ছবি : সংগৃহীত

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম একজন মানুষ। বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি’ বইটি থেকে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর লেখা থেকে কিছু বিষয় আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি।

বাংলাদেশে বিলাতি পণ্য বর্জনের জন্য যে জোর আন্দোলন চলছে, এটা সাধারণ ঘটনা নয়। বাংলাদেশে যথেষ্ট শিক্ষা বিস্তার হয়েছে এবং বাঙালিরা বেশ বুদ্ধিমান জাতি। সেইজন্য ওখানে এমন আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।

স্যার হেনরি কটন বলেছেন, বাংলা কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত শাসনকার্য চালায়। এর কারণ জানার প্রয়োজন আছে। এটা নিশ্চিত যে, প্রত্যেক জাতির উন্নতি বা অবনতি তার বিশিষ্টজনদের উপর নির্ভর করে। যে জাতির মধ্যে ভালো মানুষ জন্মায়, তার উপর ওইসব মানুষদের প্রভাব না পড়ে যায় না।

আরও পড়ুন :  সন্‌জীদা খাতুন : স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা  

বাঙালিদের কিছু বিশেষত্ব আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। এর কিছু কারণ আছে, যার মধ্যে মুখ্য কারণ হলো যে, গত শতাব্দীতে বাংলাদেশে বহু মহাপুরুষ জন্মেছেন। রাজা রামমোহন রায়ের পর ওখানে একের পর এক মহাপুরুষের আগমন হয়েছে, যাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা যায়।

ঈশ্বরচন্দ্র শুধু বিদ্যাসাগরই ছিলেন না, তিনি দয়া, উদারতা ও অন্য অনেক সদ্গুণেরও সাগর ছিলেন। তিনি হিন্দু তার ওপর ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু তার কাছে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদ ছিল না।

যিনি ভালো কাজ করেন তিনি উচ্চ-নিচে প্রভেদ করেন না। তার গুরুর কলেরা (ওলাউঠা) রোগ হয়েছিল, তিনি তার সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন। তার জন্য নিজে খরচ করে ডাক্তার আনিয়েছিলেন, নিজের হাতে মলমূত্র পরিস্কার করেছিলেন।

১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে দেবনাগরী হরফে লিখিত প্রশংসাপত্রে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকেরা ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করেন। তখন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

তিনি চন্দ্রনগরে দই, রুটি কিনে গরিব মুসলমানদের খাওয়াতেন এবং প্রয়োজন হলে পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। রাস্তায় কোনো পঙ্গু অক্ষম দুঃখী দেখলে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তার দেখাশোনা করতেন। তিনি পরের দুঃখকে নিজের দুঃখ ও পরের সুখকে নিজের সুখ বলে মনে করতেন।

আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের 

তার নিজের জীবন অত্যন্ত সাদাসিধে ছিল। অঙ্গে মোটা ধুতি, মোটা চাদর এবং পায়ে সাধারণ চটি, এই ছিল উনার পোশাক। ওই পোশাকে তিনি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতেন এবং ওই পোশাকেই গরিবদের অভ্যর্থনা জানাতেন।

তিনি সত্যিকার ফকির, সন্ন্যাসী অথবা যোগী ছিলেন। তার জীবন পর্যালোচনা করে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন—

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু !– উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ সদনে!
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী।
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি।
পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে,
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।

১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে দেবনাগরী হরফে লিখিত প্রশংসাপত্রে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকেরা ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করেন। তখন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আরও পড়ুন : আনিসুজ্জামান : পুরোনো বাংলা গদ্য বিষয়ে নতুন গবেষণা 

এরপর তাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পণ্ডিত পদে নিয়োগ করা হয়। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

ঊনবিংশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলাভাষার জনক বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করেছিলেন।

তিনি যে শুধু বাংলা ভাষাকে যুক্তিগ্রাহ্য ও সকলের বোধগম্য করে তুলেছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা এবং বাঙালি সমাজে প্রগতিশীল সংস্কারের একজন অগ্রদূত।

বিদ্যাসাগর—কথাটি উচ্চারণেই পুণ্য। এটা বাঙালি জাতির কাছে উচ্ছ্বাসের কথা নয়, উপলব্ধির কথা। তারই আদর্শকে অনুসরণ করে  আমাদের জীবন অনেকখানি গড়ে উঠেছে, চরিত্র বিকশিত হয়েছে।

তার নিজের যে একটা পদবি আছে, এ কথা অনেকেই মনে রাখেননি। বহুজনের বিশ্বাস মানুষটির নামই বিদ্যাসাগর। কিন্তু বীরসিংহের ভূমিপুত্র ঈশ্বরচন্দ্র প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিতে যে উপাধি অর্জন করলেন, সেইটাই নাম হয়ে উঠল তার জীবদ্দশাতেই।

আরও পড়ুন : নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পটভূমি 

এমন ঘটনা পৃথিবীতে বড়ই বিরল। আর তাইতো বাঙালির ইতিহাসে তারানাথ তর্ক বাচস্পতির পুত্র জীবনানন্দ, রংপুরের নীলকমল, যশোরের রাজীবলোচন, সংস্কৃত কলেজের মাস্টারমশাই প্রাণকৃষ্ণ কিংবা শিবনাথ শাস্ত্রীর বাবা হরানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব তাদের কাজের জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পেলেও সিংহভাগ বাঙালি ‘বিদ্যাসাগর’ বলতে একজনকেই বোঝেন। আর তা হবে নাইবা কেন! উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে, কাজে-কম্মে খাওয়া বাঙালির মুখের ভাষা জোগানোর প্রধান স্থপতি তো এই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যার সম্পর্কে বলেন, ‘কাকের বাসায় কোকিলে ডিম পাড়িয়া যায়, মানব ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপন কৌশলে বাঙালিকে বিদ্যাসাগরের প্রতি মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন।’

ঈশ্বরচন্দ্রের হাতেই আধুনিক বাঙালির সত্যিই অনেকখানি মানুষ হওয়া। উনিশ শতকের বাঙালি তার চিন্তা চেতনায়ও সাবালকত্ব পেয়েছিল এই মানুষটির জন্যই।

আহমেদ ছফা বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, রামমোহনের পর পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম নিতেই হয়। বিদ্যাসাগর নিজে ছিলেন প্রতিভাধর সংস্কৃত পণ্ডিত।

আরও পড়ুন : মমতাজউদদীন আহমদ : স্মৃতির দিকে ফেরা

সনাতন প্রথাগত শাস্ত্রে শিক্ষা নিয়েও যে বিদ্যাসাগর নামের এই ঋজু চরিত্রের মানুষটি সমাজের উন্নতির পালে হাওয়া জোগাতে কত বিরাট অবদান রেখেছেন তা ভাবলে তাজ্জব মানতে হয়। ঈশ্বরচন্দ্র আধুনিক বাংলা গদ্যরীতি গড়েপিটে দিয়েছেন, সেই সাথে সমাজসেবার ক্ষেত্রেও উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঠিক ঈশ্বরচন্দ্রের শিষ্য ছিলেন না, তবে তার সাহিত্যিক প্রতিভার কদর করার উপযুক্ত বোধ ও দূরদৃষ্টি ঈশ্বরচন্দ্রেরই ছিল। মেজাজ ও রুচির বেলায় তারা ছিলেন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। তবু মাইকেলের চরম বিপদের দিনে ঈশ্বরচন্দ্র তার সহায় হয়েছিলেন।

সমাজের একটা বিরাট অংশের তার প্রতি বিরোধিতা, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, অপমান, টিটকিরি। কিন্তু, একটা গোটা সময়কে প্রায় নিজের কাঁধে বহন করে নিয়ে যাওয়া এই মানুষটি কথা নয়, কাজে বিশ্বাস করতেন।

ছোটবেলার একগুঁয়ে স্বভাবই শাপে বর হয়ে চিরকাল তাকে ভরসা জুগিয়েছে। ফলত, নিজের সিদ্ধান্তকে ফলপ্রসূ করতে যতদূর যাওয়া প্রয়োজন ততদূর গেছেন ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিবার। তীব্র কষ্ট পেলেও বিদ্যাসাগরের ক্ষমাশীলতা সমাজের এই অভব্যতাকে শেষপর্যন্ত ‘করুণা’ই করেছে বারবার। সব কাজেই বহু লড়াই পেরিয়ে, এমনকি প্রাণ সংশয়ের ফাঁড়া কাটিয়েও বিদ্যাসাগর সফল হয়েছেন। তার হাত ধরে সফল হয়েছে বঙ্গ সমাজ, সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন : উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী : বিস্মৃত প্রতিভা?

‘বিদ্যাসাগর’ কথাটি আসলে একজন মানুষের নাম নয়, এটা একটি মন্ত্রস্বরূপ। বিদ্যাসাগরের জীবন আমাদের সকলের নিকট একটি জ্যোতির্ময় আলোকস্তম্ভ-স্বরূপও। মনুষ্যত্বের সাধনায় ইহজীবনে যদি কেউ সিদ্ধিলাভ করতে চায়, তার পক্ষে এই একটি মাত্র অমোঘ মন্ত্র আছে।

বিদ্যাসাগর—কথাটি উচ্চারণেই পুণ্য। এটা বাঙালি জাতির কাছে উচ্ছ্বাসের কথা নয়, উপলব্ধির কথা। তারই আদর্শকে অনুসরণ করে  আমাদের জীবন অনেকখানি গড়ে উঠেছে, চরিত্র বিকশিত হয়েছে।

শিক্ষিত-সমাজের মাঝে তিনি দেশীয় পোশাকের গৌরব নিয়ে প্রথম অগ্রসর হয়েছিলেন; তিনি যদি ধুতি, চাদর ও চটিজুতা পরিহিত হয়ে সবার সামনে যাতায়াত না করতেন তাহলে আমরা, অন্তত নতুন প্রজন্ম, আজও দেশি পোশাকের প্রতি অনুরক্ত হতো কি না সন্দেহ।

বিদ্যাসাগরের বহু অসাধারণত্বের মধ্যে এটিও একটি। একথা এই প্রজন্মকেও স্বীকার করতে হবে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসেও ঠিক এমন একটি চরিত্রের মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

আরও পড়ুন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অপরাজেয় কথাশিল্পী 

তার অতি সরল ও সাধারণ জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অসাধারণ। তার ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, জ্ঞান, বিদ্যা, শক্তি, সাহস ও গঠনশক্তি ছিল অসাধারণ। সর্ববিষয়েই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা; তার জীবনের অতি ক্ষুদ্র কার্যটির মধ্য দিয়েও তাই প্রকাশ পেয়েছে।

তিনি কর্মী ছিলেন—কল্পনাবিলাসী ছিলেন না। তার দৃষ্টি শুধু সম্মুখেই ছিল না, বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিতও ছিল। তার চরিত্র-মহিমায় বাঙালির বহুদূরের ভবিষ্যৎ পর্যন্ত আলোকিত হয়েছে। স্ত্রী শিক্ষাবিস্তারের ব্যাপারে আর কেউই তার ন্যায় অগ্রসর হতে পারেননি।

শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা যেটুকু ক্ষুদ্র শক্তিতে রূপান্তর হয়েছি, তা নিঃসন্দেহে তারই আদর্শকে অনুসরণ করে একথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষাই ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র তাইতো কেমন করে আমাদের দেশের সর্বত্র জ্ঞান বিস্তার হয়, তাই ছিল তার জীবনের একমাত্র সাধনা। সেই সাধনার উত্তরাধিকারই আমরা এবং আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যেন এক আলোর দিশারী হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকেও আলোকিত করবে।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক