটা যে মোটেও সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য।

বাস্তবতা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন মেসি নিজেও। এবারের কোপা মিশন শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমাদের শিরোপা জয়ের এটাই সময়।’

মেসিকে নিয়ে পুরনো অভিযোগ যে, বার্সেলোনার জার্সি পরা আর জাতীয় দলের জার্সি পরা মেসি এক নয়। আর এই জায়গাতেই দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে মেসির পার্থক্য। কেননা বার্সার মেসি মানেই শিরোপা পর শিরোপা। কিন্তু জাতীয় দলে এই মেসিই আবার ট্রফি শূন্য। তার নামের সঙ্গে প্রায় স্থায়ী হতে বসা এই অভিযোগ খণ্ডানোর দায়টা মেসি কতটা অনুভব করেন, বড় হয়ে উঠেছে সেই প্রশ্নটিও।

দেশের জন্য মেসি নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিচ্ছেন কি না এটা বুঝতে খুব বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সবে শেষ হওয়া চিলির বিপক্ষে ম্যাচটির দিকেই তাকানো যাক।

মেসিকে নিয়ে পুরনো অভিযোগ যে, বার্সেলোনার জার্সি পরা আর জাতীয় দলের জার্সি পরা মেসি এক নয়। আর এই জায়গাতেই দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে মেসির পার্থক্য।

দু’দলের ২২ জন প্লেয়ারদের মধ্যে জেতার জন্য সবচেয়ে মরিয়া ছিলেন মেসি। ম্যাচ সেরা গোলটি করলেন তিনিই। সামনে চিলি প্রাচীর। এই প্রাচীরের উপর দিয়ে বল হাওয়ায় ভেসে দারুণভাবে বাঁক নিয়ে জড়িয়ে গেল জালে। শুভ যাত্রার জন্য যা করা দরকার তাই করলেন মেসি। কিন্তু শুরুর অভিযাত্রা সম্পূর্ণ হলো না।

চিলি ম্যাচে ফেরার পর প্রাণান্ত চেষ্টা করে গেছেন মেসি। প্রান্ত বদল করে বাড়িয়েছেন আক্রমণের ধার। ভাগ্য সহায় হয়নি। তার কয়েকটি চেষ্টা বিফলে গেছে। সতীর্থদের দিয়ে তার গোল করানোর প্রয়াসও সফল হয়নি। ম্যাচের ৮০ মিনিটের মাথায় তার চমৎকার ক্রস অরক্ষিত জায়গায় পেয়ে যান নিকোলাস গঞ্জালেজ। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি এ আর্জেন্টাইন। সব মিলিয়ে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার মতোই খেলেছে মেসি টনিকে উদ্দীপ্ত আর্জেন্টিনা। সুযোগ হাতছাড়া করায় কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি।
গত কিছুদিন ধরেই আর্জেন্টিনার ম্যাচে সমস্যাগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সর্বশেষ তিন ম্যাচে লিড নিয়েও জিততে পারেননি মেসিরা। এই চিলির বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচেও মেসিরই গোলে এগিয়ে থেকেও ড্র করেছে দলটি। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই, গোল করার পর  কিছুটা ঢিলেমি দেখা যাচ্ছে আর্জেন্টিনার খেলায়।

বার্সার মেসি মানেই শিরোপা পর শিরোপা। কিন্তু জাতীয় দলে এই মেসিই আবার ট্রফি শূন্য।

বড় আসরে লিড ধরে রাখাটা যে ভীষণ জরুরি, এটা বুঝতে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ হওয়ার পড়ে না। ম্যাচ শেষে বিষয়টি নিয়ে তার উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন মেসি। তার ভাষায়, ‘আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর সুস্থির হতে পারিনি। যেটা খুব দরকার ছিল।’ জিততে না পারার জন্য নিজেদেরই দুষছেন আর্জেন্টিনা কাণ্ডারি। বলেছেন, ‘আমরা ভালোভাবে খেলতে পারিনি। বলের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি, দ্রতগুতিতে খেলতে পারিনি।’

মেসির এই আত্মসমালোচনা যে আত্মোপলব্ধি থেকেই এটাও সুস্পষ্ট। বড় কিছু করতে হলে ভুল শুধরে দলবদ্ধভাবে সঠিক পথে থাকতে হবে, এটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন মেসি। বলেছেন, ‘যেভাবে খেলেছি তাতে জয়টা আমাদের প্রাপ্য ছিল। তবে এটা ঠিক যে কঠিন একটা টুর্নামেন্ট কেবল শুরু হল।’

আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির ক্যারিয়ার মানে শিরোপা স্বপ্নে বারবার হোঁচট। অনেকেই মনে করেন এটা নিয়তি নির্দিষ্ট! স্বভাতই প্রশ্ন ওঠে, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কি কখনো বৃত্তবন্দী থাকতে পারেন? মেসি ফুটবলের জাতশিল্পী। আপন রং তুলির ছোঁয়ায় আর্জেন্টাইন ফুটবলে মেসি নতুন প্রাণের ছবি আঁকতেই পারেন, এই বিশ্বাসটা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি নয়। নিজের হাতে ভাগ্য গড়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ এখন মেসির।

নাজমুল হক তপন ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক