বাংলাদেশ ভূমিকম্প–ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়ায় সাম্প্রতিক ছোট ও মাঝারি মাত্রার কম্পনগুলো মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম স্পর্শকাতর অঞ্চলের একটি। জাতিসংঘের Global Seismic Risk Model (GSRM 2023) অনুসারে, বাংলাদেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ জনসংখ্যা মাঝারি থেকে উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বসবাস করে। ভূমিকম্পের মৌলিক কারণ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, কারণ বাংলাদেশ তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেট—ইন্ডিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মা মাইক্রোপ্লেট এর সংযোগস্থলে অবস্থিত (USGS, 2020)। ইন্ডিয়ান প্লেট বছরে প্রায় ৪-৫ সেন্টিমিটার উত্তরের দিকে সরে গিয়ে হিমালয়কে ঠেলে তুলছে, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের Shillong Plateau এবং Bangladesh Himalayan Foothill অঞ্চলে বিশাল পরিমাণ স্ট্রেস তৈরি করছে। এই প্লেট গতির কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় ফল্টগুলো বিশেষ করে ডাউকি ফল্ট, মেঘনা ফল্ট, চট্টগ্রাম-আরাকান ফল্ট অত্যন্ত সক্রিয় (Khan et al., Geological Survey of Bangladesh, 2017)।

ইতিহাসগতভাবে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্প ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৯৭ সালের গ্রেট আসাম ভূমিকম্প (Mw 8.1) ঢাকাসহ পূর্ববাংলায় ব্যাপক ক্ষতি করে এবং গবেষণা দেখায় যে এই ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী ফল্ট—Shillong Plateau megathrust—এ এখনো প্রচুর স্ট্রেইন জমা রয়েছে (Bilham & England, Nature Geoscience, 2001)। আবার ১৯১৮ সিলেট (7.6 Mw) ও ১৯৩০ Dhubri Earthquake (7.1 Mw) বাংলাদেশ অঞ্চলের ফল্টগুলোর ধারাবাহিক সক্রিয়তা নির্দেশ করে। Global Earthquake Model Foundation (GEM, 2022) জানায়, বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ৮.০ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু ও অবকাঠামো ধ্বংস।

নগরায়ণ ও দুর্বল বিল্ডিং কাঠামো বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC 2020) অনুসারে ঢাকা শহরের প্রায় ৭২ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প সহনশীল নয় (RAJUK Survey, 2019)। UNDP–RAJUK মাঠ জরিপ (2020) দেখায় যে ঢাকার প্রায় ৪৫ শতাংশ ভবন অনিয়মিত, নরম-স্টোরি, বা তরলীকরণ-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নির্মিত। Dhaka University Earth Observatory (2021) অনুযায়ী, ঢাকার নিচে সিল্ট, বালুময় ও পানি-ধারণক্ষম স্তরের কারণে liquefaction susceptibility ‘very high’ শ্রেণিতে পড়েছে, যা ভূমিকম্পে ব্যাপক ভবন ধসে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

এখন ভূমিকম্পের প্রতিকার বা ক্ষতি কমানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজন—অবকাঠামোগত প্রস্তুতি, সিসমিক মনিটরিং, কমিউনিটি প্রস্তুতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। বর্তমানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (BMD) সারা দেশে ২২টি সিসমিক স্টেশন পরিচালনা করে, যা দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম (BMD Annual Report, 2023)। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় কমপক্ষে ৫০-৬০টি স্টেশন প্রয়োজন যাতে রিয়েল-টাইম মনিটরিং আরও নির্ভুল হয়। এছাড়া সরকারের Earthquake Preparedness Programme (2022) অনুযায়ী, ঢাকায় এখনো পর্যাপ্ত সেফ ওপেন স্পেস নেই—নির্ধারিত প্রয়োজনের তুলনায় ৬৫ শতাংশ কম।

ভূমিকম্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর আরবান হেলথ (Urban Health)-এ প্রভাব। WHO এবং Asian Disaster Preparedness Center (ADPC 2022) জানায় যে বাংলাদেশে শহুরে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভূমিকম্প-পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত নয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার ৪২টি বড় হাসপাতালের মাত্র ৩০ শতাংশ ভূমিকম্প সহনশীল (World Bank Urban Health Assessment, 2021)। একটি ৭.৫Mw মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় ঘটলে ১,৫০,০০০-২,০০,০০০ মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু এবং ৬-৮ লাখ মানুষ গুরুতর আহত হতে পারে (JICA-RAJUK Earthquake Risk Study, 2020)। ফলে হাসপাতালগুলোয় surge capacity সংকট তৈরি হবে, যার ফলে রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব হয়ে উঠবে।

পানি-স্যানিটেশন ব্যবস্থায়ও ব্যাপক বিপর্যয় ঘটতে পারে। DWASA Earthquake Scenario (2022) দেখায়, ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৪০-৬০শতাংশ পানির পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, হেপাটাইটিস-এ বাড়াতে পারে। ভেঙে যাওয়া স্যানিটেশন লাইনের কারণে সংক্রমণ আরও দ্রুত ছড়াবে, বিশেষ করে বস্তি এলাকায়। ICDDR,B (2021) জানায়, ঢাকার বস্তি এলাকাগুলোয় পানিবাহিত রোগের হার সাধারণ সময়েও সাধারণ এলাকার তুলনায় ৩-৫ গুণ বেশি। ভূমিকম্প-পরবর্তী এই ঝুঁকি আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভূমিকম্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। WHO Mental Health Report (2022) অনুসারে, বড় ভূমিকম্প-পরবর্তী শহরাঞ্চলে PTSD ৩০-৪৫ শতাংশ, acute stress disorder ২০-৩০ শতাংশ এবং শিশুদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ফোবিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দেখা যায়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি মাত্র ০.73 জন সাইকিয়াট্রিস্ট প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য (DGHS Mental Health Survey, 2020)—ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

সবশেষে নারীদের স্বাস্থ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। UNFPA Bangladesh (2022) জানায়, দুর্যোগ-পরবর্তী সময় গর্ভবতী নারীদের ৩০ শতাংশ জরুরি চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভূমিকম্পে হাসপাতাল নষ্ট হলে maternal mortality rate বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। একইভাবে নবজাতকের ইনকিউবেটর, NICU, অক্সিজেন সাপোর্ট বন্ধ হয়ে গেলে infant mortality rate বাড়বে।

ভূমিকম্পের পর শহরের হাসপাতালগুলো পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারবে কিনা—এটি অত্যন্ত অনিশ্চিত। কারণ ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতাল এখনো ভূমিকম্প-সহনশীল নয়, ফলে ভবন ও জরুরি সেবা ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পাশাপাশি বেড, চিকিৎসক, বিদ্যুৎ-অক্সিজেন সরবরাহ ও অ্যাম্বুলেন্স সুবিধার ঘাটতির কারণে হঠাৎ রোগীর চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। গবেষণা অনুযায়ী, বড় ভূমিকম্পে শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দ্রুত অক্ষম হয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।

সর্বোপরি, ডাটা বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির দিক থেকে অত্যন্ত বিপদাপন্ন। প্লেট টেকটনিক স্ট্রেইন, সক্রিয় ফল্ট, দুর্বল ভবন কাঠামো, উচ্চ জনসংখ্যা ঘনত্ব, সীমিত স্বাস্থ্যসেবা এবং অপর্যাপ্ত জরুরি প্রস্তুতি এসব মিলে একটি বড় ভূমিকম্প দেশে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন, সিসমিক মনিটরিংয়ের উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর শক্তিশালীকরণ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। নইলে বাংলাদেশের আরবান হেলথ ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়বে।

রেফারেন্স:

* USGS (2020). Plate Tectonics and Seismicity.

* Bilham, R. & England, P. (2001). Nature Geoscience.

* Geological Survey of Bangladesh (2017). Earthquake Hazard Map.

* Global Seismic Risk Model (2023), UNDRR.

* RAJUK–JICA Earthquake Risk Study (2020).

* World Bank (2021). Urban Health System Assessment.

* ADPC (2022). Bangladesh Urban Disaster Risk Study.

* DGHS (2020). National Mental Health Survey.

* ICDDR,B (2021). Urban Health & WASH Report.

* DWASA (2022): Earthquake Vulnerability Assessment.

* UNFPA Bangladesh (2022). Maternal Health in Emergencies.

অভিজিৎ কুমার সিংহ : রিসার্চ অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
rco2.easd@gmail.com