বর্তমান সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাদক। এই ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি শুধু সমাজকেই কলুষিত করছে না বরং যুবসমাজকে অকর্মণ্য করে তুলে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নকে সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই আমরা দেখতে পাই, মাদক চোরাচালানের খবর, মাদকসহ অপরাধী গ্রেফতারের খবর। নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সকলে এই ভয়াবহ অপরাধের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। মাদক হয়ে উঠছে যুবসমাজের চিন্তা ও চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। যা ভয়ানক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এসব মাদক গ্রহণের ফলে শরীরে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে এবং মাদকের প্রভাবে অন্যান্য সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণরা। অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে মাদক সেবনকারীর নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এমন কি কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। কিছু কিছু মাদক গ্রহণে সেবনকারীর হ্যালুসিনেশন হয়। তার সামনে এমন সব অলীক বিষয় ঘটে যা আসলে বাস্তবে ঘটা সম্ভব নয়।

নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সকলে এই ভয়াবহ অপরাধের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। মাদক হয়ে উঠছে যুবসমাজের চিন্তা ও চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। যা ভয়ানক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে মাদক সেবনের কারণে শারীরিক ক্ষতি ছাড়াও মানসিক রোগ হয় এবং খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধেও অনেকে জড়িয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের জের ধরে সামনে আসে ওই শিক্ষার্থী বন্ধুদের সাথে এলএসডি সেবন করে দা নিয়ে নিজেই নিজের গলায় আঘাত করেন। তাছাড়া এলএসডি গ্রহণ করে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, বাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়া বা অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার বেশকিছু ঘটনা পুলিশের কাছে নথিবদ্ধ হয়েছে।

মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধ ও তার অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ বর্তমানে অপরাধের ধরন ও ঘটনার সাথে যুগোপযোগী না হওয়ায় পুরনো আইনটি বাতিল করা হয়। যার ফলে আমরা সুদূরপ্রসারী এবং যুগোপযোগী একটি আইন পাই যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ নামে পরিচিত। সমসাময়িক সব ধরনের বিষয় এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বর্তমানে অনেক নতুন নতুন মাদকের উদ্ভাবন হচ্ছে। নতুন যেকোনো ধরনের মাদকদ্রব্য আবিষ্কৃত হলেই তা এই আইনের আওতায় আসবে এটি স্পষ্টভাবে আইনে বলা আছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় সব ধরনের মাদকের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচারের এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে।

আইনে অ্যালকোহল ব্যতীত অন্যান্য মাদকদ্রব্য বা মাদকদ্রব্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় এই আইনে এসেছে।

শুধু তাই নয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০২০ কার্যকর করার মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু তাতেও দেশে মাদক সংক্রান্ত অপরাধ কমছে না, আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। মাদকাসক্তির প্রভাব ক্রমশ গ্রাস করছে আমাদের সমাজকে।

যারা মাদক ব্যবসা, সরবরাহ, চোরাচালান, অর্থ সরবরাহের সাথে জড়িত তারা যেন প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০২০ কার্যকর করার মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু তাতেও দেশে মাদক সংক্রান্ত অপরাধ কমছে না, আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

মাদকের পৃষ্ঠপোষকদের কঠোর আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী, পৃষ্ঠপোষক, চোরাচালানকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং নতুনভাবে সৃষ্ট মাদকের আগ্রাসন রোধে ট্রাইব্যুনালের পরিবর্তে বিশেষ আদালত গঠন করে এসব অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

মাদকাসক্তি এমন একটি সমস্যা যা শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমাদের তরুণ ও যুবসমাজকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগে কাজ হবে না। এর নিয়ন্ত্রণে শিশু বয়স থেকে সবাইকে মাদকের খারাপ দিক সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার অবস্থান থেকে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। সেই সাথে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে।

স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় উপাসনালয়, সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, সমাজের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সকলকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। মাদক মুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট