মেরুন-নীলের রাজ্যে তিনিই রাজা। আকাশি-সাদায় যেন নিতান্তই এক প্রজা। আর কে না জানে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় রাজার নাম থাকলেও প্রজার উল্লেখ কদাচিৎ! বার্সেলোনার ফুটবল ঈশ্বর লিওনেল মেসি তাই আর্জেন্টিনার জার্সিতে হয়ে পড়েন অনুল্লেখ্য একজন। গড়পড়তা। এলেবেলে। ভীষণ সাধারণ।

নিয়তির কপাটে কপাল ঠেকিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একবার, দুইবার, বারবার। কিন্তু সাফল্যের দরজাটা খুলছে না কিছুতেই। এবার কি ভিন্ন কিছু হবে কোপা আমেরিকায়? নাকি মেসির এই দুঃখের সাগরে লবণ পানি ঢুকবে আবার হুহু করে? বার্সেলোনার সমস্ত প্রাপ্তি ছাপিয়ে আর্জেন্টিনার এই অপ্রাপ্তির বিউগল করুণ সুরে বাজবে; বাজতেই থাকবে?

মাত্র তো দুটো ম্যাচ গেল আর্জেন্টিনার! সিদ্ধান্তে পৌঁছানো তাই অসম্ভব। তবে অনুসিদ্ধান্তে যদি পৌঁছতে চান, তাহলে আশার আকাশটাকে খুব বড় দেখাচ্ছে না। মেসি যতই তার প্রতিভার পরমাণু উজাড় করে খেলুক না কেন, ওই তাল-ছন্দ-লয়ের সঙ্গে তো সতীর্থদেরও মিলতে হবে! সেটি আর হচ্ছে কই!

চিলির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ফ্রি কিক থেকে তার জাদুকরি এক গোল। সে লিড ধরে রাখতে পারে না আর্জেন্টিনা। উরুগুয়ের বিপক্ষে পরের খেলায় তার পাসে গোল। এবার আর গোল খায়নি। জিতেছে তাই। কিন্তু বুদবুদের মতো উড়তে থাকা চারপাশের প্রশ্নগুলো তাড়ানো যায়নি।

বার্সেলোনার ফুটবল ঈশ্বর লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার জার্সিতে হয়ে পড়েন অনুল্লেখ্য একজন। গড়পড়তা। এলেবেলে। ভীষণ সাধারণ।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, মেসির সতীর্থদের। এই জাদুকরের সঙ্গে তারা যে তাল মেলাতে পারেন না কিছুতেই! ক্লাব ইন্টার মিলানে অমন অপ্রতিরোধ্য লাউতারো মার্তিনেজ; কিন্তু জাতীয় দলে একেবারে টিমটিমে। সুযোগের পর সুযোগ তৈরি করে দেন মেসি; মিসের পর মিস করতে থাকেন মার্তিনেজ। যেন সেই গনসালো হিগুয়াইনের প্রেতাত্মা। মেসির অনন্ত আক্ষেপের প্রতীক হয়ে আছেন যিনি। 

আর কোচ লিওনেল স্কালোনিও যেমন! হচ্ছে না যখন, তখন তো ভিন্ন কিছু চেষ্টা করতে হয়। সর্বশেষ ১২ ম্যাচে ২ গোল দেওয়া মার্তিনেজের ওপরই তার অহেতুক ভরসা। ওদিকে বেঞ্চে বসে থাকেন সার্জিও আগুয়েরো। এমন নয় যে, জাতীয় দলে পারফরম্যান্সের আগুন জ্বালান তিনি। তবু ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে আগুয়েরোর অভিজ্ঞতায় ভরসা রাখা তো উচিত। যেমনটা বলা যায় বেঞ্চ গরম করা আনহেল দি মারিয়ার বেলাতেও।

আর মেসির নিজেরও তো বাড়তি কিছু করার নেই? মানছি, প্রথম দুই ম্যাচে আর্জেন্টিনার সেরা খেলোয়াড় তিনি। দারুণ খেলেছেন। কিন্তু কতটা দারুণ? বার্সেলোনার মেসির মতো? কিছুতেই না। বার্সার সতীর্থ এবং সারা বছরের একত্রে ট্রেনিংয়ের ব্যাপারটা বলবেন তো? একই কথা কি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কিংবা নেইমারের বেলাতেও প্রযোজ্য না? তবু তো জাতীয় দলের জার্সিতে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। কখনো কখনো যেন ক্লাব দলের চেয়েও বেশি করে।

মেসি চার-চারটি বিশ্বকাপ, পাঁচ-পাঁচটি কোপা আমেরিকা খেলেছেন। চার-চারবার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছেন। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারেননি একবারও।

সেখানে মেসির সবসময়ই যেন পিছুটান। এই যেমন ২০১৯ সালের জুনের পর আর্জেন্টিনার জার্সিতে ‘ওপেন প্লে’ থেকে কোনো গোল করতে পারেননি। পেনাল্টির বাইরেই কোনো গোল ছিল না। চিলির বিপক্ষে ফ্রি কিকের লক্ষ্যভেদে তাও কিছুটা মান রক্ষা! কিন্তু অধরা স্বপ্ন পূরণের জন্য মেসির নিজেকে ফিরাতেই হবে। আর নিজে যে সেজন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে বেশ কয়েকবার সতীর্থদের উপেক্ষা করে একা গোল করার চেষ্টায় যেন প্রমাণ!

এটা অবশ্যই ঠিক যে, মেসির নিজেকে নতুন করে প্রমাণের কিছু নেই। টানা দেড় দশক এমন শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল খেলায় ইতিহাসেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেবল সমকালীন রোনালদো। সেই রোনালদোও তো পর্তুগালের জার্সিতে ২০১৬ ইউরো জিতেছেন; ২০১৯ নেশন্স লিগ জিতেছেন। মেসির অর্জনের ডায়েরির ওই পাতাটা কেবলই শূন্যতায় ভরা।

মেসি চার-চারটি বিশ্বকাপ, পাঁচ-পাঁচটি কোপা আমেরিকা খেলেছেন। চার-চারবার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছেন। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারেননি একবারও। স্পর্শের দূরত্ব থেকে অসীমে যেন হারিয়ে গেছে তা। বারবার।

এবার কি ফুটবল দেবতা মুখ তুলে চাইবেন? মেসি নামের জাদুকরের আহত আশা রাঙাবে অর্জনের আলোয়? নাকি টুর্নামেন্ট শেষে ভেজা চোখের মাথা নিচু করা স্যাঁতস্যাঁতে ছবিটা ফিরে আসবে আবার?

এর উত্তর যতোটা মেসির কাছে, তার চেয়ে বেশি করে যেন আর্জেন্টিনার কোচের খেয়ালিপনা আর সতীর্থদের সামর্থ্যের শিকলে বন্দী!

নোমান মোহাম্মদ ।। সম্পাদক, নট আউট নোমান