ছবি : সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ বরাবরই মনে প্রাণে তরুণ ছিলেন। তরুণদের ওপর তার ছিল অন্তহীন ভরসা। তিনি দুই শতাব্দীর মানুষ। পূর্ব ও পশ্চিমের সভ্যতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। দুই বিশ্বযুদ্ধ তার চোখের সামনেই ঘটেছে। শেষ জীবনে ‘সভ্যতার সংকট’ও দেখে গেছেন। তবে মনুষ্যত্বের গৌরবের ওপর আস্থা হারাননি।

শেষ পর্যন্ত মানবতারই জয় হবে এই আশাবাদ বুকে ধারণ করেই তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার এই আশাবাদের উৎস ছিল স্বদেশি সমাজ। তার অন্তর্নিহিত শক্তি। আর এই শক্তিকে বিকশিত করার জন্য তার আস্থা ছিল তরুণ প্রজন্মের ওপর। কেননা আজীবন তিনি তরুণদের চোখ দিয়েই বিশ্বকে দেখেছেন।

তিনি যে প্রাচ্যে পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখতেন তার মূলে মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং বিজ্ঞানমনস্কতার বিষয় দুটো খুবই গুরুত্ব পেত। তাই তার শিশুতোষ লেখা ‘বীরপুরুষ’ থেকে জানতে পারি বিপদ থেকে মাকে বাঁচাতে এক কিশোরের বীরত্বের কথা।

আরও পড়ুন : বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ? 

তার ছোট গল্পেও শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি খুবই উজ্জ্বল। ‘বলাই’ গল্পের ‘বলাই’, ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের ‘রতন’, কিংবা ‘ছুটি’ গল্পের ‘ফটিক’ আজও বেঁচে আছে কিশোরদের হৃদয় জুড়ে। ছোট-বড় সবাইকে টানে তার ‘গল্পস্বল্প’ বইটির চরিত্রসমূহ। 

প্রবীণদের ওপর তার আস্থা ছিলই না বলা চলে। অন্তত ‘সবুজের অভিযান’ কবিতাটি পড়লে তাই মনে হয়। ঐ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বেশ স্পষ্ট করেই নবীন প্রজন্মের ওপর তার গভীর আস্থার কথা প্রকাশ করেছেন। শুরুই করেছেন এই বলে—

‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’

‘আয় দুরন্ত, আয়রে আমার কাঁচা’—বলে তরুণদের আহ্বান করেছেন ‘অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়’ আটকে থাকা নিশ্চল প্রবীণদের ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তোলার জন্য। তাদের চোখ-কান দুইই যে ডানার নিচে ঢাকা পড়ে আছে। বাইরের দিকে একটুও তারা তাকান না।

আরও পড়ুন : নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য

মাটিতে পা ফেলে সামনে চলতে তাদের দারুণ অনীহা। তাই ‘ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে’ তাদের ঘুম ভাঙ্গাতে বলেছেন কবি তরুণদের। প্রয়োজনে নিশ্চলদের ‘টেনে-বেঁধে বাঁধা পথের শেষে’ নিয়ে আসার এই আহ্বান তরুণদের উজ্জীবিত করার জন্যেই।

কবির ধারণা তরুণদের আছে ‘অফুরান প্রাণ’। সেই প্রাণ দেদারছে ছড়িয়ে দিয়ে তারাই যে পারবে ‘জীর্ণ জরা ঝরিয়ে’ দিতে সে বিশ্বাস কবির বরাবরই ছিল। তাই তো তাদের ‘চিরযুবা তুই যে চিরজীবী’ বলতে একটু দ্বিধা করেননি রবীন্দ্রনাথ।

তরুণ মনের এই যে বাঁধন-ছাড়া ভাব তাকে লালন করার প্রয়োজন রয়েছে। আর একমাত্র উপযুক্ত শিক্ষাই পারে তারুণ্যের এই সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটাতে। তিনি দুঃখ করে বলেছেন, সেই সময়ের ইংরেজ শাসকরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একদিকে কিছু উচ্চমার্গীয় আমলা এবং অন্যদিকে অনুগত সাধারণ কেরানি তৈরির ব্যবস্থা করেছে।

এই শিক্ষা ব্যবস্থায় তরুণদের স্বদেশি সমাজের বিকাশের জন্য ‘সবুজ নেশা’ ধরাবার মতো কোনো অনুকূল উদ্যোগই নেই। অথচ শাসক ইংরেজরা তাদের ছেলেমেয়েদের অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে ঠিকই চিত্ত যেমনটি চায় তেমন শিক্ষারই ব্যবস্থা করেছিলেন।

কবির ধারণা তরুণদের আছে ‘অফুরান প্রাণ’। সেই প্রাণ দেদারছে ছড়িয়ে দিয়ে তারাই যে পারবে ‘জীর্ণ জরা ঝরিয়ে’ দিতে সে বিশ্বাস কবির বরাবরই ছিল। তাই তো তাদের ‘চিরযুবা তুই যে চিরজীবী’ বলতে একটু দ্বিধা করেননি রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘... য়ুরোপের ছেলেদের মানুষ করিবার পন্থা আপনা-আপনি পরিবর্তিত হইতেছে। ইহাদের চিত্ত যতই নানা ভাবের জ্ঞানের অভিজ্ঞতায় সংস্রবে সচেতন হইয়া উঠিতেছে ততই ইহাদের পথের পরিবর্তন দ্রুত হইতেছে। ... চিত্তের গতি-অনুসারেই শিক্ষার পথ নির্দেশ করিতে হয়। .... নানা লোকের নানা চেষ্টার সমবায়ে আপনিই সহজ পথটি অঙ্কিত হইতে থাকে। এইজন্য সকল জাতির পক্ষেই আপন পরীক্ষার পথ খোলা রাখাই সত্যপথ-আবিষ্কারের একমাত্র পন্থা।’ (‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’, রবীন্দ্ররচনাবলী ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃ: ৬৯৬)।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সাহিত্য : পঞ্চাশ পেরিয়ে 

আর এজন্যেই রবীন্দ্রনাথ শিশুকাল থেকেই শিক্ষাপ্রণালি ও শিক্ষকদের অনুকূল থেকে তরুণদের চিত্তের গতি-নির্ভর শিক্ষা প্রদানের পক্ষে ছিলেন। তিনি ‘রাশিয়ার চিঠিতে’ও ‘প্রাণবান’ শিক্ষার কথা বলেছেন। ‘জানতে চাইতে’ বা ‘প্রশ্ন করতে’ শেখানোর দিকটি যে আমাদের দেশে উপেক্ষিত সে কথা বলতে ভোলেননি। আমাদের শিক্ষকরা শুধু পাঠ দিতে পারেন, প্রাণ দিতে পারেন না বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন।

তবে একেবারে নিরাশও ছিলেন না তিনি। স্বদেশি সমাজের আকর্ষণ যে ধীরে সেদিনের শিক্ষার্থীদের মাঝেও বাড়ছিল তারও ইঙ্গিত তিনি করেছেন ‘বঙ্গীয়-সাহিত্য পরিষৎ’ আয়োজিত এক সভায় ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ নামের এক লিখিত প্রবন্ধে। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৬৫৮-৬৬৭)। এই ছাত্রদের অনেকেই পূজার ছুটিতে গ্রামে যাচ্ছিল। সেই গ্রাম-বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে সচেষ্ট করার আহ্বানই ছিল তার ভাষণের মূল লক্ষ্য।

ইংরেজদের দেওয়া পাঠ-প্রণালি সত্ত্বেও দেশমাতৃকার হৃদয় জয় করাও যে তাদের শিক্ষার বড় লক্ষ্য হতে পারে সেই কথাটিই নানাভাবে তিনি ঐ সম্ভাষণে তুলে ধরেছিলেন। নিজের মধ্যে একটা ‘স্বাতন্ত্র্যের অনুভূতি’ জাগানিয়া সেই বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ তারুণ্যের শক্তি বিকাশের নানা উপায়ের কথা বলেছিলেন। বারেবারে তিনি দেশপ্রেমের কথা তুলে এনেছিলেন সেই সম্ভাষণে।

আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন

দেশের সব জিনিসেরই যে মূল্য অশেষ, সে কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘নিজের স্বাধীন শক্তির গৌরব’ নিজের অন্তরে অনুভবের তাগিদ দিয়েছিলেন। আরও বলেছিলেন, ‘কলেজের বাহিরে যে দেশ পড়িয়া আছে তাহার মহত্ত্ব একেবারে ভুলিলে চলিবে না। কলেজের শিক্ষার সঙ্গে দেশের একটা স্বাভাবিক যোগ স্থাপন করিতে হইবে।’ (ঐ, পৃ: ৬৬০)।

ছাত্রদের জন্য স্বাধীন শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করার পরামর্শ দেন। যে শিক্ষা ‘দৃষ্টির শক্তি, মননের উদ্যম, সৃষ্টির উৎসাহ’ দেবে তেমন ‘নিজের শক্তি প্রয়োগ ও বুদ্ধির কর্তৃত্ব অনুভব’ করার শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান তিনি সেদিন করেছিলেন। মুখস্থ বিদ্যার বদলে উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশের শিক্ষার ওপর তিনি জোর দেন।

পাশাপাশি বাঙালির ইতিহাস চর্চার তাগিদও তিনি তরুণদের দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘... যে ইতিহাস আমাদের দেশের জনপ্রবাহকে অবলম্বন করিয়া প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছে, যাহার নানা লক্ষণ নানা স্মৃতি আমাদের ঘরে বাহিরে নানা স্থানে প্রত্যক্ষ হইয়া আছে।’ (ঐ, পৃ: ৬৬১)

আরও পড়ুন : মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত 

সেই ইতিহাসের চর্চা জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষ যখন রোগে মরে, দারিদ্র্যে জীর্ণ হয়, অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় নষ্ট হয় তখন এসবের প্রতিকারে সচেষ্ট না হয়ে বিদেশি সাহিত্য-পুঁথির বাক্যে দেশপ্রেমের বুলি আওড়ায় তখনই এই শিক্ষা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারে উৎসাহ জোগায় না।

এই উপলক্ষে তিনি জাপানের বিখ্যাত পেট্রিয়ট যোশিদা তোরাজিরোর প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিনি চাল-চিড়া বেঁধে পায়ে হেঁটে সারা দেশ ভ্রমণ করেছেন, দেশকে জেনেছেন, পথে পথে শিক্ষা বিতরণ করেছেন এবং স্বদেশের মাটিতেই প্রাণ দিয়েছেন।

ছাত্রদের জন্য স্বাধীন শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করার পরামর্শ দেন। মুখস্থ বিদ্যার বদলে উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশের শিক্ষার ওপর তিনি জোর দেন।

দেশকে ভালোবাসার এই নজির তুলে ধরে কবি তরুণদের স্বদেশের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। সর্বদাই মন দিয়ে মানুষের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে বলেছেন। যুবকদের আশার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করতে এবং তাদের স্বদেশ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রবীণদেরও খোলস ছেড়ে নবীনের পাশে এসে দাঁড়াতে বলেছেন। নবীনে-প্রবীণে মিলেই নৈরাশ্য বিসর্জনের উদ্যোগ নিতে বলেছেন।

আরও পড়ুন : নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা 

তরুণদের আরও বলেছেন, ‘শুধু বড় জিনিস কল্পনা করিলেও হইবে না, বড় দান ভিক্ষা করিলেও হইবে না এবং ছোটমুখে বড় কথা বলিলেও হইবে না, দ্বারের পার্শ্বে নিতান্ত ছোট কাজ শুরু করিতে হইবে।’ (ঐ, পৃ: ৬৬৫)

সবশেষে তিনি তাদের ‘স্বদেশকে জানো ও তার জন্য কিছু করো’—এই আহ্বান জানিয়ে দশজনে মিলে দেশের ভাগ্য পরিবর্তনে উদ্যমী ও উদ্যোগী হতে বলেন। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের তারুণ্য বিষয়ক এসব কথা আজকের বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।

করোনার কারণে অনানুষ্ঠানিক খাতে ব্যাপক কর্মচ্যুতি ঘটেছে। আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিখাতেও কর্মচ্যুতি ঘটেছে। এমনকি মধ্যবিত্তেরও আয় রোজগার কমে গেছে। নগরের বস্তিতে বস্তিতে দারিদ্র্য প্রকট হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের তরুণ সমাজের সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পুরো সমাজকে সচেষ্ট করে এই মহাদুর্যোগ মোকাবিলার জন্য তাদের স্বেচ্ছাশ্রমিকের ভূমিকা পালনের যে সুযোগ এসেছে তা যেন হেলায় না হারায় তারা।

আরও পড়ুন : শতাব্দীর পশ্চাতে নজরুল অবলোকন 

এই মাসে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিবস। এই মাসে দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালির গভীর দেশপ্রেম ও দুঃখী মানুষের পাশে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ দাঁড়াবার এই সুযোগ নিশ্চয় হাতছাড়া করবে না আজকের তরুণ সমাজ। ব্যক্তিখাত, এনজিও এবং সরকারি খাতকে মিলেমিশেই এই মহাসংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যে তরুণদের সক্রিয়তায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানের উদ্দীপনায় তারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, তারা নিশ্চয় এই মহাসংকটে বসে থাকতে পারে না। নবীনে-প্রবীণে মিলেই এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

ড. আতিউর রহমান ।। বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক