গণসংগীত গেয়েই জনপ্রিয় সঙ্গীত জীবন কাটিয়ে দেওয়া এক বিরল মানুষ ফকির আলমগীর। সাধারণ মানুষের জন্য তাদের আবেগ-অনুভূতি আর সংগ্রামের কথায় সহজ গান তৈরি করে সরল পরিবেশনই তার জনপ্রিয়তার কারণ। তিনি যেমন রক্তে দোলা লাগানো বিপ্লবের গান করতেন, তেমনি খেটে খাওয়া মানুষের ছোট বড় আনন্দ-বেদনার নানা ছবি আঁকতেন তার কণ্ঠে।

তার ‘সখিনা’ সিরিজের গানগুলো এই সহজ সত্যবাহী গানের উদাহরণ। ফকির আলমগীর আর ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়ানো। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী তৈরির আগে তিনি ক্রান্তি, উদীচী ও বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উদীচীর প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ফকির আলমগীর বা ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। কখনো কোনোদিন যদি ভুলবশত আমন্ত্রণ জানাতে আমাদের বিলম্ব হতো, খুব অভিমান করতেন। উদীচীর ছোট বড় যেকোনো অনুষ্ঠানে তিনি অনুপস্থিত থেকেছেন—এমন নজির নেই।

তিনি যেমন রক্তে দোলা লাগানো বিপ্লবের গান করতেন, তেমনি খেটে খাওয়া মানুষের ছোট বড় আনন্দ-বেদনার নানা ছবি আঁকতেন তার কণ্ঠে।

ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি ‘কাকু’ বলেই ডাকতাম। আর তিনি কখনোই ‘আমার মামণি’ ছাড়া সম্বোধনই করেননি। এত মধুমাখা ডাক আর শুনতে পাবো না—কথাটি ভাবতেই মনটা ডুকরে কেঁদে উঠছে। কত শতবার যে দেখা হয়েছে, আর দেখা হলেই কত গল্প—কখনো গানের, কখনো মুক্তিযুদ্ধের বা কখনো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নানা স্মৃতি শুনেছি তার কাছে, যেগুলো আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বয়সে ছোট না বড়-এসব ভেদ না করেই অনায়াসে আড্ডা জমাতে পারতেন ফকির আলমগীর।

ইতিহাসের দলিল সংরক্ষক ছিলেন তিনি। তার খিলগাঁওয়ের বাড়িতে গেলেই দেখা যেত ড্রাইভওয়ে থেকে চারতলা পর্যন্ত সিঁড়িতে আর তিনতলার বসার ঘরে কত গুণীজনের সাথে তোলা আলোকচিত্র! প্রতিটি আলোকচিত্রই একেকটি ইতিহাসের সাক্ষী।

উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্মদিনে প্রতিবছর গণসংগীত উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এই উৎসবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের গণসংগীত শিল্পীরা আসেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আগত সকল প্রথিতযশা শিল্পীর সঙ্গেই ফকির আলমগীরের অন্তরের বন্ধুত্ব। এমন মিশুক আর বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন তিনি।

প্রত্যেককে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতেন আর অসম্ভব ঘরোয়া একজন মানুষকে পাওয়া যেত তার বাড়িতে গেলে। বাড়ির প্রত্যেক সদস্যকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিতেন—স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতিও বাদ যেত না। সবাই একসঙ্গে গল্প, খাওয়া-দাওয়া আর জীবনযাপনের কী দারুণ মনকাড়া পরিবেশ। এমনই এক যৌথ পরিবারের মধ্যমণি তিনি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের কথা ভেবে আরও কষ্ট হচ্ছে আজ। এ কষ্ট তারা কীভাবে বইবেন!

একুশে পদকে ভূষিত এই শিল্পী রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়ে যেমন খুশি হতেন, তেমনি একজন শ্রমজীবী মানুষের প্রশংসা তাকে আপ্লুত করত। কতদিন দেখেছি, আমাদের রিকশাচালক ভাইয়েরা চারুকলার সামনে বা তোপখানা রোডে কিংবা বইমেলায় ফকির আলমগীরকে চিনতে পেরে গানের অনুরোধ করছেন, আর কাকু সাথে সাথে তার সঙ্গে গল্প জমিয়ে গান শুনিয়েছেন। আবার নিজেও শিশুর মতো গানের অনুরোধ জানাতেন আমাদের শ্রমজীবী ভাইবোনদের কাছে।

শাহবাগে একবার এক রিকশাচালক ভাইয়ের গান শুনে কাকু বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে। তার প্রয়াণের সংবাদটি শুনে কত স্মৃতি যে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

২০১৪ সালের এক বিকেলের কথা এই মুহূর্তে ভীষণ মনে পড়ছে। সম্ভবত শিল্পী ফকির আলমগীরের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার খানিকটা আঁচ পাওয়া যাবে এই স্মৃতিতে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের ছয় দফা দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেন রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়।

কতদিন দেখেছি, আমাদের রিকশাচালক ভাইয়েরা চারুকলার সামনে বা তোপখানা রোডে কিংবা বইমেলায় ফকির আলমগীরকে চিনতে পেরে গানের অনুরোধ করছেন, আর কাকু সাথে সাথে তার সঙ্গে গল্প জমিয়ে গান শুনিয়েছেন।

২০১৪ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্বাধীনতা দিবসে ‘লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত’ গাইবার আয়োজন করা হয়েছিল। এই আয়োজনে মন্ত্রণালয় যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক থেকে তিন কোটি টাকা অনুদান গ্রহণ করেছিল। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা মহলে এ নিয়ে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী শিল্পকলা একাডেমির কনফারেন্স হলে সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মত বিনিময় সভায় বসেছিলেন। সেদিনের সভায় উদীচী যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান গ্রহণের তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। সভায় উদীচীর প্রতিবাদে একমাত্র ফকির আলমগীরকেই আমরা পাশে পেয়েছিলাম। এমনি বলিষ্ঠ মানুষ ছিলেন তিনি।

সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটিকে কেড়ে নিল মহামারি। মহামারিতে আর কত গুণীজন আর স্বজন হারাবো আমরা! ফকির আলমগীরের মতো শিল্পীরা আমাদের সম্পদ। তাদের হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই আমরা। তার মতো গণসংগীতে জীবন উৎসর্গ করা শিল্পী আর কজনইবা বেঁচে আছেন, যিনি একাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মঞ্চ কাঁপাতেন।

সংগঠক হিসেবেও তিনি তার কাজের নজির রেখে গেছেন আমাদের মাঝে। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান থেকে গণজাগরণ মঞ্চ বা তৎপরবর্তী যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন রাজপথে, মানুষের সাথে।

মৃত্যু অনিবার্য জানি, কিন্তু এমন প্রস্থান কখনোই চাইনি আমরা। প্রয়াণের পথে আভূমিনত শ্রদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রিয় গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীরকে। আপনার মামণি আপনাকে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় স্যালুট জানায়।

আপনি থাকবেন গণসংগীতের ইতিহাসের পাতায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাসে আর আমাদের মনের ক্যানভাসে আঁকা থাকবে আপনার হাসিমাখা মুখটি।

সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী