বাংলাদেশ বর্তমানে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় কঠিন সময় পার করছে। সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। করোনার এই ভয়ংকর রূপ মোকাবিলায় আমরা যখন হিমশিম খাচ্ছি, তখন শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের উচ্চহার ও আক্রান্ত শিশুদের নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি এই সংকট মোকাবিলায় আমাদেরকে নতুন করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার আগে কম থাকায় অভিভাবকরা একটু নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু গত জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের ব্যাপক হার পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা নতুন করে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।

সম্প্রতি ইউরোপিয়ান মেডিকেল এজেন্সি মর্ডানার টিকাটি ১২ বছর বা তার অধিক বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন সংস্থা শিশুদের সুরক্ষায় কোনো টিকার জরুরি অনুমোদন দেয়নি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১৮-২০ জন করোনায় আক্রান্ত শিশু ভর্তি হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামে মা ও শিশু হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১২ জন করোনায় আক্রান্ত শিশুর জিনোম সিকুয়েন্সে শতভাগ ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।

আমেরিকান রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত সংক্রামক এবং এর প্রভাবে একজন সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমে ৪ জন ব্যক্তি সংক্রামিত হতে পারে। সংস্থাটির এই ভ্যারিয়েন্টকে সম্প্রতি ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ ঘোষণা দিয়েছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে বাজারে প্রচলিত টিকা কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়াও সারা বিশ্বে বারো বছরের কম বয়সী শিশুদের টিকার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই শিশুদের মধ্যে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি সত্যিই উদ্বেগজনক। গত মে মাসের শেষের দিকে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে ইউরোপ ও আমেরিকা ফাইজারের টিকাটি ১২-১৭ বছরের শিশুদের মধ্যে প্রয়োগ করার জরুরি অনুমোদন দিয়েছে।

সম্প্রতি ইউরোপিয়ান মেডিকেল এজেন্সি মর্ডানার টিকাটি ১২ বছর বা তার অধিক বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন সংস্থা শিশুদের সুরক্ষায় কোনো টিকার জরুরি অনুমোদন দেয়নি। এছাড়া ৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের মাস্ক পরিয়ে রাখাও অনেক সময় সম্ভবপর হয়ে উঠে না।

সম্প্রতি টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানি ফাইজার ও মর্ডানার ৬ মাস-১১ বছর বয়সী সুস্থ শিশুদের উপর পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগ শুরু করেছে। সুতরাং ২০২১ এর শেষে অথবা ২০২২ এর শুরুতে এ বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত পেতে পারি। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিশুদের সুরক্ষায় করণীয় কী সে প্রশ্ন অভিভাবকদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরছি—
১. শিশুদের যথাসম্ভব বাইরের লোকজন ও আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে রাখতে হবে। কোনো কারণে বাইরে থেকে লোকজন বাসায় আসলে সেক্ষেত্রে তাদের মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে।

২. পরিবারের কোনো সদস্য বাইরে গেলে তারা বাসায় প্রবেশ করে শিশুদের স্পর্শ করবেন না, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করেই শিশুদের সংস্পর্শে যেতে পারবেন।

বর্তমানে প্রতিদিন দুইশর বেশি মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও টিকা কার্যক্রম চলমান রাখা প্রয়োজন।

৩. দুই বছরের কম বয়সী শিশুরা নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ বয়সী শিশুদের সর্দি, জ্বর, কাশি প্রায়ই হয়ে থাকে যা করোনারও উপসর্গ। যদি কোনো শিশুর মধ্যে এ ধরনের উপসর্গ দেখা যায়, সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে করোনা টেস্ট করা ও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

৪. পরিবারের কোনো সদস্য করোনায় আক্রান্ত হলে শিশুদেরকে যথাসম্ভব তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোনো কারণে দুগ্ধবতী মা যদি করোনায় আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাস্ক পরে ও হাত জীবাণুমুক্ত করে শিশুদের দুধ পান করাতে হবে। করোনার এই মহামারি পরিস্থিতিতে শিশুদের সুরক্ষার জন্য বাড়িতে পোষা প্রাণী না থাকাই বাঞ্ছনীয়।

বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি, ঘনবসতি ও অন্যান্য বিষয়াদি বিবেচনা করে বলা যায় যে, একমাত্র গণটিকা কার্যক্রমই করোনা সংক্রমণ রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

সম্প্রতি সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে ফাইজার, মর্ডানা, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও সিনোভ্যাকের টিকা সংগ্রহ করেছে, যেটি নিঃসন্দেহে একটি সাফল্যের খবর। এছাড়াও সরকার বিভিন্ন উৎসের সাথে টিকা সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং ২০২২ সালের শুরুতে একুশ কোটি ডোজ টিকা প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

টিকা প্রাপ্তির এই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিলে দেশে গণটিকা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যাবে। গণটিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বসাধারণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে যা করোনা সংক্রমণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। গণটিকা কার্যক্রমকে কার্যকরী করতে টিকা প্রয়োগ ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন।

বর্তমানে প্রতিদিন দুইশর বেশি মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও টিকা কার্যক্রম চলমান রাখা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মেডিকেল, ফার্মেসি, নার্সিং ও স্বাস্থ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ট্রেনিং দিয়ে গণটিকা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করছি।

ড. আ.স.ম মঞ্জুর আল হোসেন ।।  সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়