বলতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন অন্যমাত্রায় পৌঁছেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমরা এগিয়ে আছি উন্নয়ন বিষয়ক নানা সূচকে। মাত্র কয়েক দশক আগে যে পাকিস্তান থেকে আমরা আলাদা হয়েছিলাম সেই পাকিস্তান এখন আমাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। মাথাপিছু আয়ে বিশ্বে আমাদের রাষ্ট্রের অবস্থান দিন দিন উচ্চ পর্যায়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এই মহাসড়কে যোগ হয়েছে নতুন নতুন মেগা প্রকল্প। পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, কক্সবাজারকে হংকংয়ের আদলে গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ বা নতুন নতুন মহাসড়কসহ দেশের প্রতিটা সেক্টরে উন্নয়ন হচ্ছে।

তবে সুন্দরবনের কাছেই এমন আরেকটি বিতর্কিত উন্নয়ন প্রকল্প রামপাল। যা নিয়ে দেশে ও বিদেশে সুন্দরবনের পাশে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে জোর সমালোচনা চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। সমালোচকদের মতে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। একটি সুন্দরবন যেখানে আমাদের গর্ব হওয়ার কথা ছিল সেখানে সুন্দরবন ধ্বংস করে উন্নয়ন বরং অন্যসব উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে যখনই এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন এক পক্ষ আরেকপক্ষে দাঁড়িয়ে যুক্তি দেয় বিদ্যুতের উন্নয়ন হবে, আর বিদ্যুতের উন্নয়ন মানে দেশের অর্থনীতির চাকায় গতি আসা। এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদ এবং আমলা এমনকি দেশের জনগণের বিরাট একটি অংশ মনে করে, উন্নয়ন মানেই ইটপাথর আর রডের মাধ্যমে বড় বড় স্থাপনা। কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সবুজ মাঠ, সুন্দর এবং সমৃদ্ধ বন, দূষণমুক্ত নদী প্রয়োজন এটা আমাদের জানা থাকলেও কাজে সেভাবে সেটা গুরুত্ব পায় না।

বাস্তবতা হচ্ছে, ‘মানুষের জীবন উদ্ভিদের অধীন’। ইটপাথরের উন্নয়ন আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না ঠিক যেমনই আমরা টাকা খেয়ে বাঁচতে পারব না। উন্নত দেশ বা যারা পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন করেছে তাদের এখানে পুকুর, মাঠ, নদী সবই ঠিক আছে। উন্নয়ন করতে গিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়নি প্রকৃতিকে, কিন্তু আমরা তাই করছি। বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড সুন্দরবনকে হুমকিতে ফেলে উৎপাদন করব বিদ্যুৎ! তেমনি দেশের অনেক নদী বিলীন এই উন্নয়নে। দূষণ বা দখল করে নদীকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে অথচ নদী ছাড়া আমাদের জীবন থেমে যাবে।

আমাদের রাজনীতিবিদ এবং আমলা এমনকি দেশের জনগণের বিরাট একটি অংশ মনে করে, উন্নয়ন মানেই ইটপাথর আর রডের মাধ্যমে বড় বড় স্থাপনা।

নদীর উদাহরণ হিসেবে হবিগঞ্জের সুতাং নদীর কথা বলা যায়, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০-এ মানবজমিনের একটি প্রতিবেদন বলছে, হবিগঞ্জের মাধবপুরে কয়েক বছর আগে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কারখানা স্থাপন শুরু করতে থাকে। প্রথমে একে উন্নয়ন মনে হলে বর্তমানে তা গলার কাঁটা। মাত্র ৩০/৩৫টি কারখানার শিল্প বর্জ্যে হবিগঞ্জের ৫টি নদী বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুতাং নদী।

এই নদীকে কেন্দ্র করে ২ লাখ মানুষের জীবন চলত। ১০ হাজার হেক্টর জমি আবাদ হতো। কিন্তু এই নদীর দূষণ এমন পর্যায়ে গেছে যে, মানুষ তো দূরের কথা গরু-মহিষও সে পানি খায় না। এই একটা নদীর কারণে কত লাখ জীবন কষ্ট পাচ্ছে ভাবা যায়? অথচ আমরা শিল্পায়ন করতে পারতাম নদীকে রক্ষা করে। বরং নদীকে পূর্বের অবস্থা থেকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারলে সেটা উন্নয়নের বড় অংশ হতো।

আমরা উন্নয়ন বলতে যে ইটপাথর বুঝি তার কিছু নমুনা দেখলেই সহজে বোঝা যায়। গত বছরের ২৩ মার্চ দেশ রূপান্তরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ বন লাউয়াছড়ায় জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেখানে এই বনের একমাত্র পুকুরটির চারদিকে পাকা করে ওয়াকওয়ে, শিশুদের পার্ক, ওয়াচ টাওয়ার, ফুডকোর্ট, শিশুদের খেলার মাঠ এমনকি একটি কনফারেন্স হল বানানোর পরিকল্পনা করে বন বিভাগ। যদিও পরে এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে বন বিভাগ কারণ পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক প্রতিবাদে তারা বাধ্য হয়।

এই যে একটা সংরক্ষিত বনের উন্নয়ন মানে ইটপাথরের নতুন নতুন স্থাপনা এটা কী তার সাথে যায়? যদি এখানে উন্নয়ন করার চিন্তা থাকত সেটা হতে পারত বনকে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, বন্যপ্রাণীদের খাবারের ব্যবস্থা প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেটা, অথচ পরিকল্পনা ঠিক উল্টো ছিল। মানে ঘুরে ফিরে উন্নয়ন মানে ইটপাথর।

সিলেটকে বলা হয় দিঘির শহর। এখানে প্রচুর দিঘি ছিল। এতো দিঘি যেহেতু আর কোনো শহরে ছিল না তাই বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল এইসব দিঘির।

একসময় সারা বাংলাদেশের মধ্যে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, কিন্তু বিগত জোট সরকারের আমলে এখানে উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রচুর ইটপাথর আর রড দিয়ে ঝর্ণার পাশ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি শেড তৈরি এমনি পানি প্রবাহের দিকটাতে পাকা করে সিঁড়ি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে স্বাভাবিক বুনো চিত্র হারাল মাধবকুণ্ড, বনেরও ক্ষতি হলো, যতটা বুঝতে পারছি এই ঝর্ণা নিয়ে পর্যটকদের এখন আর তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু এলাকাটি সংরক্ষিত বনের।

সংরক্ষিত এলাকার নির্মাণ কাজ নিয়ে আইন আছে কিন্তু সেই সব আইনের আবার ফাঁকফোকর আছে যা দিয়েই মূলত এই উন্নয়ন কাজ করা হয়। কিন্তু যদি ২০ বছর আগে যেভাবে মাধবকুণ্ড ছিল ঠিক সেভাবে তাকে থাকতে দেওয়া হতো, আর কিছু না হলেও এটা সহজে বোঝা যায়, বন নিজে নিজে আরও সমৃদ্ধ হতো। বুনো ঝর্ণা আরও বেশি দেশি-বিদেশি পর্যটক টানত। প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হলেই মাধবকুণ্ডের আসল উন্নয়ন হতো।

সিলেটকে বলা হয় দিঘির শহর। এখানে প্রচুর দিঘি ছিল। এতো দিঘি যেহেতু আর কোনো শহরে ছিল না তাই বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল এইসব দিঘির। কিন্তু ইটপাথরের উন্নয়নের নিচে চাপা পড়ে এইসব দিঘি মারা গেছে। উন্নয়নের নামে সিলেট পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনসহ বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি নিজেরাও এইসব দিঘি ভরাট করেছে।

লালদিঘি নামের দিঘি ভরাট করে তৎকালীন সিলেট পৌরসভা নির্মাণ করেছে মার্কেট। সিলেট পৌরসভা থাকাকালেই বেকাদিঘি ভরাট করে নির্মাণ করা হয় জালালাবাদ পার্ক। ধোপাদিঘি ভরাট করে গড়ে উঠেছে বেশকিছু দোকানপাট। ওই দিঘির একাংশ ভরাট করে সিটি করপোরেশন পার্ক ও মসজিদ নির্মাণ করেছে।

চারাদিঘি ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদ। ওই স্থানে একটি স্কুল নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। উত্তর কাজিটুলায় বিদ্যুৎ অফিসের ভবন নির্মিত হয়েছে বিশাল দিঘি ভরাট করে। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানে বেসরকারি মালিকানায় থাকা দিঘিগুলোও ধীরে ধীরে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। এখনো যেসব দিঘির অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। দখলের উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে এগুলো ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। সিলেট নগরীর পাড়া-মহল্লায় থাকা দিঘিগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে নগরী। যদি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যেত হয়তো এই দিঘিগুলো দেখার জন্য পর্যটকরা ছুটে আসতেন। আজ যেভাবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে পর্যটক টানার চেষ্টা করা হচ্ছে নিশ্চয়ই তার থেকে কয়েকগুণ বেশি ফলাফল মিলতো।

ইটপাথরের এই উন্নয়ন থেকে বের হতে পারছে না খোদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। মৌলভীবাজারে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সাফারি পার্ক গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সম্ভাব্য জায়গা হিসেবে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত পাথারিয়া পাহাড়ের দক্ষিণ অংশ এবং জুড়ি উপজেলার লাটি টিলাকে বাছাই করা হয়েছে।

যে বনে রয়েছে বন্যহাতি, মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান ও উড়ন্ত কাঠবিড়ালিসহ ২০০ প্রজাতির প্রাণী। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে তৈরি করা একটি মাস্টারপ্ল্যান। ইতিমধ্যে বন বিভাগে জমা পড়েছে বলে জানা গেছে দেশ রূপান্তরের ২ জুলাইয়ের একটি সংবাদে। এই সংরক্ষিত বনে প্রায় পাঁচশ কোটি টাকার শুধু ইটপাথরের স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এই নির্মাণকেই উন্নয়ন মনে করছে বন বিভাগ। যদিও সারা বিশ্বে স্বীকৃত বনের উন্নয়ন তার সবুজ দিয়েই মাপা হয়। একটি বনকে তার মতো করে থাকতে দিলেই সে সমৃদ্ধ হয়। এই সমৃদ্ধ হওয়াটাই প্রকৃত উন্নয়ন।

এই যে উন্নয়ন মানেই ইটপাথরের স্থাপনা এই ভাবনা থেকে আমরা কবে বের হব? কবে আমরা বুঝতে পারব টেমস নদী শত ইটপাথরের স্থাপনার চেয়েও বড় উন্নয়ন। আমাদের পাশের দেশ ভারতের মেঘালয় শত শত পাহাড় ঝর্ণা সেখানে কিন্তু প্রতিটি ঝর্ণাকেই তার মতো রাখা হয়েছে এটাই আসল পরিকল্পনা। কিন্তু আমাদের এমন কিছু সামলে আসলেই প্রথমেই আসে ইটপাথরের উন্নয়নের চিন্তা। কয়টা ওয়াচ টাওয়ার বা সিঁড়ি ঝর্ণার পাশে বানানো যাবে তা নিয়ে ভাবনা শুরু হয়। উপর থেকে নিচ সবাই বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকে যদি সমালোচকদের মতে সবই নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

যত ইটপাথরের উন্নয়ন তত প্রকল্প, আর যত প্রকল্প তত টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাভ ছাড়া শেষ পর্যন্ত আর কিছুই হয় না। আমাদের উন্নয়নের ধারণা একদিন বদলে যাবে এটাই প্রত্যাশা।

একটি সুন্দর বন, একটি সুন্দর পুকুর, একটি স্বচ্ছ নদী হতে পারে উন্নয়নের মডেল এই কথাগুলো যেদিন আমাদের নীতিনির্ধারকরা বুঝবেন সেদিন হয়তো আমরা পাব আসল উন্নয়ন।

রিপন দে ।। সাংবাদিক