জুলাই, ১৯৭১ বালিগঞ্জ, কলকাতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করলাম। সেখানে আরও অনেকের মাঝে একজনের সাথে পরিচয় হলো। পরনে সাদা ঢোলা পায়জামা ও পাঞ্জাবি এবং হাতে তার বাঁশি। নাম জানতে চাইলে বলল, লাল মিঞা। তবে ভালো নাম ফকির আলমগীর। তখন লাজুক ও সাদাসিধে এক যুবক।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছাড়াও আমরা একসাথে সাবেক এবং প্রয়াত মন্ত্রী এম. এ. মান্নান সাহেবের গঠিত ‘শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠী’তে একই সাথে যোগ দিলাম। সেখানে বিভিন্ন স্ক্রিপ্ট নিয়ে কলকাতা, কলকাতার আশেপাশে এবং বিভিন্ন সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত এবং মুক্তিযোদ্ধা তহবিল গঠনের জন্য অনুষ্ঠান করতাম।

অনেকের মাঝে একজনের সাথে পরিচয় হলো। পরনে সাদা ঢোলা পায়জামা ও পাঞ্জাবি এবং হাতে তার বাঁশি। নাম জানতে চাইলে বলল, লাল মিঞা। তবে ভালো নাম ফকির আলমগীর।

একসাথে কাজ করতে গিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ওর সাথে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী। লাল মিঞা বয়সে আমার থেকে কিছুটা বড় হলেও ওর সাথে সম্পর্কটা তুই-তুকারিতে পৌঁছে গেল। একদিন ও আমাকে ঠিক এইভাবে হেসে বলল, ‘দোস্ত, গলা তো ফাটা বাঁশ। কীভাবে গান গাইবো?’

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে আমি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনয়িনে চলে যাই। মাঝে ১৯৭৭ সালে কয়েক মাসের জন্য দেশে আসি। সেই সময়ে বিটিভি আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। তাতে পপ সঙ্গীত সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা হয়। আমি তখনো জানিনা যে, ফকির আলমগীর পপ সঙ্গীত গাইছে।

১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে ফিরে বিভিন্ন মঞ্চে গাইতে গিয়ে জানলাম, ফকির আলমগীরের গাওয়া ‘ও সখিনা’ গানটি তখন খুব হিট। এই ভেবে ভালো লাগলো যে, সেই ফকির, যে একদিন আমাকে দোস্ত, গলা তো ফাটা বাঁশ বলেছিল, তার গানই আজ সবার মুখে মুখে।

পরের দিন ওর সাথে ঢাকার নিউ মার্কেটে দেখা। আমাকে দেখেই ডাক দিয়ে বলল, ‘দোস্ত, তুই গতকাল টিভিতে পপ সঙ্গীত নিয়ে এটা কী বললি?’ আমি হেসে বললাম, ‘এটা তো আমার ধারণা থেকে বলা।’ ফকির মেনে নিল। আসলে ও আমাকে একজন শিক্ষিত মিউজিশিয়ান হিসেবে খুবই সম্মান করতো। 

আমি আবারও রাশিয়া চলে গেলাম। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে ফিরে বিভিন্ন মঞ্চে গাইতে গিয়ে জানলাম, ফকির আলমগীরের গাওয়া ‘ও সখিনা’ গানটি তখন খুব হিট। এই ভেবে ভালো লাগলো যে, সেই ফকির, যে একদিন আমাকে দোস্ত, গলা তো ফাটা বাঁশ বলেছিল, তার গানই আজ সবার মুখে মুখে। আমার বন্ধু এখন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় শিল্পী! তাকে প্রতিটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেই সামনের সারিতে দেখা গেছে।

১৯৯৯ সালে আমি তখন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কেন্দ্রীয় কার্যালয়, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক কমান্ডের প্রেসিডেন্ট। আমাকে ফোন করে ফকির তার একুশে পদক প্রাপ্তির কথা জানায়। শুনে আনন্দিত হই এবং অভিনন্দন জানাই ওকে। এরপর ওর থলেতে আরও অনেক প্রাপ্তি জমেছে, তা দেশবাসী কম বেশি সবাই জানেন।

পপ সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার পেছনে তারও অনেক অবদান আছে। একজন সাধারণ মানুষ থেকে সাধারণ মানুষের শিল্পী হয়ে উঠেছিল ফকির আলমগীর।

তার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন একটু পরপরই ওর ছেলে রাজীবের সাথে আমি যোগাযোগ রক্ষা করে খবর নিতাম। অসময়ে বন্ধু, সহযোদ্ধা, ফকির আলমগীরের চলে যাওয়াতে আমি ভীষণভাবে মর্মাহত!

বাংলাদেশ চিরদিন তার অবদানকে স্মরণ করবে। আমার বন্ধু, সহযোদ্ধা, ফকির আলমগীর বেঁচে থাকবে তার কাজের মধ্য দিয়ে।

তিমির নন্দী ।। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা