বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের চলাফেরার স্বাধীনতা, জন্ম-সনদ, শিক্ষা, চাকরি ও অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা দিতে বিশ্বব্যাংক চিঠি পাঠিয়েছে। ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ প্রস্তুতের প্রস্তাবে বিশ্বব্যাংক এই সুপারিশ করল। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বারবারই প্রস্তাব দিয়েছিল। সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গৎবাঁধা উদাসীনতাই দৃশ্যমান।

রোহিঙ্গারা পূর্বতন বার্মা, অধুনা মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের মুসলমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সেখানে তারা বসবাস করেছে হাজার বছর ধরে। বাংলা ভাষাভাষী এবং ধর্মীয় কারণে রোহিঙ্গারা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে নিজভূমে। বর্ণবাদী রাখাইনদের দ্বারা শিকার হয়েছে চরম বৈরিতা। মিয়ানমারের এমন হীন কাজে নির্বিকার ছিলেন নোবেল জয়ী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি। গণহত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েও নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে মারিয়া ছিল সেনাবাহিনী। সংঘর্ষের তীর ছুঁড়েছিল বাংলাদেশ সীমান্তে।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী। নবম-দশম শতাব্দীতে আরাকান রাজ্যে যারা পরিচিত ছিল রোহাঙ বা রোহাঙ্গ নামে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বার্মার ১৩৯ জাতিগোষ্ঠীর একটি তালিকা প্রকাশ করে ব্রিটিশরা। তাতে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখান থেকেই ঘটে রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত।

মিয়ানমার সরকার বারবার অভিযোগ উত্থাপন করেছে যে, রোহিঙ্গারা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে অভিবাসিত একটি উপজাতি। তাদেরকে দেওয়া হয়নি নাগরিকত্ব। ১৭৮৪ সালে নিজ ভূখণ্ড থেকে প্রথম রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে ১৯৪২, ১৯৭৮, ১৯৯২ এবং ২০১৭ সালে শিকার হয় পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যার।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বার্মার ১৩৯ জাতিগোষ্ঠীর একটি তালিকা প্রকাশ করে ব্রিটিশরা। তাতে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখান থেকেই ঘটে রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গণহত্যার শিকার হয়ে জীবন বাঁচাতে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সীমান্তে। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে আমরাও গণহত্যার শিকার হয়েছিলাম। সেদিন সীমান্ত ধরে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল লাখ লাখ বাঙালি। আশ্রয় জুটেছিল শরণার্থী শিবিরে। মানবিক সেই দায় আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় নিয়মিত।

পেছনে মিয়ানমার জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর উল্লাস, সামনে নাফ নদী, মানুষের ঢল নেমেছিল বাংলাদেশ সীমান্তে। নাফ নদী পাড়ি দিতে অনেক রোহিঙ্গারা মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিল। সীমান্তে প্রথমে কড়াকড়ি পাহারা বসলেও মানবিক কারণেই রোহিঙ্গা প্রাণের চিৎকারে সীমান্ত খুলতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। পরিণামে ভুক্তভোগী হয়েছে বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে জোরপূর্বক এবং মানবিক কারণে সাময়িক সময়ের জন্য বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। সংকট নিরসনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ২৩ নভেম্বর ২০১৭ প্রথম প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত স্বাক্ষর হয়। প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত অ্যারেঞ্জমেন্টে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।

১৬ জানুয়ারি ২০১৮ দুই বছরের শর্ত রেখে স্বাক্ষরিত হয় মাঠ পর্যায়ের Physical Arrangement নামের ৩০ দফার আরেকটি চুক্তি। ঐ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে ৮ হাজার ৩৭৪ জনের তালিকা দেয় বাংলাদেশ। শেষে প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৫ নভেম্বর ২০১৮। দুঃখজনক হলো, জীবনের নিরাপত্তা এবং আবাসস্থল বিষয়ে অনিশ্চয়তায় ফিরে যেতে অস্বীকার করে রোহিঙ্গারা। মাটি হয়ে যায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রাথমিক উদ্যোগ। পরবর্তীতে চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় ফেরানোর উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কের পক্ষে মত দিলে রোহিঙ্গারা দেশের ভেতরে যেকোনো স্থানে স্বাধীনভাবে যাতায়াত করতে পারবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারবে।

রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাঁচ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। জাতিগত নিধন বন্ধ, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় তৈরি, প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসনে জোর দিয়েছিলেন তিনি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে আফ্রিকান দেশ গাম্বিয়া। অথচ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে দীর্ঘদিন চুপ ছিল ক্ষমতাধর রাষ্ট্র এবং সংস্থাগুলো। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো মতৈক্যে পৌঁছালেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। বরং ভাসানচরে দ্বিতীয়বার পানিতে ভাসলো রোহিঙ্গা জীবন।

রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসনে যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেখানে বিশ্বব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় প্রস্তাব দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে রোহিঙ্গাদের মিশিয়ে দেওয়ার বিষয়ে। এতে সুপারিশ করা হয়েছে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে রোহিঙ্গাদের নাগরিক সুবিধা প্রদানের। বাংলাদেশ প্রস্তাবটি মানলে দুই বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। এই অর্থ কেবল রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নেও ব্যয় করা যাবে।

বিশ্বব্যাংকের রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কের পক্ষে মত দিলে রোহিঙ্গারা দেশের ভেতরে যেকোনো স্থানে স্বাধীনভাবে যাতায়াত করতে পারবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারবে। নিবন্ধনের আওতায় এনে পর্যায়ক্রমে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জমি কেনা, নির্বাচন করার অধিকারও দিতে হবে ঠিক বাংলাদেশি নাগরিকদের মতো। ফলাফলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে।

বর্তমানে বাংলাদেশ অতিক্রম করছে জনসংখ্যার বোনাস যুগে। অর্থাৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যা, নির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। এর কারণ মৃত্যু হারের হ্রাস এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা গেছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। উপরন্তু করোনা মহামারিতে নির্ভরশীল প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও কমেছে অস্বাভাবিক রকমের। ফলে বেড়েছে কর্মক্ষম ১৫-৬৪ বছরের জনসংখ্যা। জনসংখ্যার বোনাস যুগ যথাযথ কাজে লাগানো গেলে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে দ্রুত। এই জনসংখ্যা কোনো না কোনোভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে, যা অবদান রাখে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। তখন জনগণের মধ্যে বৃদ্ধি পায় সঞ্চয়ের স্পৃহা। শিল্পক্ষেত্রে বাড়তে থাকে সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ। ব্যাপক হারে সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের। শ্রমশক্তি রফতানি করেও অর্জিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

করোনা মহামারিতে প্রতিটি রাষ্ট্রেই নেমেছে অর্থনৈতিক ধস। ফলাফলে বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও হয়েছে কর্মী ছাঁটাই। নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে সংকুচিত। শঙ্কা আছে সরকারি-বেসরকারি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের। শ্রমশক্তি রফতানি থমকে দাঁড়িয়েছে।

করোনাকালীন সময়ে বিমান সংকট এবং দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সংকটে কাজ হারিয়েছেন অনেক বিদেশগামী শ্রমিক। সঞ্চয় প্রবণতা দূরে থাক, বর্তমানই হিমশিম খাচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে কর্মক্ষম এই মানুষগুলোই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে জন্মহার নিয়ন্ত্রিত সীমিত সংখ্যক মানুষের উপরে। অর্থাৎ মহামারি পরিস্থিতির বাস্তবতার শিকার হয়ে ২০৪২ সাল পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্থানীয় বোনাস জনসংখ্যা আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপের ভয় আছে, আমাদের নিজেদের জনসংখ্যাই যেখানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে অতিরিক্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে দাঁড়াতে হবে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি।

আমাদের এ ভূখণ্ডের মাটি কোনো কাগুজে চুক্তিতে নয়, ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জন করা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয় দিয়ে পাহাড়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথেও তৈরি হয়েছে বৈরিতা। ভবিষ্যতে এ বৈরিতা আরও বাড়বে।

বিশ্বব্যাংক যেন তাদের সুপারিশ পুনর্বিবেচনা করে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের তাড়াতাড়ি ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ দেয় এবং বাংলাদেশের সহায়ক হয় উপকূল পরিবেশ তৈরিতে। আন্তর্জাতিক যেকোনো সংস্থার অযৌক্তিক চাপ আরও দৃঢ়ভাবে সরকারপক্ষ সামাল দিবে সেই প্রত্যাশা।

সজীব ওয়াফি ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক