হাতকড়া হাতে গণমাধ্যম হাঁটে
বাম হাতে হাতকড়া পরানো। হাসপাতালের লোহার বিছানার সঙ্গে এভাবে আটকে রাখা ব্যক্তিটি কোনো হত্যা মামলা বা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নন। তিনি একজন গণমাধ্যমকর্মী। নাম তানভির হাসান তানু। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কয়েকটি গণমাধ্যমে কাজ করেন।
কিন্তু কেন তার হাতে হাতকড়া পরানো? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শনিবার (১০ জুলাই) রাত ৮ টায় তাকে গ্রেফতার করে ঠাকুরগাঁও সদর থানা পুলিশ। সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নাদিরুল আজিজের দায়ের করা মামলায় তানুকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও পরদিন বিকেলে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
বিজ্ঞাপন
‘দিনে বরাদ্দ ৩০০ হলেও করোনা রোগীদের খাবার দেয়া হচ্ছে ৭০ টাকার!’ শিরোনামে গত ৫ জুলাই অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘জাগো নিউজ২৪ ডটকম’এ একটি নিউজ প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে করোনা ওয়ার্ডে থাকা রোগীদের অভিযোগ ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কেরও মন্তব্য সংযুক্ত ছিল।
প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ১০ জুলাই করা মামলায় তানভির হাসান তানু ছাড়াও আরও দুই জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ লিটু ও নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি রহিম শুভ। তানভির হাসান জাগো নিউজ ছাড়াও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি ও দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১)(ক) ২৫(১)(খ) ২৯(১)/৩১(১)/৩৫(১) ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
গ্রেফতার ও হাতকড়া পরানো
সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তানভির। গত ১০ জুলাই করোনা নেগেটিভ আসে তার। ১০ জুলাই তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলার খোঁজ নিতে তানভির সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) রুমে গেলে তাকে সেখানেই গ্রেফতার করা হয়। করোনা থেকে সুস্থ হলেও শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন তানভির।
তানভির কি কোনো দুর্ধর্ষ আসামি? তাকে কেন হাতকড়া পরানো হয়েছে? দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় আজ তাকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় তানভির অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাতকড়া পরিয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শয্যার সঙ্গে তার বাম হাত হাতকড়া দিয়ে আটকে রাখা হয়। এমনকি পরদিন আদালতেও নিয়ে যাওয়া হয় হাতকড়া পরিয়ে। সেই ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে শুরু হয় সমালোচনা।
হাতকড়া পরানো নিয়ে অনেকে বলেছেন, তানভির কি কোনো দুর্ধর্ষ আসামি? তাকে কেন হাতকড়া পরানো হয়েছে? দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় আজ তাকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
একজন মানুষ যদি ‘দুর্ধর্ষ’ ও ‘দাগি আসামি’ না হয়, তাহলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার সময় হাতকড়া পরাতে পারে না পুলিশ।
‘পুলিশ প্রবিধানমালা, বেঙ্গল-১৯৪৩’-এর ৩৩০ (এ) ধারায় এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হয়েছে, ‘হাতকড়া কিংবা রশি ব্যবহার একটি অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদার ঘটনা’।
সাংবাদিক নেতার মন্তব্য
তানভির হাসান তানুকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন। ‘সাংবাদিককে হ্যান্ডকাফ কেন?’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে করোনা রোগীকে ৩০০ টাকার পরিবর্তে ৭০ টাকার খাবার দেওয়া হয়’ মর্মে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। সংবাদটির জের ধরে হাসপাতালের পরিচালক সদর থানায় আইসিটি আইনে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় সাংবাদিক তানভির হাসান তানুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তানু অসুস্থ হয়ে পড়লে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘তানু কি কোনো দুর্ধর্ষ মামলার আসামি, যে তাকে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় হাসপাতালে রাখতে হবে? স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করলেই তাকে মামলা হামলা করে হেনস্তা হতে হচ্ছে। এ কেমন কথা? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এমন অপব্যবহার আমরা দেখতে চাই না। অবাধ তথ্য প্রবাহে বাধা তৈরি করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হামলা করে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পেছনে কারা আছে খুঁজে দেখতে হবে। জনগণকে তথ্য দেওয়ার জন্য শাস্তি না দিয়ে দুর্নীতিবাজদের খুঁজে বের করতে হবে।’
সাংবাদিক নেতা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গণমাধ্যমকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যমুনা টেলিভিশনের ময়মনসিংহ ব্যুরো প্রধান হোসাইন শহীদ তার ফেসবুকে তানভির হাসানের হাতকড়া পরানো একটি ছবি শেয়ার দিয়ে ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘জানলে দোষ নাই, জানাইলেই দোষ।’
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শরিফুল হাসান তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ছবিটা দেখেই বুক কেমন করে। ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন ও দৈনিক ইত্তেফাকের জেলা প্রতিনিধি তানভীর হাসানের ছবি এটি। তার অপরাধ কী শুনবেন? ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে রোগীদেরকে ৩০০ টাকার পরিবর্তে ৭০ টাকার সমপরিমাণ খাবার দেওয়া হচ্ছিল। এটা নিয়ে নিউজ করার অপরাধে তানুকে আইসিটি অ্যাক্টের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে।’
২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ১০৮টি। এ সব মামলায় মোট আসামি ২০৪ জন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ৪৪ জন...
তিনি আরও লিখেছেন, ‘বেদনার বিষয় হলো, স্ত্রীসহ অনেকদিন করোনা পজিটিভ ছিল তানুর। গতকাল সকালেই নেগেটিভ হয়েছেন। এরপর রাতে গ্রেপ্তার। শ্বাসকষ্টে ভোগার পর গভীর রাতে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে এভাবে বেঁধে রাখা হয়।’
মনোবল হারাননি তানভিরের বড় ভাই
তানভির হাসান তানুর বড় ভাই মাহবুর আলম সোহাগ। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট ডটকমের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছোট ভাই গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি মনোবল না হারিয়ে সবাইকে পাশে থাকার আহ্বান জানান। জেলা পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে একই জেলায় তিনিও মামলার শিকার হয়েছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা ও বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘২০১৪ সালে মন্ত্রী থাকাকালীন আমার বিরুদ্ধে নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছেন। কিছু হয়েছে? হয়নি। বরং আমি আমার শ্রম ও সততা দিয়ে এগিয়ে চলছি। আজ আমার ছোট ভাই তানুকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা করালেন। ওই মামলায় তানুকে গ্রেফতারও করালেন।’
তিনি আরও লিখেন, ‘তানু চুরি করতে গিয়ে ধরা খায়নি। জনগণের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। এতে ভাই হিসেবে গর্ববোধ করছি। বিশ্বাস করেন এ ঘটনায় আমি, তানু ও আমার পরিবারের কেউ ভয় পাইনি। সত্যের পথে থাকলে এমন বাধা আসবে, স্বাভাবিক। তবে দেশের মানুষ অন্যায়ের জবাব দিতে জানে। সেই জবাব হজম করার শক্তি আপনার নেই। থাকলে একই বাবার দুই সন্তানের বিরুদ্ধে এভাবে লাগতেন না। যা হোক, এ সব হয়রানি সাময়িক। আমরা দুই ভাই কুলিয়ে উঠব।’
গ্রেফতারের পরদিন মিলল জামিন
রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তানভিরকে ঠাকুরগাঁও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ডালিম কুমার রায় পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। অন্যদিকে তার আইনজীবী আরিফ রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় ঠাকুরগাঁও সিনিয়র চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আরিফুর রহমানের আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন পাওয়ার পর তানভির তার ফেসবুক একাউন্টে লিখেছেন, ‘সত্যের জয় হয়ছে। ধন্যবাদ সকলকে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও গ্রেফতার
ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর রয়েছে। প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে- আর্টিকেল ১৯-এর তথ্যানুযায়ী, ‘২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ১০৮টি। এ সব মামলায় মোট আসামি ২০৪ জন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ৪৪ জন, আর অন্যান্য পেশায় কর্মরত ও সাধারণ মানুষ ১৬০ জন। এই হিসেবে প্রায় ২৫ ভাগ আসামিই হলেন সাংবাদিক।’
অপূর্ব ইব্রাহীম।। সাংবাদিক