খণ্ডিত বক্তব্যের নৈরাজ্য
ধরুন, আপনি কোনো সভায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। এতে আপনি কোনো একটি রাজনৈতিক দলের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বললেন, এই রাজনৈতিক দল রাজপথে মানুষ হত্যা করেছে। তারা খুনি। তাদের হাতে রক্তের দাগ।
এরপর আপনি আরও প্রায় ৬০ মিনিট বক্তব্য রাখলেন। যাতে এক পর্যায়ে অন্য প্রেক্ষাপটে বুঁনো শূকর বা বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় বলতে গিয়ে আপনি বললেন তাদের (শূকর বা বাঘকে) প্রয়োজনে গুলি করে মারতে হবে।
বিজ্ঞাপন
এখন কেউ যদি আপনার এই বক্তব্য, এই রাজনৈতিক দল মানুষকে রাজপথে হত্যা করেছে। তারা খুনি। তাদের হাতে রক্তের দাগ। এরপর … তাদের প্রয়োজনে গুলি করে মারতে হবে। তাহলে কী অর্থ দাঁড়াবে? সম্পূর্ণ অর্থই বদলে যাবে। তৈরি হতে পারে নৈরাজ্য ও এমনকি হামলা, হাঙ্গামা।
প্রযুক্তির সুপার হাইওয়েতে বিশ্বগ্রামের (Global village) বাসিন্দা একজন মানুষ এখন নেট নাগরিক (Netizen) হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। ইন্টারনেট দুনিয়ার মানুষ এখন অনেক কাছাকাছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একতাবদ্ধ। এছাড়া বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মানুষ উপভোগ করছেন অভূতপূর্ব সুযোগ ও স্বাধীনতা।
বিজ্ঞাপন
ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সারাবিশ্বে ভিডিও শেয়ারিং মাধ্যম ইউটিউব ব্যবহার করেন প্রায় ২৭০ কোটি মানুষ। প্রতিদিন মাত্র ২৪ ঘণ্টায় এই মাধ্যমে ভিডিও আধেয় আপলোড করা হয় ৭ লাখ ২০ হাজার ঘণ্টা। গুগলের পর ইউটিউব এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত সাইট। (YouTube statistics 2025)
অনেকেই জানেন তারপরও উল্লেখ করছি ইউটিউব এর মূল স্লোগান হলো নিজ সম্প্রচার (Broadcast Yourself)। শুধু ইউটিউব নয় বর্তমানে ফেসবুক, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামসহ প্রায় সব সামাজিক যোগাযোগ ও শেয়ারিং মাধ্যমই নিজেকে প্রকাশের বা নিজের মত প্রকাশের এক অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এতে মানুষ যেমন নিজের সৃজনশীলতা, মত ও দ্বিমত প্রকাশ করতে পারছেন ঠিক তেমনি উল্টো পিঠে তৈরি হয়েছে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত আপদ।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে সামাজিক যোগাযোগ বা ভিডিও শেয়ারিং মাধ্যমের নানাবিধ বিপদের মধ্যে অন্যতম ঘৃণা বক্তব্য প্রচার (Hate speech)। আর এই ঘৃণাবাক্য বা আধেয়র ভীতিকর রূপ হলো উদ্দেশ্যমূলক খণ্ডিত বক্তব্যে প্রচার। যাকে ইউনেস্কো উল্লেখ করছে উদ্দেশ্যমূলক খণ্ডিত বক্তব্য (tailored speech) হিসেবে।
বর্তমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভিডিও শেয়ার মাধ্যমগুলোয় এই খণ্ডিত বক্তব্যের বিপদ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। যাতে বিপন্ন হচ্ছে বহু মানুষের জীবন। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার, তৈরি হচ্ছে নানামুখী বিপদ। বিশেষ করে ধর্ম ও রাজনীতিভিত্তিক উদ্দেশ্যমূলক খণ্ডিত বক্তব্য কেন্দ্র করে জেল-জরিমানা, সংঘাত-সহিংসতা, মামলা-হামলা এমনকি প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটছে।
২০১৫ সালে ইউনেস্কো কাউন্টারিং অনলাইন হেট স্পিচ (Countering Online Hate Speech) শিরোনামের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। সংস্থাটির সংজ্ঞা অনুযায়ী, উদ্দেশ্যমূলক খণ্ডিত বক্তব্যের প্রচার এক ধরনের অপতথ্য (Disinformation)। যার লক্ষ্য থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তি, সমাজ, জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দল বা দেশের ক্ষতি সাধন করা।
শুধু ইউটিউব নয় বর্তমানে ফেসবুক, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামসহ প্রায় সব সামাজিক যোগাযোগ ও শেয়ারিং মাধ্যমই নিজেকে প্রকাশের বা নিজের মত প্রকাশের এক অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
মূলত এর মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘৃণা উৎপাদন করে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরা করা হয়। অনেকক্ষেত্রে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। সাধারণত এই ধরনের আধেয়র মাধ্যমে ধর্মীয় (religion), গোত্রগত (ethnicity), জাতিগত (nationality), বর্ণভিত্তিক (colour), লৈঙ্গিক (gender)-সহ নানা ধরনের সংস্কৃতি চর্চাকারী (Cultural group) ও ধর্মের অনুসারীকে (Faith or believers) শিকারে পরিণত করা হয়।
একইসাথে লক্ষ্য থাকে ভীতির এক পরিবেশ তৈরি করে মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা। অনেক সময় বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে শত্রুতা তৈরিতে (hostility) অপরাধীরা এর আশ্রয় নিচ্ছেন।
ইউনেস্কোর গবেষণা বলছে, ইন্টারনেটের কারণে এই প্রবণতা দ্রুততর ও সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করছে। যা অনেকক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করছে। প্রভাবিত করছে ভোটারদের। (Countering Online Hate Speech, 2015, Page:11)
ইউনেস্কোর এই গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের জরুরি সময় যেমন চলমান সহিংসতা ও সংঘাতের কাল (Ongoing Conflict), সামাজিক-রাজনৈতিক রূপান্তর (Social and political transition), জাতীয় নির্বাচন (national election), গণভোট (Referendum) ইত্যাদি সময়ে এই প্রবণতা বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন
২০২৩ সালে সংস্থাটি এ্যাড্রেসিং হেইট স্পিচ থ্রু এডুকেশন (Addressing hate speech through education) শিরোনামে আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই প্রকাশনায় ইউনেস্কো উল্লেখ করেছে, খণ্ডিত বক্তব্য বা বিভিন্ন মাধ্যমে তৈরি করা উদ্দেশ্যমূলক ঘৃণাবাক্যের মাধ্যমের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে (specifically targeted groups) একপক্ষভুক্ত (polarize), বিভক্ত (divide), উত্তেজিত (antagonize), ভীত-সন্ত্রস্ত (terrify) করে তোলা হয়। যার মাধ্যমে অশুভ স্বার্থ হাসিল করে নেয় অপরাধী চক্র। (Addressing hate speech through education:2023, page: 17)
এই ধরনের চর্চা মূল ধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (বিবিসি) একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান প্যানোরোমা। সাম্প্রতিক বিষয়ভিত্তিক অনুসন্ধানী ও বিশ্লেষণমূলক জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটি ১৯৫৩ সাল থেকে সম্প্রচারিত হচ্ছে। সম্প্রতি প্যানোরোমায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি উদ্দেশ্যমূলক খণ্ডিত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। যার ফলে পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান ডেবোরাহ টারনেস।
বিবিসি প্যানোরোমা ট্রাম্প: এ সেকেন্ড চান্স (Trump: A Second Chance?) শিরোনামের একটি তথ্যচিত্র সম্প্রচার করেছিল ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর। যাতে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটাল হিলের আইনসভা ভবনে বিস্ময়কর দাঙ্গাবাজির পটভূমিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বক্তব্য খণ্ডিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
তথ্যচিত্রটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের বক্তব্যটি দুই জায়গা থেকে কেটে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হয়। আর এই দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান ছিল ৫৪ মিনিটের। অর্থাৎ বিবিসির প্রযোজক উদ্দেশ্যমূলকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরাসরি আইনসভা ভবনে আক্রমণের উসকানিদাতা হিসেবে উপস্থাপিত করেছিল। যা ছিল গণমাধ্যম নীতিমালার লঙ্ঘন ও বেআইনি কাজ।
বলাই বাহুল্য, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সম্প্রচারিত এই তথ্যচিত্রের লক্ষ্য ছিল মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করা। যাই হোক, বিবিসির মতো পেশাদার একটি এহেন নীতি বিবর্জিত কাজের মাসুল এখনো দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ ঠেকাতে দেনদরবার করে যাচ্ছে বিবিসি।
...প্রতিটি বক্তব্য বা ভাষণের প্রেক্ষাপট থাকে, বিস্তৃত ব্যাখ্যা থাকে। সেখান থেকে দুই লাইন কেটে অন্য অংশের সাথে জুড়িয়ে দিলে সেই বক্তব্যের অর্থ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যাতে ঘটে বিপত্তি।
মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও মানুষের নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়ালে হরহামেশায় এমন খণ্ডিত বক্তব্যের আধেয় চোখে পড়ে। যাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাক্ষরতা ভালো তারা হয়তো এ রকম বক্তব্যের উদ্দেশ্য ধরতে পারেন। কিন্তু অনেকেই এসব বক্তব্যকে গ্রহণ করছেন প্রকৃত ও অকাট্য প্রমাণ হিসেবে।
মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিটি বক্তব্য বা ভাষণের প্রেক্ষাপট (Background) থাকে, বিস্তৃত ব্যাখ্যা (Elaboration) থাকে। সেখান থেকে দুই লাইন কেটে অন্য অংশের সাথে জুড়িয়ে দিলে সেই বক্তব্যের অর্থ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যাতে ঘটে বিপত্তি।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একটি সংবেদনশীল সময় পার করছে। আগামীর বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। তাই দেশে এখন বিবদমান পক্ষগুলো মরিয়া হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সবাই চেষ্টা করছে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতাসীন হতে অথবা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে।
এছাড়া বর্তমানে সমাজে বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীও সক্রিয় রয়েছে। যাদের কট্টর মতবাদ ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের সাথে অনেকেই একমত নন। ফলে দেশের রাজনীতি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রচারণায় চলছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যাতে হরহামেশাই ব্যবহার করা হচ্ছে খণ্ডিত বক্তব্য। আগামীর দিনগুলোয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগ্রামে এর ব্যবহার যে বাড়বে–নিঃসন্দেহে বলা যায়।
টেকসই গণতন্ত্র ও একটি সমন্বিত সমাজের জন্য ক্ষতিকর হুমকিস্বরূপ এই খণ্ডিত বাক্যের ঘৃণাবাক্য রোধে প্রয়োজন যথাযথ মাধ্যম জ্ঞান। আর বাংলাদেশ যে এই বিষয়ে অনেক পিছিয়ে তা সবারই জানা।
সহায়ক:-
১। Countering Online Hate Speech (2015) By UNESCO, Retrieved on 25-11-2025, https://unesdoc.unesco.org/in/documentViewer.xhtml?v=2.1.196&id=p::usmarcdef_0000233231&file=/in/rest/annotationSVC/DownloadWatermarkedAttachment/attach_import_ec25fcc4-72f7-46c4-a8f4-5ad6a018f697%3F_%3D233231eng.pdf&locale=en&multi=true&ark=/ark:/48223/pf0000233231/PDF/233231eng.pdf
২। Addressing hate speech through education (2023) By UNESCO and The United Nations, Retrieved on 25-11-2025, https://unesdoc.unesco.org/ark:/48223/pf0000384872/PDF/384872eng.pdf.multi
৩। BBC apologises to Trump over edited speech but rejects compensation claim. The Guardian, Retrieved on 25-11-2025, https://www.theguardian.com/media/2025/nov/13/bbc-apologises-to-donald-trump-over-edit-of-speech-for-panorama
৪। Youtube statistics 2025, Retrieved on 25-11-2025, https://www.globalmediainsight.com/blog/youtube-users-statistics/
রাহাত মিনহাজ : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়