অদৃশ্য সুতায় ঝুলছে ভবিষ্যৎ নির্বাচন
চব্বিশের জুলাই আন্দোলন অনেক অপ্রাপ্তির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। সেই ওয়ান-ইলেভেন থেকে দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অপেক্ষায় সারাদেশ। অপেক্ষা নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। জনগণের প্রত্যাশার পারদ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সময়ের পরিক্রমায় দিনলিপির পৃষ্ঠা যতই সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে একটি অনিশ্চিত সম্ভাবনা যেন কড়া নাড়ছে। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। সবাই একটি নির্বাচিত সরকারের প্রত্যাশার বীজ বপন করছে। ফল আসবে কিনা সে ভাবনাও পেয়ে বসেছে।
জুলাই সনদ, কিছুদিন উচ্চ কক্ষ-নিম্ন কক্ষ নিয়ে জোর আলোচনা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, পিআর পদ্ধতি, গণভোটসহ আরও কত ইস্যু নিয়ে তোলপাড় রাজনৈতিক অঙ্গন। এসব আলোচনার শেষ কোথায়, আমার বিশ্বাস দেশের জনগণ তো নয়ই রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ধূম্রজাল তৈরি করেছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু নিয়ে। কখনো কখনো গুজব ডালপালা গজিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিও আঙুল প্রদর্শন করছে।
বিজ্ঞাপন
এইসব আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো সোশ্যাল মিডিয়া। বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা মাধ্যম। সোশ্যাল মিডিয়া মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম আরও এক ধাপ এগিয়ে যেমন ফেসবুকের কোনো মেসেজকে ফ্যাক্টচেক না করে নিউজ করে দিচ্ছে তেমনি কিছু কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েটর কিংবা ইউটিউবারদের কনটেন্ট থেকে সংবাদ পরিবেশন করে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। উড়ো খবর নিয়ন্ত্রণ এখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। যা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় অস্থিরতা কাজ করছে।
জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে নানা ইস্যুতে নানা সমীকরণ নিয়ে কাজ করছে রাজনৈতিক দলগুলো। জুলাই আন্দোলনের পর কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি।
বিজ্ঞাপন
অতীতে নির্বাচনের নামে সরকার সমর্থিত কিছু রাজনৈতিক দল ও আওয়ামী লীগ 'নির্বাচননাটক' মঞ্চস্থ করেছে। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লুকোচুরি খেলার মুখস্থ প্ল্যাটফর্ম দেখতে হয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে ১৪ দলের বিশেষ করে হাসানুল হক ইনু’র জাসদ, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দলগুলো নিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলায় মেতে উঠেছিল।
বিভিন্ন সময় নির্বাচন কমিশনের ক্যারিশমা দেখার সুযোগ পেয়েছে দেশের জনগণ। কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫১ আসন, কখনো দিনের ভোট রাতে আবার কখনো আমি-ডামি’র নির্বাচন।
এবার দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যেমন রাজনীতির বাইরে তেমনই তাদের সমর্থিত জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলও নেই রাজনীতির মাঠে। প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ ভোটারের অনিশ্চয়তা আগামী নির্বাচনে। এটাও বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি কি আছে নির্বাচন কমিশনের? তা সময় বলে দেবে।
আজ যারা তরুণ তারা তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর এখন পর্যন্ত নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। রাষ্ট্র সেই অধিকার তুলে দিতে পারেনি তার নাগরিকদের। অধীর আগ্রহে তারা প্রথমবারের মতো নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অপেক্ষায়, নেতা নির্বাচন করার জন্য অপেক্ষায়, সেই অপেক্ষার প্রহরটা কি সরলভাবে দেখা দিচ্ছে? মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটছে। এসব প্রশ্নের সহজ সরল উত্তর রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।
অনেক আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সারা বিশ্বের কাছে অতি সমাদৃত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন অবস্থায় আছে দেশের জনগণই ভালো বলতে পারবে। একজন নাগরিক হিসেবে অসহিষ্ণু পরিবেশের মধ্যে আছি তা বলতে পারি।
পুলিশ এখনো আস্থার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। সড়কে বের হলেই দেখা যায় ট্রাফিক সার্জেন্টদের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মামলায় ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে, অথচ সড়কে অস্বাভাবিক ট্রাফিক জটের কারণে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। স্বাধীনতার এত বছরে কিন্তু মানুষের মধ্যে কেমন জানি সবকিছুতেই অপূর্ণতা দেখতে পাচ্ছি, সবাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ প্রতিটি শহর রাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সাধারণ জনগণ শুধু না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বিভিন্ন সময় আক্রান্ত হচ্ছে ছিনতাইকারীদের কবলে।
ম্যাজিট্রেসি পাওয়ার নিয়ে জনগণের নিরাপত্তা দিতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও মাঠে থাকছে কিন্তু সেটাও পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে হচ্ছে। বর্তমান প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে দেশের জনগণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন উপায় বের করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। না হলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করবে, বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য অপচেষ্টায়ও লিপ্ত থাকবে, সেই দিকে নজর দিতে হবে প্রশাসনকে।
ভোটের রাজনীতিতে দলগুলোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সবাই কেমন জানি উদগ্রীব হয়ে আছে। যারা ভোটের রাজনীতিতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে কিংবা নবগঠিত রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা সাজাচ্ছে কিংবা তিনবারের ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর আবার বিভিন্ন দল রাজনৈতিক জোট করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার পায়তারা করছে সেখানে সবকিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলবে তা ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যার যার অবস্থান থেকে প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সামনের নির্বাচনে অনেক চ্যালেঞ্জকে সঙ্গী করেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হবে।
সরকার, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যমসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু সুন্দর নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। যদি কোনো পক্ষ কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় তবে বহুল প্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
মো. কামরুল ইসলাম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট