শ্রদ্ধাঞ্জলি, ফকির আলমগীর। ফকির ভাই সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরবেন কি, ফিরবেন না—এটা নিয়ে দোটানায় ছিলাম। অবশেষে তিনি ফিরলেন না। আমাদের শোকাহত করে, না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

আমি গণসংগীত শিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীরের কথা বলছি। বলছি গণমানুষের কাছের মানুষ, গানের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে পৌঁছানো মানুষ ফকির আলমগীরের কথা।

তার অসংখ্য সৃষ্টি, পরিবেশিত অসংখ্য গান, কথা অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে মিশে আছে। রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক হিসেবে আমি শুধু গানের মধ্য দিয়ে আনন্দ দেওয়া ফকির আলমগীরকে দেখিনি। দেখেছি, ভরাট কণ্ঠে গানের মাধ্যমে অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথা তুলে ধরতে, মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে, অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে।

অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর শোষণ মুক্তির সংগ্রামে মানুষকে উদ্বেলিত করতে।

রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক হিসেবে আমি শুধু গানের মধ্য দিয়ে আনন্দ দেওয়া ফকির আলমগীরকে দেখিনি। দেখেছি, ভরাট কণ্ঠে গানের মাধ্যমে অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথা তুলে ধরতে, মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে...

আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখার জায়গা, অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আর শপথ নেওয়ার স্থান শহীদ মিনারকে ঘিরে যেকোনো অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে শিশু পার্কের সামনে ফকির ভাইয়ের পরিবেশনা ছিল অন্য এক আকর্ষণ। যেখানে শুধু ‘সুশীল’ নয়, মেহনতি মানুষকে টেনে নিত।

পহেলা মে, শ্রমজীবীদের বিশেষ দিন। মে দিবসে ঢাকার শ্রমজীবী এলাকা ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস লিমিটেডের শ্রমজীবী মানুষ, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল ফকির ভাইয়ের পরিবেশনা। শিকাগোর জন হেনরিকে তুলে ধরা আর দেশের শ্রমজীবী মানুষের একজন হয়ে ওঠায় তিনি ছিলেন অনন্য।

ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির অসংখ্য অনুষ্ঠানে এসেছেন তিনি। শুধু ঢাকা শহরে নয়, জেলা সদরে নয়, উপজেলাতেও ছুটে গেছেন আমাদের আমন্ত্রণে। ছাত্র ইউনিয়নের একজন সাবেক কর্মী হিসেবে নিজেকে একাত্ম করেছেন। নিজের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

শিকাগোর জন হেনরিকে তুলে ধরা আর দেশের শ্রমজীবী মানুষের একজন হয়ে ওঠায় তিনি ছিলেন অনন্য।

এসব জায়গায় তিনি গানের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মসহ মেহনতি মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। শুধু তাই নয়, গানের শুরুতে ও শেষে সমাজতন্ত্রের প্রতি তার বিশ্বাসকে দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরতেন। দেশ-বিদেশের বিপ্লবীদের নিয়ে তার দরদ ভরা পরিবেশনা এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে এসেছিল।

ফকির আলমগীর প্রথম পরিচয়ে যেকোনো জায়গায়, যেকোনো পরিবেশে, যেকোনো ধরনের মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন এবং নিজেও আপন হয়ে উঠতেন। এ ছিল তার বিশেষ গুণ।

দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের সময় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধ শক্তি মোকাবিলায় দৃঢ় অবস্থান নিয়ে চলেছেন তিনি।

আজ এই দুঃসময়ে তাকে হারিয়ে আমরা শুধু একজন গানের কণ্ঠকে হারালাম না। হারালাম শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠকে তুলে ধরার একজন প্রিয় মানুষকে। প্রিয় বন্ধুকে। একজন কমরেডকে ।

দেখা হলে যিনি কমরেড বলে হাতটা ধরতেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরতেন। বলতেন, ‘আমি জাগ্রত আছি কমরেড।’

ফকির ভাই তার অসংখ্য কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। জাগ্রত থাকবেন। অন্যান্য কাজের সাথে, তার কণ্ঠের গান আর গানের ভাষায় শ্লোগান মেহনতি মানুষের হাতিয়ার হয়ে থাকবে।

এইতো আমাদের ফকির ভাই। ফকির আলমগীর।

রুহিন হোসেন প্রিন্স ।। সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)

hossainprince@yahoo.com