গেল সপ্তাহে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সাথে ছোট পরিসরে আলোচনায় বসেছিলাম। প্রায় ২২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এমন আলোচনায় অংশগ্রহণের তেমন কোনো সুযোগ আমার হয়নি। তবে, এ ধরনের সুযোগ নেওয়ার ইচ্ছা কখনো ছিল না। যা হোক, যেকোনো কারণেই ওই দিন এক ঘণ্টারও বেশি সময় আমি আলোচনায় অংশ নিই। আলোচনার প্রায় শেষ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন কর্তাব্যক্তির অপকট স্বীকারোক্তি আমাকে আন্দোলিত করেছিল।

আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, তিনি উপাচার্যকে নাকি কিছু উপদেশ দিয়েছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইদানীংকালের উপাচার্যগণ দুটি কাজ করেন। একটি হলো নিয়োগ। আর দ্বিতীয়টি হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। তার অভিজ্ঞতায় এসব ক্ষেত্রেই যত ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। এ কারণে তিনি ওই দুটি কাজ না করে বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক কার্যক্রমকে বেগবান করতে উপাচার্যকে পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।    

আসলে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি অর্থাৎ উপাচার্যদের নিয়ে গণমাধ্যমে যা দেখতে পাচ্ছি তাতে লজ্জিত হওয়া ছাড়া উপায় আছে বলে মনে হয় না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের একজনের স্বীকারোক্তি তারই প্রমাণ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এমনটি কেন হচ্ছে?

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত তো এমনটি দেখা যেত না। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সম্পর্কে গণমানুষের ভিন্ন ধারণা ছিল। উপাচার্যগণ ছিলেন নমস্য। উপাচার্য কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো একজন শিক্ষকই ছিলেন মানুষের কাছে শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আজ উপাচার্যদের এমন কর্মকাণ্ড যে শুধু তাদের ব্যক্তিগতভাবে হেয় করছে তা-ই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতে করে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা হুমকির মধ্যে পড়ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ পর্যন্ত ১২টির অধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনিয়ম তদন্ত করেছে এবং ইতিমধ্যেই পাঁচটির অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম সম্পর্কিত রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা উপাচার্যদের অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে। গত মার্চ মাসে ইউজিসির একজন সম্মানিত সদস্য গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উপাচার্যদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আসে তার ৮০ শতাংশের বেশি আর্থিক। আর অবশিষ্ট অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ সংক্রান্ত। 

উপাচার্যদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আসে তার ৮০ শতাংশের বেশি আর্থিক। আর অবশিষ্ট অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ সংক্রান্ত।

সম্প্রতি ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ২৪ ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। এসব অনিয়মের মধ্যে এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয়, টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। সবচেয়ে বড় অনিয়ম, যা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে ঘটেছে, তা হলো অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া, ইউজিসির অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়ে ইচ্ছামতো শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে ইউজিসি পরিপত্র জারি করলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে উপাচার্যগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোকে আমলেও নেননি।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী পদে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়মের কারণ হিসেবে উপাচার্যদের জবাবদিহিতার অভাবের বিষয়টিকেই অনেকাংশে দায়ী করতে হয়। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের আইনগত প্রক্রিয়া থাকলেও ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের (১/২টি বাদে) প্রায় সব কটিতেই উপাচার্য নিয়োগে সরকারের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার কথা। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩ (পরবর্তীতে আইন হয়েছে) অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ভোটাভুটির মাধ্যমে উপাচার্য হিসেবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করলে চ্যান্সেলর হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন এমন নিয়ম রয়েছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা পরিচালিত আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়মের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় না। বরং নগর-মহানগরের দলীয় নেতৃবৃন্দ, আমলা কিংবা

উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্রীড়নক হয়ে উঠেছেন বলে শোনা যায়।
১৯৭৩ সালের অ্যাক্টে পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদেও অন্য প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয় তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি পরিস্থিতিতে সত্য প্রকাশের ঐতিহ্য থাকলেও আজ তা প্রায় নিঃশেষিত। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী কর্তৃক গুলি চালানোর প্রতিবাদে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী পদত্যাগ করেছিলেন।

আবার ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৬-২০০৮) রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা (পরবর্তীতে রাজশাহীসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে, বর্তমানে সেই অবস্থা তেমন একটা চোখে পড়ে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় তথা জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অধিকাংশ শিক্ষককেই মুখ বুজে থাকতে দেখি।

মাত্র ২০ বছর আগেও উপাচার্যের সাথে দেখা করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে এসে ধরনা দিতেন। ২০ বছরের ব্যবধানে সে সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ রক্ষা তথা ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় যতটা তারা সোচ্চার, তার চেয়ে উপাচার্য হওয়ার অদম্য বাসনা চরিতার্থ করার ঘোড়দৌড়ে কীভাবে এগিয়ে থাকা যায় সেদিকেই তারা অধিক মনোযোগী। ঘোড়দৌড় শেষে উপাচার্যের পদে আসীন হয়ে তাদের অনেকেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ারে পরিণত হন। তারা নিজেরাও স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কীভাবে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা যাবে সেদিকে নজর না দিয়ে নিয়োগে সহায়তা করেছেন এমন নেতৃবৃন্দের ইচ্ছাদাসে পরিণত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়োগের কারখানা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উপাচার্য নিয়োগে দলীয় আনুগত্য, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সখ্য, চাটুকারিতা ইত্যাদি নিয়ামক হয়ে ওঠায় সকলে এ সুযোগটাই নেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারককারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউজিসিও দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ইউজিসি অন্তত ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পেশ করলেও দুর্নীতিগ্রস্ত উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, সরকার সেসব উপাচার্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
সিনিয়র শিক্ষকদের অনেকের কাছে গল্প শুনেছি যে, মাত্র ২০ বছর আগেও উপাচার্যের সাথে দেখা করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে এসে ধরনা দিতেন। ২০ বছরের ব্যবধানে সে সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সমাজের তথা দেশের বাতিঘর হওয়া সত্ত্বেও সমাজের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কাতারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নাম লিখিয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকাকে যেভাবে সচল রেখেছেন, তা টেকসই করার লক্ষ্যে শিক্ষার উপর নজর দেওয়া প্রয়োজন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতেন, সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষায় বিনিয়োগের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ আর নেই। অনেকেই বলেন, শিক্ষায় নাকি ১ টাকা বিনিয়োগ করলে ১৯ গুণ সুফল পাওয়া যায়, যেখানে কারখানায় পাওয়া যায় ৫.৪০ টাকার সুফল।

আর শিক্ষাক্ষেত্রে এই সুফল পেতে হলে সৎ, দক্ষ, যোগ্য, সজ্জন, দায়িত্ববোধসম্পন্ন, নির্লোভ, একাডেমিক অধিকাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। সে কারণে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়