করোনা মহামারির এই অস্থির সময়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। শহরে যেন করোনা আর ডেঙ্গুর প্রতিযোগিতা। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন আড়াইশ থেকে তিনশ ডেঙ্গু রোগী। প্রশ্ন হলো, গত শতাব্দীর ঢাকায় কি নাগরিকেরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হতো? হতো না, হলেও অল্পবিস্তর, মহামারি রূপে হয়নি কখনো। তাহলে বর্তমান শতাব্দীতে হঠাৎ করে বৃহৎ পরিসরে সংক্রমিত হলো কেন! আর বৃষ্টির শেষে এই সিজনেই মশার প্রাদুর্ভাবে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কেন হয়? সাম্প্রতিক সময়েই কেন মশা বেশি বাড়ল? সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং আমাদের নাগরিক জীবনের অবহেলা, অলসতা আর অসচেতনতায় ভরপুর।

ডেঙ্গু জ্বর মূলত এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ যখন এই মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কামড় দিবে, তখন দ্বিতীয় ব্যক্তিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হবেন।

জার্নাল নেচারের বর্ণনা মতে, এডিস মশা দেখতে ছোট এবং কালো। যাদের শরীরে আছে সাদা সাদা ডোরাকাটা দাগ। এডিস মশা বসবাস করে সুন্দর সুন্দর দালানকোঠায়। ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের অপছন্দ। স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে এই মশা। সেখানে লার্ভা ফুটে বাচ্চা হয় এদের।

আশির দশকের বা তারও পূর্বের ঢাকায় একটু ফেরা যাক। পর্যাপ্ত গাছগাছালিতে সৌন্দর্যমণ্ডিত এক নগর, আছে বেশকিছু জলাশয়, সেই জলাশয়ে আছে ব্যাঙ। বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অনেকটা স্বাভাবিক ছিল তখন। পাঁচ তলার চেয়ে উঁচু কোনো ভবন ছিল না। থাকলেও কম, হাতেগোনা।

প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে কম ছিল শতগুণে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে দিনে দিনে ঢাকার উপর বেড়েছে মানুষের চাপ, রাতারাতি হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। জলাশয় ভরাট করে তৈরি হলো উঁচু উঁচু ভবন। বেশিরভাগ উঁচু ভবনগুলোর মাঝে পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। কোনো কোনো ভবন এসে পড়েছে ঠিক রাস্তার উপরে। দখল করেছে সরকারি জায়গা।

প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে দিনে দিনে ঢাকার উপর বেড়েছে মানুষের চাপ, রাতারাতি হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। জলাশয় ভরাট করে তৈরি হলো উঁচু উঁচু ভবন।

বর্তমান ঢাকায় ব্যাঙের দেখা মিলবে না। অথচ মশা হচ্ছে ব্যাঙের একমাত্র প্রিয় খাবার। অপরিকল্পিত নগরায়ণে জলাশয় ভরাট করার সময়ে, ব্যাঙ বিলুপ্তির সময়ে কিন্তু আমাদের পরিকল্পনাবিদরা ভাবেননি।

ভদ্রলোকের শহরে ব্যাঙ থাকতে পারে! চোখের অলক্ষ্যে নাগরিকেরা ব্যাঙ তাড়িয়ে জায়গা দখল করেছেন। যেমনটা কিছুদিন আগে আমাদের ঢাকার শহরে ইনজেকশন দিয়ে, অজ্ঞান করে, তরতাজা কুকুরগুলোকে মারা হয়েছে। কুকুর মারা হলে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক প্রাণী প্রেমী ছাড়া কেউ কথা বলেননি। বরং মাঝরাতে ঘুরে বেড়ানো কুকুরের চিৎকারে ভদ্রলোকের ঘুমভাঙানি কুকুর মারা সঠিক! কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্কের ভয়ে কুকুরকে ভ্যাকসিন দিয়েই বাঁচিয়ে রাখা যেত। অথচ ঘুরে বেড়ানো এই কুকুরগুলোই কিন্তু ঢাকার শহরে রাস্তার মলমূত্র, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

সিটি করপোরেশনের ময়লা যেখানে ফেলা হয়; সেসব এলাকায় নাক চেপে হাঁটতে হয়। সেসব জায়গা সাধারণ মশা, এমনকি গতবছরের চিকুনগুনিয়ার আস্তানা। উঁচু ভবনগুলোর মাঝে যে অল্প জায়গা তা যেন ময়লার ভাগাড়। ড্রোন দিয়ে যদি উপর থেকে ছবি তোলা যায়, তাহলে বেরিয়ে আসবে আমাদের নাগরিক দায়িত্বের শ্রী। এই পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বসবাসকারী নাগরিক জানালা দিয়ে টুকটাক ময়লা ফেলতে ফেলতে দীর্ঘদিনে এই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

ব্যাচেলর মেসের রুমগুলোতে ময়লার স্তূপ; জানালা থেকে ফেলা হয় থু থু। পলিব্যাগে বমি করে সেই ময়লা পারলে পথচারীদের গায়ে মারে বাসযাত্রী। আমাদের প্রতিদিনের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া এসকল কাজকর্মেই মশা জন্মাতে সহায়ক হয়েছে।

গাছ কেটে, ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ির অতিরিক্ত প্রচলন, কলকারখানার নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড ভ্যাপসা গরমের সৃষ্টি করেছে। অহরহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের ব্যবহার প্রতিবেশে ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। বনায়নও ধ্বংস করা হয়েছে অতিদ্রুত। ফলাফলে বৃষ্টির পরপরই অতিরিক্ত ভ্যাপসা গরমে জমে থাকা পানিতে মশা জন্মানোর সুযোগ পায়।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিরোধ হলো, এডিস মশার বিস্তার ধ্বংস এবং কামড় থেকে নিজেদের রক্ষা করা। থাকতে হবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির আশেপাশে ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার রাখতে হবে। ঘরের বাইরে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টির পানি জমে জন্ম নিতে পারে মশার লার্ভা—যেমন পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, পানির ট্যাংক, মাটির পাত্র, ডাবের খোসা, টিনের কৌটা, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি।

মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরঞ্চ মশার দাপট অব্যাহত ছিল সব সরকারের আমলেই।

নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে ফুলের টব। নজর রাখতে হবে ছাদ কৃষির দিকে, যেন জমে থাকা পানিতে মশার লার্ভা না জন্মে। এডিস মশার লার্ভা জন্মাতে পারে টয়লেটের অব্যবহৃত কমোডেও।

বেসিনের জমে থাকা পানির দিকে সতর্ক থাকতে হবে। এ মশা সাধারণত দিনের বেলা বেশি চলাচল করে, বিশেষ করে আলো-আঁধারি সময়টাতে। যেমন সকাল এবং সন্ধ্যার প্রারম্ভে। এ কারণে সম্ভব হলে বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের পরিবর্তে ফুলপ্যান্ট বা পাজামা পরানো যায়। প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায় মশার কয়েল বা স্প্রে।

মশারি ব্যবহারে শহুরে মানুষেরা আলস্যতা দেখায়। সুতরাং মশারি ব্যবহারে দরকার অভ্যাসগত অলসতা দূরীকরণ। গরিব মানুষকে চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে মশারি বিতরণ মশার কামড় থেকে রক্ষা করবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের মাঝের ফাঁকে ময়লার স্তূপ পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে ভবন মালিকদেরই।

নির্মাণাধীন ভবন বা আবাসিক প্রকল্প এলাকা এডিসের আড়ত। সেখানে সিটি করপোরেশন অধীনে অভিযান চালানো জরুরি। বৃষ্টির দিনে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে পরিবর্তন এবং সমন্বয় আনতে হবে সরকারি সংস্থা এবং প্রকল্পে।

মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যকরী দায়িত্বের পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় আরও জোরদার সময়ের দাবি। বেঁচে থাকার তাগিদে জলবায়ু মোকাবিলায় পরিবেশ আন্দোলন ঘরে ঘরে পৌঁছানো এখন সকলের কর্তব্য।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সবসময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যেন তাকে কামড়ে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে না পারে। খাওয়াতে হবে প্রচুর তরল জাতীয় খাবার। জানালার পাশে লাগানো যেতে পারে তুলসী গাছের মতো ভেষজ গাছ। কারণ তুলসী গাছে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উপাদান আছে, যা মশা তাড়াতে প্রবল ভূমিকা রাখে। প্রাকৃতিক উপায়ে মশা তাড়াতে কর্পূর ব্যবহারেরও বিকল্প নেই। দরজা জানালা বন্ধ করে, সকাল সন্ধ্যায় ঘরে কর্পূর জ্বালিয়ে রাখলে ভালো ফল দেয়।

যে এলাকায় ময়লার স্তূপ জমে থাকে, পর্যাপ্ত জলাশয় থাকে না, অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, জেনেশুনে ধ্বংস করা হয় বনায়ন, বাস্তুতন্ত্র নিঃশেষিত হয়, ব্যবহৃত হয় এয়ার কন্ডিশন, জলবায়ু বিপর্যয় দেখেও সচেতন হয় না, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ থাকে না; সেখানে রোগ জীবাণু আক্রান্ত হবে না তো হবে কি?

চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গু মশা তো স্বাভাবিক সেখানে। মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরঞ্চ মশার দাপট অব্যাহত ছিল সব সরকারের আমলেই।

একজন ব্যক্তি একই সাথে কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই তীব্র জ্বর অনুভূত হলে অবহেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। শত বছরের অভ্যাস একদিনে পরিবর্তন হওয়ার নয়। বেঁচে থাকার তাগিদে, মানবিক শহরে রূপান্তর ঘটাতে অংশগ্রহণ করতে হবে নাগরিকদেরই।

সিটি করপোরেশন বড়জোর রাস্তায় অ্যাকশন নিতে পারবে, কিন্তু বাড়ির দায়িত্ব ব্যক্তির। ঘরে-বাইরে মশক নিধনে সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু সমস্যা দূর হবে, সকল নাগরিকের রোগমুক্ত নিরাপদ জীবন, এই প্রত্যাশা।

সজীব ওয়াফি ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক