১৪ জুলাই বেলা দুইটার পর আমি সাতক্ষীরা মেডিকেলে পৌঁছালাম। আমার বাবা একটু অস্থির। কিছুক্ষণ পরপর অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলছেন। আর বলছেন, মাথায় পানি দাও। ভয় পেলাম না, কারণ সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেমের ওই ঘরে অন্য রোগীদের উপসর্গও কাছাকাছি।

অক্সিমিটারে দেখলাম অক্সিজেন ৮৭-৯২ এর মধ্যে উঠানামা করছে। বিকেল ৫টার দিকে আকস্মিক অক্সিজেন নেমে গেল ৪৮ এ। সেটা আর তোলা গেল না। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে সিসিইউ ইউনিটে নেওয়ার ২০ মিনিট পর চোখের সামনে অক্সিমিটার শূন্য হয়ে গেল। সাত দিন ধরে আমার বাবা সেখানকার করোনা ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। আরও এক সপ্তাহ আগে থেকে আমার স্ত্রী ও ছোট দুই ভাই, বোন তার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কাজ করছিলেন। আমিও ঢাকা থেকে সার্বক্ষণিক যুক্ত ছিলাম পুরো প্রক্রিয়ায়। যারা কাজ করছেন তাদের পরিশ্রম কিছুটা কমানোর জন্যে আমি যোগ দিয়েছিলাম ওই দলে। সেসময় কোনোভাবেই মাথায় আসেনি, বাবাকে আর ঘণ্টা চারেকের মধ্যে হারিয়ে ফেলতে হবে!

মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। পারা গেল না। দম বন্ধ লাগছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না। সত্যি কি বাবাকে হারিয়েছি?

সিসিইউ ইউনিটের অন্যান্য রোগীদের বেশিরভাগের অবস্থা আমার বাবার মতোই। প্রত্যেকের সঙ্গে আশেপাশে লোকজন আছে। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে আছে কার, কখন, কী খবর আসে। আমার কান্না তাদের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে চুপ থাকার চেষ্টা করলাম।

তরুণী ডিউটি ডাক্তার ভীষণ আন্তরিকতায় মরদেহ নিয়ে আমাদের হাসপাতাল ছাড়ার ব্যবস্থা করলেন। গত একমাস ধরে প্রতিদিন এই হাসপাতাল থেকে এরকম ৮-১০ জন মানুষের মরদেহ বের হচ্ছে। এরও কিছু আগে গোটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে করোনা চিকিৎসার জন্যে।

জেলা শহরে একটি সরকারি আর তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে করোনা রোগীদের। তবে ঘুরে ফিরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিন্তু ৩/৪ জন। যাদের নাম ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে। রোগীর স্বজনদের কাছে তারা দেবদূত।

সাতক্ষীরা। আমার প্রিয় জন্মভূমি। এখন পুরো এলোমেলো। যেখানে কোনোকিছুই স্বাভাবিক নয়। আট দিনে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। অদ্ভুত সংকটে আছে প্রতিটি পরিবার। এই সংকট শহর থেকে অজপাড়া গাঁ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় প্রতি বাড়িতে ঠাণ্ডার উপসর্গ। উপরে উপরে ভাব ধরছেন যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। প্রথমত নিজের এবং বাড়ির কারো উপসর্গ দেখা দিলে লুকানোর চেষ্টা করছেন। আর নেহায়েত লুকাতে না পারলে বলছেন, ‘এ এমন কিছু না। সিজনাল জ্বর’। সন্ধ্যার পর ওষুধের দোকানে দেখা যাচ্ছে ভিড়।

সাতক্ষীরায় গত একমাস ধরে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন মানুষ মারা যান। এদের মধ্যে ২০ ভাগ করোনাক্রান্ত। আর ৮০ ভাগ করোনা উপসর্গে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। এই যে ৮০ ভাগ মানুষ, তারা করোনা টেস্ট করাননি। তবে হাসপাতালে আসার কারণে তারা একটা হিসাবে ঢুকলেন। যাতে মানুষ কিছুটা চিত্র হয়তো পায়। কিন্তু করোনা উপসর্গে হাসপাতালে না আসতে পেরে মারা গেলেন এমন সংখ্যাও কিন্তু খুব কম নয়। এখনই তাদের সংখ্যা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকলে হয়তো জেলার সার্বিক চিত্রের ভয়াবহতা পৌঁছাতো সরকারি দপ্তরে।

আসি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়। জেলা শহরে একটি সরকারি আর তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে করোনা রোগীদের। তবে ঘুরে ফিরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিন্তু ৩/৪ জন। যাদের নাম ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে। রোগীর স্বজনদের কাছে তারা দেবদূত। তারাও কাজ করছেন দিন রাত এক করে। আমি নিজেই দেখেছি এক হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরেক হাসপাতালের বাহন। অপেক্ষা, তিনি কখন বের হবেন আর কখন তাকে রোগীর কাছে নিয়ে যাবেন।

সরকারি-বেসরকারি দুই ব্যবস্থায়ই প্রায় একই চিকিৎসক কাজ করছেন। তাই ওষুধ এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা অবকাঠামো বেশি। কিন্তু সরকারি চিকিৎসার সঙ্গে বেসরকারি চিকিৎসা থেকে এগিয়ে থাকছে পরিচর্যায়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে একজন রোগীকে সারাক্ষণ মনিটর করা হচ্ছে। তবে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ও বহন করতে পারছেন না সাধারণ রোগী।

২৫০ শয্যার বিশাল সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন অন্য যে কোনো রোগের চিকিৎসা বন্ধ। হাসপাতালটি আট শয্যার আইসিইউ এবং আট শয্যার সিসিইউ ইউনিট। বাকি সব ওয়ার্ড। ওয়ার্ডগুলো সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেমের আওতায়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বলছিলেন, প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক চিকিৎসক তিনি জোগাড় করতে পেরেছেন। কিন্তু সমস্যা রোগীর পরিচর্যার মানুষ নিয়ে। যে পরিমাণ জনবল তার দরকার আছে মাত্র ১০ ভাগ।

তত্ত্বাবধায়কের কথার সত্যতা কত নির্মম তা আমি নিজে দেখেছি রোগীর পাশে থেকে। আমার মনে হয়েছে যে ১০ ভাগ লোক এখানে রোগীর পরিচর্যায় কাজ করে তাদের প্রয়োজন দক্ষ প্রশিক্ষণের। ডাক্তার, ডিউটি ডাক্তাররা এক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যান আরেক রোগীর কাছে। কিন্তু যে নিবিড় পরিচর্যা দরকার সেটা করবেন বয় অথবা নার্স। কিন্তু সেই কাজটিই হয় না। দরকারের তাগিদে না জেনে না বুঝে সেই কাজটি করছেন রোগীর স্বজনেরা।

হাসপাতালটি একেবারে নতুন। লোকজনও নতুন। করোনাও বলে কয়ে আসেনি। হুট করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের থাবায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পুরো সিস্টেম।

ধরা যাক, একজন রোগীকে হাইফ্লো অক্সিজেন দেওয়ার কাগুজে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। কিন্তু সেটা রোগীকে দেওয়ার কাজটি নার্স বা বয়ের। হাইফ্লো অক্সিজেন খুব গরম হয়। এই গরম বাতাস যায় রোগীর ফুসফুসে। যে কারণে সেটা রোগীকে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একেবারেই উচ্চমাত্রায় দিয়ে দিলে তো তিনি সহ্য নাও করতে পারেন। আবার দেখা গেলে হাসপাতালের যে শয্যা সেই শয্যার নানা যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়ার কথা রোগীর। কোনো ক্ষেত্রে এই সামান্য সুবিধায় রোগীর অনেক বড় সমস্যা কেটে যেতে পারে। কিন্তু সেটা চালাতে না পারার কারণে রোগী সেটা পাচ্ছেন না। স্বজনদের এই শয্যা চালানোর জ্ঞান থাকার কথা নয়।

এরকম বহু সমস্যা আছে যেটার তাৎক্ষণিক সমাধান দরকার। এমন বহু রোগী দেখলাম যাদের কাছে সবসময় এমন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকা জরুরি, যিনি যান্ত্রিক বিষয়গুলো বোঝেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, বেশিরভাগ সময় ডেকেও নার্স বা বয় খুঁজে পাওয়া যায় না। গেলেও তাদের বেশিরভাগ অদক্ষ। এদের অনেকের যান্ত্রিক জ্ঞান সুইচ অন-অফের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

কিন্তু বিপরীত দিক থেকে যদি চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে হাসপাতালে যখন যার ডিউটি তিনি খুব ব্যস্ত। কিছু না কিছু করছেন। সব রোগীর কাজ তারা করছেন। তাছাড়া খোদ তত্ত্বাবধায়ক বলছেন, একজন রোগী যত অসুস্থ হন তার কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে থাকার বাস্তবতা এখানে নেই। তাছাড়া হাসপাতালটি একেবারে নতুন। লোকজনও নতুন। করোনাও বলে কয়ে আসেনি। হুট করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের থাবায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পুরো সিস্টেম।

আমার বাবার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০। ২০২০ এর মার্চে করোনার ভয়ে তিনি ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা চলে যান। প্রকৃতির নিয়মে তিনি মারা যেতে পারতেন। কিন্তু যে ভয়ে তিনি জেলা শহরে চলে গেলেন, সেই করোনাক্রান্ত হয়েই তিনি মারা গেলেন। আমি বলবো না তিনি কোনো অব্যবস্থাপনার শিকার। বরং বলতে চাই, তাকে বাঁচানোর জন্যে যার কাছে যে সহায়তা চেয়েছি নির্দ্বিধায় পেয়েছি। এই চেষ্টায় চিকিৎসক থেকে শুরু করে আমার বন্ধুরা পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন।

আক্রান্ত হওয়ার ৩/৪ দিন আগে বাবা ব্যাংকে গিয়েছিলেন। বাস্তব কোনো কারণ নেই, তবু গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এখন বাইরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, তবু গিয়েছিলেন। আমাদের কারো কাছে জিজ্ঞাসা করেননি। কারণ জানতেন জোরালো আপত্তি উঠবে। গত দেড় বছরে তিনি মাত্র একদিন বাইরে গেলেন। বাবারাও মাঝে মধ্যে এমন শিশুর মতো আচরণ করেন। তাকে ওই মুহূর্তে বাঁধা দেওয়ার কেউ ছিল না। এই সময় বাবাদের সর্বোচ্চ সাবধান রাখতে হবে। দরকার হলে শক্ত বাধা দিতে হবে। ঘরের বাইরে বের হলে যে বাবা যত প্রবীণ তার ঝুঁকি তত বেশি। চিকিৎসকরা আমাকে বারবার বলেছেন, করোনা চিকিৎসায় বয়স সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর।

সাতক্ষীরায় আমার বাবার যে চিকিৎসা হয়েছে এর চেয়ে ভালো চিকিৎসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু অবকাঠামোটা আরেকটু গোছানো হতে পারতো। দক্ষ লোকবল থাকলে হয়তো সেটা সম্ভব হতো। হয়তো আরও কিছুদিন বটের ছায়া থাকত মাথার ওপর। এ মাসের ১৪ তারিখের আগের আমি আর আজকের আমির পার্থক্য খুব পরিস্কার আমার কাছে। বাবা হারানোর অনুভূতিটা যিনি যত দেরিতে পাবেন তিনি ততই ভাগ্যবান। তাই আমাদের স্বাস্থ্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাবো, দয়া করে আপনারা সাতক্ষীরার করোনা ব্যবস্থাপনাটা আরেকটু গুছিয়ে দিন।

পলাশ আহসান ।। গণমাধ্যমকর্মী