গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বের ৮০টি দেশের গণমাধ্যম একযোগে ‘ফিনসেন ফাইলস’ নামের একটি অনুসন্ধান প্রকাশ করে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে, নামকরা বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে মাদকের কারবারি, দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক, অস্ত্র ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের মুদ্রা পাচারে সহায়তা করেছে। এই অনুসন্ধানের সূত্রপাত ২ লাখ সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেনের ডাটা থেকে, যা সবার আগে হাতে পেয়েছিল বাজফিড নিউজ। তারা সেই তথ্য শেয়ার করে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস-আইসিআইজের সাথে। তারপর আইসিআইজের নেতৃত্বে ১০৮টি গণমাধ্যমের ৪০০জন সাংবাদিক নেমে পড়েন ডাটা বিশ্লেষণ এবং মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে। এই কোলাবরেটিভ বা জোটবদ্ধ সাংবাদিকতা প্রকল্পে ভারত, পাকিস্তান এবং এমনকি নেপালের গণমাধ্যমগুলোও কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছিল না।

এর আগেও বিশ্বে বড় বড় অনেক জোটবদ্ধ অনুসন্ধান হয়েছে। আইসিআইজের পানামা পেপারস-ই হোক বা এশিয়ার আলোচিত প্যাঙ্গোলিন রিপোর্টস – অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বৈশ্বিক মানচিত্রে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের অবস্থান নেই বললেই চলে। এর মানে এই নয়, বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মান উন্নত নয়। এদেশের বার্তা কক্ষে স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ আছে, মালিকানা বা কর্পোরেট স্বার্থের চাপ আছে, মামলার জুজু আছে–তারপরও অনেক ভালো এবং বড় অনুসন্ধান হচ্ছে। অনেকটা পেশাগত কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং নেটওয়ার্কগুলোর সাথে যে যোগসূত্র, তাতে একথা বলতেই পারি, অন্য অনেক দেশের তুলনায় (এবং ফিনসেন ফাইলসে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অংশের তুলনায় তো বটেই) বাংলাদেশের গণমাধ্যমে উন্নততর অনুসন্ধান প্রকাশ হতে দেখেছি।

‘ফিনসেন ফাইলস’ অনুসন্ধানে আইসিআইজের নেতৃত্বে ১০৮টি গণমাধ্যমের ৪০০জন সাংবাদিক মাঠে নামেন। জোটবদ্ধ সাংবাদিকতা প্রকল্পে ভারত, পাকিস্তান এবং এমনকি নেপালের গণমাধ্যমগুলোও কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছিল না।

তাহলে কেন বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আড়ালে রয়ে গেল? গত কয়েক বছরে গণমাধ্যম উন্নয়ন এবং অনুসন্ধানী নেটওয়ার্কগুলোর সাথে কাজের যে অভিজ্ঞতা, সেখান থেকে কয়েকটি কারণ আমার কাছে বড় বলে মনে হয়েছে। প্রথমত, আমাদের দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখনো “ওল্ড ফ্যাশন্ড”, অর্থাৎ পুরানো ধাঁচের। জুতোর তলা ক্ষয় করে সোর্সের কাছ থেকে নথি বের করা, মাঠে মাঠে ঘুরে সরেজমিনে চিত্র তুলে আনা, সেগুলোকে জুড়ে একটি গল্প তৈরি করা—এই ধাঁচের “ওল্ড ফ্যাশন্ড” অনুসন্ধানের আবেদন সব দেশেই থাকে, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বিশ্ব শুধু এই এক জায়গায় থেমে নেই।

গত দুই দশকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক ধরনের বিশ্বায়ন হয়েছে। এখন অনুসন্ধানী প্রকল্পের জন্য যে, শুধু আন্তর্জাতিক জোট-ই হচ্ছে, তা নয়। স্টোরির প্রয়োজনে প্রতিযোগিতা ভুলে কখনো একটি দেশের একাধিক গণমাধ্যম, কখনোবা একটি অঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান জোট বেঁধে কাজ করছে।

আফ্রিকার দেশ উগান্ডার কথাই ধরুন। সেখানকার ছোট গণমাধ্যম ইনফো-নাইল নীল নদের পাড় দখল নিয়ে যে অনুসন্ধান করেছে, তাতে ১১টি দেশের সাংবাদিক, ডাটা সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান কোড ফর আফ্রিকা, এমনকি পুলিৎজার সেন্টারও অংশ নিয়েছে। অথবা দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলার কথাই ধরুন। দেশটির তিনটি প্রতিষ্ঠান জোটবদ্ধ হয়ে বের করেছে, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে কীভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিচারে কিন্তু দেশটির অবস্থান আমাদের কাছাকাছিই।

এই কোলাবরেটিভ বা জোটবদ্ধ সাংবাদিকতা এদেশের বার্তা কক্ষ-সংস্কৃতিতে এখনো জায়গা করে নিতে পারেনি। দেশের পাঁচটি গণমাধ্যম একসাথে কোনো অনুসন্ধান করেছে, এটি এখনো চিন্তা করা যায় না। জোট বাদ-ই দিলাম। একটি গণমাধ্যমেরই একাধিক সাংবাদিক মিলে একটি অনুসন্ধানী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন, এমন নজিরও হাতে গোনা। টেলিভিশনগুলোতে অনুসন্ধানী বা অপরাধকেন্দ্রিক যে অনুষ্ঠান হয়, তাতে এক ধরনের দলীয় কাজের সংস্কৃতি দেখা যায়। কিন্তু সেখানেও দল নেতা বা সম্পাদকের অংশগ্রহণ বাদ দিলে বেশিরভাগ রিপোর্টার একাই আইডিয়ার জন্ম দেন, তিনিই সব তথ্য জোগাড় করেন এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি না থাকলে একাই অনুসন্ধান করেন। সেখানে একটি অনুসন্ধানকে পাকাপোক্ত করার জন্য প্রযোজক বা চিত্রগ্রাহকের ভূমিকা এখনো সামান্যই বলা চলে। আর পত্রিকায় তো অনুসন্ধানী দল গড়ে তোলার সংস্কৃতিই তৈরি হয়নি। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশে অনুসন্ধান এখনো ব্যক্তিনির্ভর। দলে অনুসন্ধান না হলে, দুই ধরনের সমস্যা হয়। প্রথমত, জ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে নবীনদের শেখার সুযোগ কমে যায় এবং নবীনরাও একইরকম মানসিকতা নিয়ে বড় হন। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেদনে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হয় না। এতে অনুসন্ধানটি সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। টিভিতে যেখানে দলে কাজ করার সংস্কৃতি আছে, সেখানে আবার নারী অনুসন্ধানী সাংবাদিকের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এতে শুধু জেন্ডার সংবেদনশীলতা নয়, রিপোর্টটি স্বতন্ত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও বঞ্চিত হয়।

জোট বেঁধে অনুসন্ধানের চর্চা না থাকা, সমস্যার একটি দিক মাত্র। বাইরের বিশ্বে এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক। কেউ রিপোর্টের প্রয়োজনে স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করছেন, কেউ জাহাজ ট্র্যাক করে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ও নব্য শ্রম-দাসত্ব উন্মোচন করছেন, কেউ নিছক ওপেন সোর্স অনুসন্ধানী কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে বিমানে মিসাইল হামলা কীভাবে হলো, তা-ও বলে দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এখনো প্রযুক্তির চর্চা তেমনটা দেখা যায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রযুক্তির সাথে জোটবদ্ধতার সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্কটা, নতুন ধ্যান-ধারণাকে সংবাদ তৈরির চর্চায় ধারণ ও বরণ করে নেওয়ার মানসিকতায়।

এবার নজর দেওয়া যাক তৃতীয় সীমাবদ্ধতায়। সেটি হলো, যোগাযোগ। আরও স্পষ্ট করে বললে, ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগের দক্ষতা। এই সীমাবদ্ধতার কারণে বাইরের সাংবাদিকদের সাথে এদেশের রিপোর্টারদের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে না। উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের সাংবাদিকদের জন্য প্রচুর ফেলোশিপ বা স্কলারশিপ থাকে। খোঁজ করে দেখুন, এই অঞ্চলে বেশিরভাগ সুযোগ ভারতীয় এবং পাকিস্তানি সাংবাদিকরা পেয়ে থাকেন এবং এটি মূলত তাদের যোগাযোগ দক্ষতার কারণে।

সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতেও এদেশের রিপোর্টারদের অংশগ্রহণ কম। প্রথমত, যোগাযোগ দক্ষতার অভাব থাকায় বিনামূল্যে অংশ নেওয়ার প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়েন। দ্বিতীয়ত, বার্তা কক্ষগুলো টাকা খরচ করে রিপোর্টারদের সম্মেলনে পাঠাতে চান না। কিন্তু এই সম্মেলন বা ফেলোশিপগুলোর মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে একেকটি দেশের সাংবাদিকরা, সাংবাদিকতার বৈশ্বিক মানচিত্রে নিজেদের জায়গা তৈরি করেন। নেটওয়ার্কটি বড় হয়। বৈশ্বিক অনুসন্ধানে অংশ নেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়।

ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগের দক্ষতা। এই সীমাবদ্ধতার কারণে বাইরের সাংবাদিকদের সাথে এদেশের রিপোর্টারদের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে না।

আমাদের আরেকটি জাতিগত সমস্যা আছে। সেই হলো, ইংরেজিতে কথা বলায় ”সংকোচ”। এমন না যে রিপোর্টাররা ভালো ইংরেজি জানেন না। তারা হয়তো জানেন। কিন্তু বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা, সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই সংকোচ আমি নিজে অন্তত তিনটি সম্মেলনে দেখেছি। ভারতের এক নারী সাংবাদিক একদিন কথাচ্ছলে আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বিদেশে সবাই একসাথে থাকতে, ঘুরতে বা খেতে পছন্দ করে। অন্যদের সাথে তাদের মেলামেশা কম।’ তার কথা মিথ্যা নয়। হামবুর্গে একটি সম্মেলনে মেক্সিকোর এক সাংবাদিককে স্প্যানিশ থেকে গুগলে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিয়ে, হল ভর্তি প্যানেলে পেপার উপস্থাপন করতে দেখেছি আমি। আমাদের ইংরেজির মান কোনো অংশেই চীন, জাপান বা দক্ষিণ আমেরিকান সাংবাদিকদের চেয়ে কম নয়। কিন্তু সংকোচই পিছিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে পরবর্তী ধাপে নিতে হলে, প্রথমে নিজ বার্তা কক্ষে দলীয় অনুসন্ধানের চর্চাটা শুরু করা দরকার। বড় সম্মেলন ও ফেলোশিপে অংশ নিতে রিপোর্টারদের উৎসাহিত করাও জরুরি। এতে নেটওয়ার্ক যেমন তৈরি হবে, তেমনি সংকোচটাও কাটবে। তারপর, ধীরে ধীরে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী প্রকল্পে অংশীদার হওয়ার চেষ্টা শুরু হতে পারে। এই সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আছে।

জোটবদ্ধ সাংবাদিকতার সুবিধা অনেক। এটি একটি বড় জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর সমস্যা সমাধান করতে পারে। ইমপ্যাক্ট বেশি হয়। এটি বড় পরিসরে অনুসন্ধানের সুযোগ করে দেয়; নতুন প্রযুক্তি, সম্পাদকীয় মান এবং রিপোর্টিং কৌশল শেখায় এবং একই সাথে সংবেদনশীল রিপোর্টিংয়ের যে ঝুঁকি, তা-ও কমিয়ে আনে। তখন একটি গণমাধ্যম অপরটির পাশে দাঁড়াতে পারে। আর এতে সাংবাদিকতার মানচিত্রে দেশের সম্মান বাড়ে, আর দেশের গণমাধ্যমগুলোর ওপর বৈশ্বিক সাংবাদিক সম্প্রদায়ের আস্থাও তৈরি হয়। এই আস্থা আরও অনেক রিপোর্টিং প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে।

প্রশ্ন আসতে পারে, সাংবাদিকতার সুযোগ যেখানে সীমিত সেখানে জোট বেঁধে অনুসন্ধান কীভাবে হবে? এটুকু বলতে পারি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে নিচে থেকেও, অনেক দেশে কোলাবরেটিভ সাংবাদিকতার চর্চা ও প্রযুক্তির ব্যবহার আরও আগে থেকেই শুরু হয়েছে। কেউ বলতে পারেন, মালিকদের মধ্যে দূরত্ব আছে, সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন আছে–তাই কোলাবরেশন সম্ভব নয়। কিন্তু এই সমস্যা বাইরে থেকে কেউ এসে সমাধান করে দিবে না। পেশার স্বার্থে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে এবং সর্বোপরি, জনস্বার্থে-এটি সাংবাদিকদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী ।। হেড অব প্রোগ্রাম অ্যান্ড কমিউনিকেশনস, এমআরডিআই

miraj.chowdhury@gijn.org