মেসি গাইলেন, মেসি হাসলেন; একটু বোধহয় কাঁদলেনও। গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে উন্মাতাল শিশু হয়ে গেলেন সতীর্থদের সাথে মিশে। যেন আপনভোলা এক যোগী তার যজ্ঞের মোক্ষ লাভ করেছে।

কিন্তু কী পেয়েছেন মেসি?

‘সামান্য’ একটা কোপা আমেরিকার ট্রফি। দশ দলের এক টুর্নামেন্ট। যেখানে বেশিরভাগ দলই বিশ্বমানের না। যে কোপাকে আজকাল লোকেরা আর ‘মেজর’ ট্রফি বলে মানতেই রাজি না। সেই কোপা জিতে মেসি কেন এমন উন্মাতাল! কারণটা লুকানো আছে মহাকালের গর্ভে।

আপনাকে ফুটবল বিশ্বের গত দুই দশকের ইতিহাস পাঠ করতে হবে। বুঝতে হবে একজন ফুটবলার সবদিক থেকে সর্বকালের সেরাদের একজন হয়েও কী করে একটা ট্রফির জন্য সেই তালিকায় নাম লেখাতে পারছিলেন না। বলা ভালো, তার নামের পাশে একটা প্রশ্ন চিহ্ন বসেছিল এই একটা আন্তর্জাতিক ট্রফির অভাবে। অবশেষে বয়সের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে সেই ট্রফিটাকে আপন করে কোলে জড়িয়ে নিলেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।

না, এতে মেসি এক রাতে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হয়ে গেলেন না। কিন্তু বালখিল্য লোকেদের তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গাটা একটু হলেও সংকুচিত হয়ে আসবে।

কোপা জিতে মেসি কেন এমন উন্মাতাল! কারণটা লুকানো আছে মহাকালের গর্ভে...

অথচ মেসি এই মহাবিশ্বে এসেছিলেনই কেবল জিততে। বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপ জিতেছেন, অলিম্পিক সোনা জিতেছেন। আর ক্লাবে পা রাখার পর থেকে তো কেবল জয় আর জয়।

বার্সেলোনার হয়ে এক গাদা লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগসহ গুনে গুনে ৩৪টা ট্রফি জিতেছেন। নিজে ৬ বার বিশ্ব সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জিতেছেন। ৬ বার ইউরোপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। এতো সব অর্জনের পর তাকে নিয়ে প্রশ্ন থাকার কোনো কারণ ছিল না। প্রশ্নটা থেকে গেল ওই জাতীয় দলের জার্সির জন্য।

২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চেষ্টা করেছিলেন। হোসে পেকারম্যানের দল কী সুন্দর ফুটবলটাই না খেলল! কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল পার করা হলো না। ২০০৭ কোপা আমেরিকাতেই ট্রফি আসবে বলে যেন সব ঠিক ছিল। কিন্তু উড়তে থাকা আর্জেন্টিনা ফাইনালে হেরে গেল খোঁড়াতে থাকা ব্রাজিলের বিপক্ষে। ২০১০ বিশ্বকাপে অনিন্দ্য সুন্দর ফর্মে মেসি ও আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার খামখেয়ালিতে হলো না সেবার।

২০১৪ বিশ্বকাপে অবশেষে আর্জেন্টাইন কোচ আলেসান্দ্রো সাবেলা মেসিকে নিয়ে সর্বোচ্চ আসনের দিকে ছুটলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে গিয়ে হিগুয়েনদের শিশুসুলভ ব্যর্থতায় ট্রফি অধরা রইল। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে পরপর দুটি কোপা ফাইনালে টাইব্রেকারে চিলির বিপক্ষে হার। ২০১৮ বিশ্বকাপে পরাক্রমশালী ফ্রান্সের বিপক্ষে সামান্য ব্যবধানে হার। ট্রফিটা যেন দূরের জিনিসই রয়ে যাচ্ছিল।

মেসি এই মহাবিশ্বে এসেছিলেনই কেবল জিততে। বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপ জিতেছেন, অলিম্পিক সোনা জিতেছেন। আর ক্লাবে পা রাখার পর থেকে তো কেবল জয় আর জয়।

এদিকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তার পর্তুগাল নিয়েও একটা ইউরো ট্রফি জিতে ফেললেন। ফলে মেসির জন্য আন্তর্জাতিক ট্রফি ব্যাপারটাই এক অভিশাপের নাম হয়ে গেল। এই প্রসঙ্গটা উঠলেই চুপসে যায় সব আলোচনা। তিনি যে ৫টি মেজর ফাইনালে দলকে তুলেছেন, বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে; এসব কথাও লোকেরা মনে রাখতে চাইল না। কেবল একটা কথা, ওর তো ট্রফি নেই। এই একটা ট্রফির জন্য জীবনটাই যেন বাজিতে ধরে দিয়েছিলেন।

ইকুয়েডরের বিপক্ষে হ্যামাস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়েছিলেন। সেই ইনজুরি নিয়েই খেলে গেছেন। দুটো ম্যাচ অসহ্য ব্যথা সহ্য করেছেন। কাউকে টের পেতে দেননি। ফাইনালের আগে ডি মারিয়াকে সেই ২০১৪ ফাইনালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘তুমি সেদিন খেলতে পারোনি। একটা ফাইনাল তোমার নামে লেখা আছে।’

ডি মারিয়া তেতে উঠলেন। বুঝলেন, মেসির ফাইনালটা আসলেই তার নামে লেখা। তিন ফুসফুসের ডি মারিয়ারও বয়স হচ্ছে। আগের মতো প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ছারখার করে দিতে পারেন না। গোল দেখা হয় না তো কতদিন হয়ে গেল। সেই ডি মারিয়াই আরেকবার জ্বলে উঠলেন। ছারখার করে দিলেন ব্রাজিলের রক্ষণ। বল জড়াল জালে। ইতিহাস হয়ে গেল। অবশেষে মেসির কোলে এলো ট্রফি।

হ্যাঁ। এরপরও হয়তো কারো কারো সাথে মেসির তুলনা হবে। একটা বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা থেকেই যাবে। কিন্তু মেসির কবরে অন্তত ‘ক্লাব গ্রেট’ লেখা হবে না। অন্তত এটা বলে দেওয়া হবে যে, তিনি একজন আর্জেন্টাইন ছিলেন।

দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ।। এডিটর ইন চিফ, খেলা ৭১