নিউ মিডিয়ার চার যুগ : মুক্তি, বিপ্লব, নজরদারি ও অ্যালগরিদমের শাসন
গণমাধ্যমের ইতিহাসে আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে খবর, মতামত ও প্রচারণার সীমারেখাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাতে স্মার্টফোন, সামনে ইন্টারনেট—এখন প্রত্যেকেই নিজেই একেকটি মিডিয়া। একুশ শতকের এই বাস্তবতাকে আমরা বলি নিউ মিডিয়া, যা কেবল প্রযুক্তিগত রূপান্তর নয়; এটি আসলে ক্ষমতা, রাজনীতি ও সামাজিক কাঠামোর এক গভীর পরিবর্তনের নাম। যোগাযোগতত্ত্ববিদ ম্যানুয়েল ক্যাসটেলস তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Rise of the Network Society’ (১৯৯৬)-এ বলেছেন, আধুনিক সমাজে ক্ষমতা পিরামিড আকারে নয়, বরং তথ্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, যে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে, সে-ই নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের চিন্তা, ভাষা ও জনমত।
বাংলাদেশে এই নেটওয়ার্ক সোসাইটির প্রেক্ষাপটে নিউ মিডিয়ার যাত্রা প্রায় তিন দশকজুড়ে চারটি পৃথক পর্বে ভাগ করা যায়—মুক্তির যুগ, বিপ্লবের যুগ, নজরদারির যুগ এবং অ্যালগরিদমের যুগ।
বিজ্ঞাপন
প্রথম যুগ: মুক্তির উচ্ছ্বাস (১৯৯০–২০০৯)
১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে ইন্টারনেটের প্রসার এবং ২০০৪ সালে ফেসবুকের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নাগরিক যোগাযোগের এক নতুন অধ্যায়। ২০০৫ সালে ইউটিউব, ২০০৬ সালে টুইটার—সবকিছু মিলিয়ে নাগরিকেরা বুঝতে শুরু করলেন যে খবর প্রকাশ, মতামত দেওয়া কিংবা চিত্র ধারণ করতে আর কোনো মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের অনুমতির দরকার নেই।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে এই মুক্তির অভিজ্ঞতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়েছিল ব্লগিং আন্দোলনের সময়। ২০০৫–২০১৩ পর্যন্ত সময়টায় ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ’, ‘নিষিদ্ধ সাব’ ইত্যাদি ব্লগ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল বিকল্প নাগরিক মতপ্রকাশের ক্ষেত্র।
তরুণরা ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে নিজের ভাষায় লিখতে শুরু করলেন। এই সময়টিতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সীমাবদ্ধতার বিপরীতে নিউ মিডিয়া হয়ে ওঠে এক মুক্ত মঞ্চ।
ম্যানুয়েল ক্যাসটেলসের ভাষায়, এটি সেই সময় যখন ‘power to reprogram the network’ কিছু সময়ের জন্য সাধারণ মানুষের হাতে এসেছিল। এই সময়কে বলা যায় নিউ মিডিয়ার Liberation Phase—প্রত্যেক পোস্ট ছিল এক একটি ছোট বিপ্লব।
দ্বিতীয় যুগ: বিপ্লবের বিস্ফোরণ (২০১০–২০১৪)
২০১০ সালের আরব বসন্ত (Arab Spring) বিশ্বকে দেখিয়ে দেয় নিউ মিডিয়ার প্রকৃত রাজনৈতিক শক্তি। তিউনিসিয়ার মুহাম্মদ বুয়াজিজির আত্মাহুতির পর ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউব হয়ে ওঠে আন্দোলনের ভাষা।
‘We are all Khaled Said’ নামে একটি ফেসবুক পেজ ২০১১ সালে মিশরে লাখো মানুষকে পথে নামায়; তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন—সবখানেই মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট হয়ে ওঠে গণঅভ্যুত্থানের হাতিয়ার।
তরুণরা ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে নিজের ভাষায় লিখতে শুরু করলেন। এই সময়টিতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সীমাবদ্ধতার বিপরীতে নিউ মিডিয়া হয়ে ওঠে এক মুক্ত মঞ্চ।
দক্ষিণ এশিয়াতেও এই প্রভাব এসে পড়ে। বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলন (২০১৩) ছিল এর এক প্রতীকী উদাহরণ—একটি ফেসবুক আহ্বানেই লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নামে। একই সময়ে শ্রীলঙ্কায় অনলাইন ক্যাম্পেইন মাহিন্দা রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে, আর মালদ্বীপে প্রবাসী তরুণেরা ডিজিটাল মাধ্যমে গণতন্ত্রের আন্দোলন চালান।
এই পর্বে যোগাযোগ কেবল ‘mass communication’ নয়; এটি হয়ে ওঠে ‘mass self-communication’—যেখানে প্রতিটি ব্যবহারকারী নিজেই বার্তাবাহক, সম্পাদক এবং সম্প্রচারক।
তৃতীয় যুগ: নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ (২০১৫–২০২১)
বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই শুরু হয় নতুন পর্ব—রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের যুগ। সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা বুঝে ফেলে, তথ্য নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ মানেই জনমত নিয়ন্ত্রণ। শুরু হয় সাইবার আইন, নজরদারি ও মনিটরিং-এর সময়কাল।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে ২০১৮ সালে প্রণীত Digital Security Act (DSA)—যা মূলত মুক্ত মত প্রকাশকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেয়। ২০১৮–২০২৩ পর্যন্ত এই আইনে শতাধিক মানুষ গ্রেপ্তার হন, যাদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক, ছাত্র, শিক্ষক, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক আন্দোলনের সময় সরকার কয়েক দফায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। মালদ্বীপে নির্বাচনের সময় আরোপ হয় সোশ্যাল মিডিয়া সীমাবদ্ধতা। ভারতেও ২০১৬ পরবর্তী সময়ে রাজ্যভিত্তিক ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা বেড়ে যায়।
এই সময়ের বৈশিষ্ট্য—মুক্তির জায়গায় ভয়, মতপ্রকাশের জায়গায় আত্মনিয়ন্ত্রণ। ম্যানুয়েল ক্যাসটেলসের ভাষায়, এটি সেই পর্ব যখন ‘networks are reprogrammed by power.’ নেটওয়ার্কের উন্মুক্ত পরিবেশ ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক নিয়ন্ত্রিত কাঠামোয়।
চতুর্থ যুগ: অ্যালগরিদমের অদৃশ্য শাসন (২০২২–বর্তমান)
বর্তমান যুগে আমরা প্রবেশ করেছি আরও সূক্ষ্ম এক বাস্তবতায়—অ্যালগরিদমের যুগে। এখানে রাষ্ট্র নয় বরং প্রযুক্তি কোম্পানির অ্যালগরিদমই ঠিক করে দেয় আমরা কী দেখব, শুনব কিংবা ভাবব।
ফেসবুকের News Feed Algorithm (২০১৮ পরবর্তী), ইউটিউবের Recommendation System কিংবা টিকটকের For You Page—সবগুলোই এমনভাবে প্রোগ্রাম করা যে তা ব্যবহারকারীর মনোযোগ ধরে রাখতে চায়, কিন্তু ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ করে তার চিন্তাকেও।
২০২৩ সালে Reuters Digital News Report জানিয়েছিল—বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ অনলাইন ব্যবহারকারী এখন খবর পান সোশ্যাল মিডিয়া থেকে, কিন্তু ৪১ শতাংশ জানেন না তাদের নিউজফিড কীভাবে সাজানো হয়। এই পর্বে নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান নয়—এটি নীরব, অদৃশ্য এবং আরও কার্যকর। অ্যালগরিদমই এখন নতুন সেন্সরশিপ।
মুক্তি না আত্মসমর্পণ?
নিউ মিডিয়ার এই চার যুগ—আসলে মানবসমাজে ক্ষমতার চার রূপান্তর। প্রথমে মানুষ পেয়েছিল কণ্ঠস্বর, তারপর আন্দোলনের শক্তি, এরপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ভয় এবং শেষে কর্পোরেট অ্যালগরিদমের বাঁধন।
২০২৩ সালে Reuters Digital News Report জানিয়েছিল—বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ অনলাইন ব্যবহারকারী এখন খবর পান সোশ্যাল মিডিয়া থেকে, কিন্তু ৪১ শতাংশ জানেন না তাদের নিউজফিড কীভাবে সাজানো হয়।
মহাভারতের যুগগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়—
প্রথম যুগ ছিল সত্যযুগের মতো, যেখানে মানুষ প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন সত্য খুঁজে পায়;
দ্বিতীয় যুগ ত্রেতাযুগ—ন্যায়ের জন্য লড়াই;
তৃতীয় যুগ দ্বাপর—সত্য ও মিথ্যার বিভ্রান্তি;
আর এখন কলিযুগ—যেখানে শব্দ আছে, অর্থ হারিয়ে গেছে।
তবু ইতিহাস আশাবাদী। কারণ, যে প্রযুক্তি একসময় মানুষকে কণ্ঠ দিয়েছে, তাকে চিরকাল নীরব রাখা যায় না।
বাংলাদেশের তরুণেরা এখনো বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে, ইউটিউবভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, স্বাধীন পডকাস্ট, কিংবা ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজমের নতুন ভাষা।
নেটওয়ার্ক সমাজের ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে এক মৌলিক প্রশ্নের ওপর—আমরা কি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব মুক্তির জন্য, নাকি আত্মসমর্পণের জন্য?
রাজীব নন্দী : সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
rajibnandy@cu.ac.bd