সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে পর পর বেশ কয়েকদিন দেশে করোনায় আক্রান্তের হার রেকর্ড পরিমাণে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষত রাজধানীর বাইরে সীমান্তবর্তী এলাকার মফস্বল শহর এবং গ্রামাঞ্চলে এবারে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আঘাত হেনেছে। ধীরে ধীরে তা রাজধানীর দিকে ধাবিত হচ্ছে।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বিভাগীয় হাসপাতাল ছাড়া জেলা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের ঘাটতি, প্রয়োজনীয় লোকবলের সংকটে অসংখ্য মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন।

ভেন্টিলেটর, আইসিইউ বেড, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলাসহ আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অথচ মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবলীলায় ভুল তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। বাস্তবতা হলো, পর্যাপ্ত সময় হাতে পেলেও জেলা হাসপাতালগুলোকে করোনা উপযোগী করে ঢেলে সাজানো হয়নি।

এছাড়া কোথাও কোথাও করোনা টেস্ট করার প্রধান যন্ত্র আরটি-পিসিআর পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে, সাম্প্রতিক তৃতীয় ঢেউয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা আবারও দেখা গেল।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বিভাগীয় হাসপাতাল ছাড়া জেলা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের ঘাটতি, প্রয়োজনীয় লোকবলের সংকটে অসংখ্য মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ অর্থাৎ রোগীর সংখ্যা কমাতে সরকার ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন দিয়েছে। এতে করে সাময়িক হয়তো কিছুটা সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে। কিন্তু করোনা মহামারি সহসাই আমাদের ছেড়ে চলে যাবে না। জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আবারও ভিন্ন ভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হবে।

করোনার ডেল্টা প্লাস এবং পেরুতে উদ্ভব ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টকে আমাদের সামনে মোকাবিলা করতে হবে। করোনার মোকাবিলার এখন পর্যন্ত একমাত্র হাতিয়ার গণটিকাদান কর্মসূচি। টিকা প্রদানের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প পন্থা নেই।

ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে প্রাপ্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে দেশের প্রায় ৫৮ লক্ষ মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এজন্যে সরকারকে সাধুবাদ জানাই। বয়স্ক, সম্মুখ সারির যোদ্ধা, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে টিকা নেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল। ফলে শহরের মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তের সবাই মোটামুটি সেই টিকার ডোজ নিতে পেরেছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় পর্যায়ে চীনের সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার মিলিয়ে প্রায় ৪৫ লক্ষ টিকা আমাদের হাতে এসেছে, যা বিতরণও শুরু হয়েছে। তবে টিকা নেওয়ার হারে কিছুটা শিথিলতা এসেছে।

দ্বিতীয় ডোজসহ প্রথম পর্যায়ে যারা টিকা নেয়নি বা পায়নি, তারা এবার টিকা নিতে পারবেন। আশঙ্কা হচ্ছে, ব্যাপক প্রচার প্রচারণা সত্ত্বেও শহর এবং গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী এখনো টিকা নেওয়ার ব্যাপারে উদাসীন। অন্যদিকে করোনা থেকে প্রতিরক্ষার একমাত্র সম্বল মাস্কের ব্যবহার দিন দিন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসছে। এমনকি শহরাঞ্চলের শ্রমিক, মজদুর, রিকশাচালক থেকে শুরু করে বস্তিবাসী দরিদ্রদের মাঝেও টিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং মাস্কের ব্যবহার আশাব্যঞ্জক নয়। ফলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণে এই শ্রেণির মানুষজন এবার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

করোনার মোকাবিলার এখন পর্যন্ত একমাত্র হাতিয়ার গণটিকাদান কর্মসূচি। টিকা প্রদানের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প পন্থা নেই।

তাই, টিকা প্রদানের বিষয়ে আমাদের একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। সরকার ৩৫-ঊর্ধ্ব বয়সীদের জন্যও টিকা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, বয়স্ক রোগীরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। তাই, সুবিধাবঞ্চিত বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে আমাদের টার্গেট করতে হবে।

অনলাইনে সুরক্ষা অ্যাপসের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণি কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে কি না ভেবে দেখতে হবে। দুর্বল ইন্টারনেটের সংযোগ এবং ডিভাইসের অভাবে গ্রামাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে স্বভাবতই পিছিয়ে পড়ছে। তাই, টিকাদান কর্মসূচিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া যায় কি না ভেবে দেখা যেতে পারে।

শুধুমাত্র এনআইডি সাথে এনে হাসপাতালগুলোতে টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি হাসপাতালে অন-স্পট রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা বাড়িয়ে বা এনআইডি স্ক্যান মেশিন বসিয়ে দ্রুত টিকাদানের বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব।

এছাড়া টিকা সংগ্রহের জন্যে সরকার বিভিন্ন দেশে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে প্রচুর টিকার প্রয়োজন। এজন্য দেশেও টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে কারণ দেশীয় অন্তত তিনটি ওষুধ কোম্পানির সেই সক্ষমতা রয়েছে। উক্ত বিষয়ে রাশিয়ার স্পুটনিক এবং চীনের সিনোফার্মের টিকা দেশে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় চুক্তিমালা দ্রুত সম্পাদন করা উচিত।

করোনার দেড় বছরে আমরা একটি আন্তর্জাতিক মানের ভ্যাকসিন ইন্সটিটিউট উপস্থাপন করতে পারতাম। সেটিও করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি ভ্যাকসিন গবেষণা এবং উৎপাদন ইন্সটিটিউট স্থাপন সময়ের দাবি।                        

ড. মো. আব্দুল মুহিত ।। সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়