করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের আঘাতে বাংলাদেশ এখন বিপর্যস্ত। আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই সংক্রমণ হার প্রায় ৩০ শতাংশ যা আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। অতিদ্রুত এই সংক্রমণের রাশ টেনে ধরতে না পারলে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ।

বর্তমান বাস্তবতায় তাই সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কঠোর এই বিধিনিষেধের কারণে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তা মোটেও আশানুরূপ নয়। আবার দীর্ঘকাল লকডাউনের মতো কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ রাখাও বাস্তবে অসম্ভব। তাই ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলার ঘোষণা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ের জন্য জনগণকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা এবং দেশব্যাপী গণটিকা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন এক্ষেত্রে লকডাউনের বিকল্প হতে পারে।

করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম ও সহজলভ্য হাতিয়ার হলো মাস্ক। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সকল স্তরের মানুষকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করে সকলের মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক সহজলভ্য করতে হবে, প্রয়োজনে সারাদেশে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে এবং তা অব্যাহত রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত: করোনা বিস্তার রোধে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। নমুনা পরীক্ষা বেশি হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। যাদের মাঝে করোনা উপসর্গ দেখা যাবে তাদের সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে করোনা পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে।

করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম ও সহজলভ্য হাতিয়ার হলো মাস্ক। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সকল স্তরের মানুষকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করে সকলের মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে।

র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার এই সেবা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃত করতে হবে। কারণ উপসর্গধারী কোনো ব্যক্তি যখন পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারবে যে, সে করোনা আক্রান্ত তখন নিজ থেকেই সে পরিবার তথা প্রতিবেশীর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। আর সময় মতো চিকিৎসকের পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে। তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরাও পরীক্ষা, আইসোলেশনসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। কিন্তু পরীক্ষা না করলে সেই ব্যক্তি অবাধে চলাফেরা করে সংক্রমণের বিস্তার ঘটাবে। হঠাৎ করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। বর্তমান সময়ে দেশের গ্রামাঞ্চলে করোনা উপসর্গ নিয়ে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।    

করোনা সংক্রমণ রোধে প্রধানতম ও কার্যকর হাতিয়ার হলো টিকা। শুরুতে ধীরগতিতে হলেও এখন বিপুল পরিমাণ টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত হচ্ছে। দেশে ইতিমধ্যে ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না ও সিনোফার্মের টিকা এসেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার সারাদেশব্যাপী গণটিকা কর্মসূচির মতো বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইতিমধ্যেই সরকার ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে দেশের সকল নাগরিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করার জন্য কার্যক্রম শুরু করেছে, যা সত্যিকার অর্থেই একটি প্রশংসনীয় ও সাহসী উদ্যোগ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য টিকার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করে শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে নিকটস্থ কেন্দ্রে টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

করোনা সংক্রমণ রোধে প্রধানতম ও কার্যকর হাতিয়ার হলো টিকা। শুরুতে ধীরগতিতে হলেও এখন বিপুল পরিমাণ টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত হচ্ছে।

১৮ বছরোর্ধ্ব প্রায় ১১ কোটি মানুষের জন্য গণটিকার এই কর্মসূচি সফল করতে পারলে করোনা মোকাবিলায় সফলতা আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গণটিকা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে পারে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সমূহ চিহ্নিত করে তা দূরীকরণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

দেশে বর্তমানে কয়েক ধরনের টিকা এসেছে যেগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোল্ড-চেইন বজায় রেখে সংরক্ষণ করতে হয়। যেমন অক্সফোর্ড ও সিনোফার্মের টিকা ২-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে, মডার্নার টিকা ১৫-২৫ ডিগ্রিতে এবং ফাইজার এর টিকা ৬০-৮০ ডিগ্রিতে সংরক্ষণ করা যায়। তবে ফাইজার ও মডার্নার টিকা ২-৮ ডিগ্রিতে ১ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। কাজেই সঠিকভাবে টিকা সংরক্ষণ ও প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবল, নার্স ও টেকনিশিয়ান। আর এগুলো নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু তদারকি।

গণটিকা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের আরেকটি অন্তরায় হতে পারে টিকা কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা। মানুষের তাড়াহুড়ো ও বিশৃঙ্খল আচরণের জন্য সুষ্ঠুভাবে টিকা প্রদান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আগেই টিকা কেন্দ্রগুলোতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত রাখতে হবে। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে কোনো ব্যক্তি যেন টিকা নিতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি, মহামারি মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্দেশিত পদক্ষেপ সমূহ বাস্তবায়নের ফলে চিকিৎসা সেবা ও ব্যবস্থাপনার যে প্রভূত উন্নতি হয়েছে তা চলমান রাখতে আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন। গণটিকা কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি গণহারে নমুনা পরীক্ষা ও বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে করোনা মোকাবিলায় সফলতা আসবে।

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়