সার ব্যবস্থাপনায় করণীয় কী?
বাংলাদেশের সার ব্যবস্থাপনা কৃষি উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দেশে প্রতি মৌসুমে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, ডিএপি ও জিপসামসহ বিভিন্ন সারের বিশাল চাহিদা থাকে। সরকার ভর্তুকি দিয়ে সার বিতরণ করে এবং বিএডিসি ও বেসরকারি খাত সরবরাহ চেইন পরিচালনা করে।
তবে অনেক সময় আমদানি বিলম্ব, পরিবহন সংকট, গুদামজাত ব্যবস্থার ত্রুটি, মাঠপর্যায়ে চাহিদা—সরবরাহের অসামঞ্জস্য এবং অসাধু মজুতদারির কারণে সংকট দেখা দেয়। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, সয়েল টেস্টিং, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর মনিটরিং নিশ্চিত হলে সার ব্যবস্থাপনা আরও স্থিতিশীল ও কৃষকবান্ধব হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের সার ব্যবস্থাপনা:
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন নির্ভর করে সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে সারের প্রাপ্যতার ওপর। বর্তমানে দেশে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, ডিএপি ও জিপসামসহ বিভিন্ন রাসায়নিক সার প্রধানত আমদানি ও রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোয় উৎপাদনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
বিজ্ঞাপন
সরকার কৃষকদের সহায়তার জন্য ভর্তুকি প্রদান করে সারের দাম তুলনামূলকভাবে কম রাখছে। তবে বাস্তবে সার ব্যবস্থাপনায় এখনো কিছু কাঠামোগত সমস্যা রয়ে গেছে, যা কৃষকদের মৌসুমভিত্তিক সংকটে ফেলছে।
সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা, আমদানি নির্ভরতা, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য ওঠানামা এবং পরিবহন জটিলতার কারণে কখনো কখনো মাঠ পর্যায়ে সার পৌঁছাতে দেরি হয়। তাছাড়া ডিলার, উপ-ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্বচ্ছ মজুতদারি ও অতিরিক্ত দামে বিক্রি করার প্রবণতা অনেক সময় সংকটকে তীব্র করে। সরকারি নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় কিছু এলাকায় ইউরিয়া না হলেও TSP, MOP ও DAP সারের দাম বাড়তি দেখা যায়।
বর্তমান সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE) সার বিতরণ তদারকি, তথ্যভিত্তিক চাহিদা নিরূপণ এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছে। ডিজিটাল সারের চাহিদা নিরূপণ, মাঠ পর্যায়ে নজরদারি বৃদ্ধি, হটলাইন চালু এবং অনিয়ম প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এসব উদ্যোগ সার ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর করছে। পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে জৈব সার, কম্পোস্ট এবং সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা (IPNS) ব্যবহার বাড়ানোর প্রচারণা চলছে।
সার সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা:
বাংলাদেশের ফসল চাষে সার অন্যতম প্রধান উপাদান। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সারের, যেমন TSP, MOP, DAP, জিপসাম সরবরাহ ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে প্রথমেই উঠে আসে সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা।
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য ওঠানামা, আমদানিতে দেরি, প্রয়োজনীয় সারের বিপণন চক্রে সমন্বয়হীনতা, এই সবকিছু মিলেই বাজারে সময়মতো সার পৌঁছায় না। ফলে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে ঘাটতি দেখা দেয়।
আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, সয়েল টেস্টিং, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর মনিটরিং নিশ্চিত হলে সার ব্যবস্থাপনা আরও স্থিতিশীল ও কৃষকবান্ধব হতে পারে।
আরেকটি কারণ হলো চাহিদা বৃদ্ধি। রবি মৌসুমে আলুর আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা একযোগে সার কিনতে ছুটে যান, কিন্তু সরবরাহ সেই অনুপাতে বাড়ে না। এতে বাজারে চাপ তৈরি হয় এবং দাম বেড়ে যায়। সেই সুযোগে মজুতদারি ও অতিরিক্ত দামে বিক্রি, এই অনৈতিক কার্যক্রম আরও পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। অনেক সময় ডিলার পর্যায়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যার ক্ষতি হয় মাঠের কৃষকের।
এছাড়া মাঠ পর্যায়ে পরিকল্পনার অভাব একটি বড় সমস্যা। সারের প্রয়োজনের সঠিক পূর্বাভাস, বণ্টন ব্যবস্থাপনা, ডিলার নির্বাচন ও মনিটরিংয়ে ত্রুটি থাকলে সারের ঘাটতি আরও তীব্র হয়। মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কৃষকদের সমন্বয় না থাকায় প্রকৃত চাহিদা নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে।
সার সিন্ডিকেট ও মজুতদারের দৌরাত্ম্য:
বাংলাদেশের কৃষিখাতে সার সরবরাহে সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের দৌরাত্ম্য বহুদিন ধরেই একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সরকার নির্ধারিত দামে সার দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে অনেক এলাকায় অসাধু ব্যবসায়ী, ডিলার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
মৌসুমের শুরুতে চাহিদা বাড়লে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সার মজুত করে রাখে, ফলে খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন মূল উৎপাদনকারী কৃষকরা, বিশেষত আলু, ধান, গম, ডাল ও সবজি চাষিরা। সার সিন্ডিকেট সাধারণত কয়েকজন ডিলার ও গুদাম মালিককে কেন্দ্র করে তৈরি হয়।
আরও পড়ুন
তারা একযোগে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃষকদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় কম সার বিতরণ করা, তালিকা অনুযায়ী কৃষককে না দেওয়া কিংবা অতিরিক্ত দাম দাবি করাও দেখা যায়। এতে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায় এবং সময়মতো সার প্রয়োগ না করায় ফসল উৎপাদনের ঝুঁকি তৈরি হয়।
সার সংকটে সুপারিশ ও করণীয়:
আমদানি নির্ভরতা কমানো, স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং দুর্নীতি রোধে কঠোর মনিটরিং জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে সার সংকট কমে গিয়ে কৃষি উৎপাদন আরও স্থিতিশীল হবে। এই সংকট মোকাবিলায় তিনটি পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।
প্রথমত, সরকারি তদারকি ও বাজার মনিটরিং শক্তিশালী করা, যাতে অনিয়ম, মজুতদারি ও অতিরিক্ত দামে বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
দ্বিতীয়ত, চাষিদের আগাম প্রস্তুতি ও পরিকল্পিত কেনাকাটা, যাতে মৌসুমের শুরুতেই চাপ না পড়ে।
তৃতীয়ত, জৈব সার ব্যবহারের সম্প্রসারণ, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নেয়।
সমন্বিত উদ্যোগই পারে চাষিদের সার সংকট দীর্ঘমেয়াদে মোকাবিলা করতে। সমাধানের জন্য সরকারি পর্যায়ে শক্তিশালী নজরদারি, গুদাম পর্যায়ের ডিজিটাল মনিটরিং, উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে সরাসরি কৃষক যাচাই ও বিতরণ ব্যবস্থা দরকার। পাশাপাশি চাষিদের সচেতনতা বাড়ানো, অনলাইনে অভিযোগ ব্যবস্থা সহজ করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ করলে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হবে। এতে কৃষকের ন্যায্য মূল্য ও খাদ্য নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে।
উন্নত দেশে সার ব্যবস্থাপনা:
উন্নত কৃষি প্রধান দেশ, যেমন নেদারল্যান্ডস, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি, সার ব্যবস্থাপনাকে শুধু উৎপাদনের উপাদান হিসেবে দেখে না; তারা একে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা, ডিজিটাল মনিটরিং এবং পরিবেশ সুরক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের সার ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার উৎস।
মাটি পরীক্ষাভিত্তিক সার পরিকল্পনা: উন্নত দেশগুলো বছরে নির্দিষ্ট সময়ে মাটির পুষ্টি পরীক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে করে। কোন জমিতে কোন উপাদান কতটা ঘাটতি, সেটা নির্দিষ্ট করে ‘Prescription Fertilizer Map’ তৈরি করা হয়।
সয়েল সেন্সর ও ডিজিটাল কৃষি: জাপান, নেদারল্যান্ডস ও আমেরিকায় IoT Soil Sensor, ড্রোন-ভিত্তিক NDVI ম্যাপিং এবং স্মার্টফোন অ্যাপ দিয়ে সার ব্যবস্থাপনা করা হয়।
আমাদের মাটির ধরন ও ফসলভেদে সুনির্দিষ্ট সার প্রয়োগ বাড়াতে হবে। মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি প্রসার ও কৃষকের ডিজিটাল প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। কৃষিতে শুধু নাইট্রোজেন নয়, অন্যান্য পুষ্টির ঘাটতি পূরণেও জোর দিতে হবে।
ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ: উন্নত দেশগুলো কেবল ইউরিয়া নয়; NPK, সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট, সব উপাদান ভারসাম্য রেখে ব্যবহার করে।
জৈব সার ও বায়োফার্টিলাইজারের ব্যবহার: নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে রাসায়নিক সার কমিয়ে জৈব সার, কম্পোস্ট এবং মাইক্রোবায়াল সার ব্যবহারে উচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সার মজুদের স্বচ্ছ সরবরাহ ব্যবস্থা: উন্নত দেশগুলোয় সার সরবরাহে ডিজিটাল ট্র্যাকিং, লাইসেন্সিং ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকে, যাতে সংকট, মজুতদারি বা অতিরিক্ত দাম, কোনোটিই না ঘটে।
কৃষক প্রশিক্ষণ ও এক্সটেনশন সার্ভিস: উন্নত দেশগুলোয় কৃষকের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ডেমো প্লট, অনলাইন কোর্স, এসবের মাধ্যমে সার ব্যবহারের জ্ঞান অর্জন সহজ।
পরিবেশ ও জলাশয় সুরক্ষায় সার প্রয়োগের বিধিনিষেধ: অনেক দেশে নৈর্ব্যক্তিকভাবে নির্ধারিত হয়, কখন সার দেওয়া যাবে, কতটুকু দেওয়া যাবে। পরিবেশ দূষণ হলে জরিমানা ব্যবস্থাও আছে।
আমাদের করণীয়
আমাদের মাটির ধরন ও ফসলভেদে সুনির্দিষ্ট সার প্রয়োগ বাড়াতে হবে। মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি প্রসার ও কৃষকের ডিজিটাল প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। কৃষিতে শুধু নাইট্রোজেন নয়, অন্যান্য পুষ্টির ঘাটতি পূরণেও জোর দিতে হবে। টেকসই কৃষির জন্য জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহারের প্রচলন বাড়াতে হবে।
আমাদেরও সার বিতরণে স্বচ্ছতা, ডিজিটাল মনিটরিং ও কঠোর তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে আরও আধুনিক প্রশিক্ষণ দরকার। কৃষির পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় নীতিমালা শক্তিশালী করা দরকার।
বৈজ্ঞানিক মাটি পরীক্ষা ও ফলনভিত্তিক সার সুপারিশ করা। সার সরবরাহ চেইনের ডিজিটাল মনিটরিং বাড়ানো; সয়েল সেন্সর, ড্রোন ও স্মার্টফার্মিং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো; জৈব সার উৎপাদন বাড়ানোসহ কৃষকের প্রশিক্ষণ জোরদার করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সার ব্যবস্থাপনা টেকসই কৃষি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে এখনো সরবরাহ ঘাটতি, বাজারে অস্থিরতা, মজুতদারি, পরিবহন দুর্বলতা ও মাঠ পর্যায়ের তদারকির অভাব বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চাহিদা পূর্বাভাস, স্বচ্ছ বিতরণ ব্যবস্থা, ডিজিটাল মনিটরিং, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও জৈব সার ব্যবহারের সম্প্রসারণ, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে সার সংকট কমবে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়বে। সর্বোপরি, সরকার-ব্যবসায়ী-কৃষক সমন্বিত কার্যক্রমই একটি স্থিতিশীল, ন্যায্য ও টেকসই সার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারে।
সমীরণ বিশ্বাস : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
srb_ccdbseed@yahoo.com