ঢাকা কি বসবাসের যোগ্য?
পৃথিবীর নানা দেশের, নানা শহরে ঘুরতে গিয়েছি। কিছুদিন থাকার পরই ঢাকা ফেরার জন্য হা-পিত্যেশ করি। এই শহরে এমন কোনো জাদু নেই, যা আমাকে টেনে আনে। কিন্তু কেমন যেন মনে হয়, এই শহরের মাঝেই আমি প্রাণ খুঁজে পাই।
আমার সর্বশেষ দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণ ছিল ২০১৯ সালে, ওশেনিয়ায় ৩ সপ্তাহের ট্যুর। এই ট্যুরটা নানা কারণে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ—এই ভেবে যে, একই সাথে আমরা বাসযোগ্যতার নিরিখে পৃথিবীর নিকৃষ্ট এবং উৎকৃষ্ট—দুই রকমের শহরের গন্ধ নিয়ে এসেছিলাম।
বিজ্ঞাপন
প্রথমে গিয়েছিলাম পাপুয়া নিউ গিনির রাজধানী পোর্ট মোরসবিতে। সাড়ে ৮ শ’র মতো জাতির মানুষ ৮ শ’টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় সেদেশে কথা বলে। শুনে চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন দেশের গ্রামাঞ্চল দেখতে বেরোলাম, আমাদের আগে-পিছে নিরাপত্তা বাহিনীর লোক দিয়ে দেওয়া হলো। বুঝে ফেললাম এই শহর নিরাপদ নয় এবং জেনে আতঙ্কিত হলাম যে এই শহরটি বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে সর্বনিম্ন স্থানে আছে।
এই খবরের পাশের খবর ছিল—আমাদের ঢাকার অবস্থা তার থেকে সামান্য দূরে, সর্বনিম্নের ঠিক ওপরেই তার অবস্থান। নিকৃষ্টের সঙ্গে নিকৃষ্টের প্রতিযোগিতা—এই ভেবেও শান্তি পাওয়ার সুযোগ হলো না। যতই কালো-কৃষ্ণ চামড়ার ভারি, মোটা ঠোঁটের মানুষেরা আমাদের সাথে মিষ্টি মিষ্টি ভাষায় কথা বলুক, মনে হতো—এই বুঝি কেউ ছুরি ধরে বলে বসে, ‘যা আছে দিয়ে দাও।’
বিজ্ঞাপন
পাপুয়া নিউ গিনি ছেড়ে আমরা অস্ট্রেলিয়া যাই। আমরা মনের আনন্দে মেলবোর্ন, সিডনি, ব্রিসবেন, ক্যানবেরা ঘুরে বেড়াই। মেলবোর্নের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টের পেলাম—এ শহর পৃথিবীর নিরাপদতম শহর। আর খোঁজ নিয়ে জানলাম—বাসযোগ্যতার নিরিখে পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি শহরের মধ্যে ৪টিই অস্ট্রেলিয়ার শহর।
মেলবোর্নের অবস্থান দ্বিতীয়। একজন জানালেন, ২০২৪ সালে এই শহরে মাত্র একটি ইভ-টিজিংয়ের ঘটনা রিপোর্ট হয়েছিল, এ কারণে দ্বিতীয়তে নেমে এসেছে; না হলে এটি প্রথমই হতো।
শহরে ছিনতাই, পকেটমারা, রাস্তার অপরাধ সাধারণ ঘটনা। রাজনৈতিক সহিংসতা, আন্দোলন, অবরোধ—এগুলো শহরবাসীর দৈনন্দিন জীবনে স্থায়ী আতঙ্ক সৃষ্টি করে। একটি শহরের মানসিক নিরাপত্তা যত নিম্নে নেমে যায়, বাসযোগ্যতা ততই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখা The Economist Intelligence Unit (EIU) প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ১৭৩টি শহর বিশ্লেষণ করে এই সূচক প্রকাশ করে। এরা The Global Liveability Index–এ যে ৫টি মানদণ্ডে শহরের বাসযোগ্যতা যাচাই করে, তা হলো—
- স্থিতিশীলতা—অপরাধ, সন্ত্রাস, যুদ্ধ বা সিভিল বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি,
- স্বাস্থ্যসেবা—পাবলিক ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবার মান, পরিষ্কার পানি, টেলিকম ইত্যাদি
- সংস্কৃতি ও পরিবেশ—জীবনের মান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগ, পরিবেশ মান
- শিক্ষা—প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, শিক্ষার সুযোগ ও মান
- অবকাঠামো—পরিবহন, যাতায়াত, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট, স্মার্ট সিটি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি
এসব বিচারে ২০২৫ সালে বাসযোগ্যতার নিরিখে সবার ওপরে আছে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন। এরপর আছে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি।
আর কষ্টের খবর হলো, ২০২৫ সালের হিসেবে সারা পৃথিবীর ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকা স্থান পেয়েছে ১৭১তম অবস্থানে। লিবিয়ার ত্রিপোলি আর সিরিয়ার দামেস্ক—এই দুই যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর দুটো মাত্র ঢাকার চেয়ে আরও খারাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার চেয়ে একটু ভালো অবস্থানে আছে নাইজেরিয়ার লাগোস, ভেনেজুয়েলার কারাকাস, জিম্বাবুয়ের হারারে, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, পাপুয়া নিউ গিনির পোর্ট মোরসবি (৬ বছরে অবস্থান উন্নতি করেছে ৬ ধাপ), পাকিস্তানের করাচি ইত্যাদি।
১৮ নভেম্বর ২০২৫ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের ‘ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রস্পেক্টস ২০২৫’ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন বলছে, ২০২৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা। এরপরই ঢাকার অবস্থান। জাপানের টোকিওকে পেছনে ফেলেছে জাকার্তা ও ঢাকা। তৃতীয় স্থানে থাকা টোকিওর পর তালিকায় আছে যথাক্রমে ভারতের নয়াদিল্লি ও চীনের সাংহাই।
যে হারে ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে, তাতে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে জাকার্তাকে ছাড়িয়ে যাবে ঢাকা। তখন ঢাকা হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরী। জনসংখ্যা হবে প্রায় ৫ কোটি ২১ লাখ।
ঢাকা কি নিকৃষ্ট শহর?
EIU–এর প্রথম মানদণ্ড হলো স্থিতিশীলতা—এখানেই ঢাকার স্কোর সবচেয়ে নিচে।
প্রবাসী কোনো আত্মীয় ঘুরতে এলে তাকে প্রথমেই বলি, ঘড়ি, গয়না না পরে বেরোতে। বেশি টাকা না রাখতে। দশ মিনিটের হাঁটার পথ গাড়িতে যেতে কখনো এক ঘণ্টাও লাগতে পারে—এই অদ্ভুত বাস্তবতাও বুঝিয়ে দেই।
গণপরিবহন নিতে বারণ করি। আর বাইরে খেয়ে প্রায়ই তাদের পেট খারাপ হলে প্রশ্ন আসে—কেন প্রতিবার বোতলের পানি কিনতে হয়? উত্তর দিতে গিয়ে প্রায়ই নির্বাক হয়ে যাই।
শহরে ছিনতাই, পকেটমারা, রাস্তার অপরাধ সাধারণ ঘটনা। রাজনৈতিক সহিংসতা, আন্দোলন, অবরোধ—এগুলো শহরবাসীর দৈনন্দিন জীবনে স্থায়ী আতঙ্ক সৃষ্টি করে। একটি শহরের মানসিক নিরাপত্তা যত নিম্নে নেমে যায়, বাসযোগ্যতা ততই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
ঢাকার স্বাস্থ্যসেবা পুরো শহরের জনসংখ্যার তুলনায় বহু নিচে। সচ্ছলরা ঢাকার চিকিৎসায় আস্থা রাখেন না—তারা ব্যাংকক–সিঙ্গাপুর দৌড়ান। আমাদের মন্ত্রী-এমপি-সচিবেরা নিজেদের দেশেও চিকিৎসাসেবা যেমন দিতে পারেন না সাধারণকে, তারাও দেশে চিকিৎসা সেবা দিতে ব্যবস্থা নেন না। মধ্যবিত্তরা থাকে সংকটে। সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট, কম ডাক্তার, অতিরিক্ত ভিড়। আবার পরিবেশ দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, এলার্জি, হৃদরোগ—এসব আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।
আমাদের শহরের ওয়াসার পানি আমরা পান করি না—জানি এই পানি বিশুদ্ধ নয়। এসব কারণেও আমাদের সূচক ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে।
নাগরিক পরিবেশ আরেকটি বড় বিষয়। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রায়ই ঢাকার নাম ১ নম্বরে উঠে আসে। আমাদের বায়ুদূষণ প্রকট। শীতকালে PM2.5 মাত্রা নিয়মিতভাবে WHO–র মানদণ্ডের ৮-১২ গুণ।
আমাদের শব্দদূষণ আছে। ট্রাফিক, হকার, নির্মাণকাজ—সব মিলিয়ে শহরবাসী সারাক্ষণ উচ্চ শব্দের মধ্যে বসবাস করে। আমাদের নাগরিক উদ্যান ভরাট করে আমরা আবাসিক এলাকা বানাই। মাথাপিছু খেলার মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থানের সংখ্যা যা আছে—তার নিরিখে কোনো শহরই বিশ্বমানের বাসযোগ্য হতে পারে না।
আমরা আমাদের পাড়ার স্কুলে আমাদের বাচ্চাদের ভর্তি করাতে চাই না, কারণ এখানে সব স্কুলে সমান শিক্ষার মান বা পরিবেশ নেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০-১২ রকমের কারিকুলাম। পাঠ্যসূচিতে ঐক্য নেই, শিক্ষকেরা অল্প বেতনে চাকরি করতে বাধ্য হন বলে ক্লাসে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেন না। ভালো স্কুলগুলোয় অতিরিক্ত ভিড় থাকার কারণে অনেকে সেখানে পড়ার সুযোগ পায় না। এর ফলে আন্তর্জাতিক সূচকে ‘Education’ ক্যাটাগরিতে আমাদের স্কোর মাঝারি বা তার নিচে থাকে।
EIU–এর সূচকে ঢাকার সবচেয়ে নিম্ন স্কোর অবকাঠামো খাতে।
যানজট এই শহরের নিত্যবিড়ম্বনা। বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবে ধরা হয় ঢাকাকে। ঢাকার গড় গাড়ির গতি ৫-৭ কিমি/ঘণ্টা। এর কারণ হলো সড়কের সংকীর্ণতা, পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন, বেপরোয়া ড্রাইভিং, সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার অভাব, সড়কের ওপর হকারের আস্তানা, ট্রাফিক সিগনালের কার্যকারিতা নেই—সব মিলিয়ে প্রতিদিন কোটি মানুষের উৎপাদনশীল সময় নষ্ট হচ্ছে।
সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যায়, সমন্বিত স্যুয়ারেজ–ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনের পথ সংকুচিত হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। অনেক এলাকায় আবর্জনা নিয়মিতভাবে পরিষ্কার হয় না, সড়কে বর্জ্যের স্তূপ পড়ে থাকে।
এছাড়াও আছে লোডশেডিং, গ্যাস সংকট। এ শহরে স্মার্ট সিটি সিস্টেম নেই বললেই চলে। এইসব কারণ ঢাকার অবকাঠামো স্কোরকে অন্যতম সর্বনিম্ন করে তোলে।
...হকারের উচ্চকণ্ঠের ডাক, যানজটের আওয়াজ, রাস্তার ভিড়—সবকিছুই আমাদের কাছে স্বাভাবিক। আমাদের নেই কোনো বৃহৎ নাগরিক স্কোয়ার—কিন্তু আছে শাহবাগ, যেখানে আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হয়। আছে রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান—যেখানে উৎসবে মানুষের ঢল নামে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ভবন ঘনত্ব এ শহরের আরেক বৈশিষ্ট্য। ঢাকার বড় অংশই কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি হয়েছে। রাস্তা সংকীর্ণ থাকা, অবৈধ স্থাপনা, পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ড-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা—এসব শহরের ‘Urban Design’ স্কোরকে মারাত্মকভাবে নিচে নামায়।
তবুও, ঢাকা আমার শহর
ঢাকার রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের জীবনে নতুন কিছু নয়। বরং উপকূলের মাঝি যেমন ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে শেখে, আমরাও তেমনি দৈনন্দিন বিশৃঙ্খলার সঙ্গে লড়তে শিখেছি। রিকশাওয়ালার ভুল দিক দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াও যেন এক প্রাত্যহিক কৌশল—যার সঙ্গে শহরবাসী মানিয়ে নিয়েছে নিঃশব্দ অভ্যাসে।
হকারের উচ্চকণ্ঠের ডাক, যানজটের আওয়াজ, রাস্তার ভিড়—সবকিছুই আমাদের কাছে স্বাভাবিক। আমাদের নেই কোনো বৃহৎ নাগরিক স্কোয়ার—কিন্তু আছে শাহবাগ, যেখানে আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হয়। আছে রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান—যেখানে উৎসবে মানুষের ঢল নামে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—এ শহরের ৯৫ শতাংশ মানুষই অবিশ্বাস্য রকমের সরল, ভদ্র, মানবিক। দুর্নীতিগ্রস্ত শ্রেণি আছে—যেকোনো শহরের মতোই—এদের বেশিরভাগ রাজনৈতিক পচনের ফল; সংখ্যা খুবই কম। শহরের আসল শক্তি হলো সাধারণ মানুষ—যারা কঠোর পরিশ্রম করে, সততা ধরে রাখে, জীবনকে উদযাপন করে।
ঢাকার সমস্যা অগণিত, কিন্তু এর প্রাণশক্তি আরও বড়। এই শহর বেঁচে আছে মানুষের পরিশ্রম, সম্পর্ক, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের শক্তিতে।
কিন্তু বিশ্বমানের একটি শহর হতে হলে প্রয়োজন-দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সমন্বিত নগর পরিকল্পনা, পরিবেশ উন্নয়ন, দুর্নীতির অবসান, জনপরিবহন বিপ্লব, ফ্ল্যাটবদ্ধ আবাসন, নদী ও খালের পুনরুদ্ধার, প্রযুক্তিনির্ভর নগর ব্যবস্থাপনা।
ঢাকা একদিন অবশ্যই বদলাবে, আর আমরাও ফিরে পাবো এই শহরের বাসযোগ্যতার পূর্ণ স্বাদ, কারণ, এ যাদুর শহর তো আমারই শহর।
শাকুর মজিদ : স্থপতি, লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রনির্মাতা
shakoormajid25@gmail.com