বন্ধ থাকা প্রায় ২৪টি বিদেশি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার শুরু হয়েছে ৫ অক্টোবর সকাল থেকে। বিজ্ঞাপন ছাড়া কিংবা ক্লিন ফিড সরবরাহ করে, এমন টিভি চ্যানেলগুলো দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সংকটটা তৈরি হলো কেন? বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বা ক্লিন ফিড সম্প্রচার নিয়ে সরকার আর কেবল অপারেটররা রীতিমত মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। 

দুই পক্ষই আইনের দোহাই দিয়েছেন। সরকার পক্ষের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তারা বলেছে, সরকার নতুন কিছু করছে না। আইনের প্রয়োগ করছে মাত্র। ২০০৬ সালের আইনেই ক্লিন ফিড সম্প্রচারের বাধ্যবাধকতা ছিল। গত দুই বছর ধরে সরকার আইনের এই ধারাটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে।

গত মাসে সব পক্ষের সাথে কথা বলেই ১ অক্টোবর থেকে ক্লিন ফিড সম্প্রচার বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু তাদের হাতে ক্লিন ফিড নেই, এই অজুহাতে ক্যাবল অপারেটররা ১ অক্টোবর থেকে সব ধরনের বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রেখেছিল। ক্যাবল অপারেটররাও আইনের কথাই বলছে। তাদের দাবি, তারা সরকারের আইন মেনেই বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রেখেছিল। কারণ তাদের হাতে কোনো চ্যানেলের ক্লিন ফিড নেই। কিন্তু কেন তারা গত ১৫ বছরে, বিশেষ করে গত দুই বছরে ক্লিন ফিডের ব্যবস্থা করেনি, তার কোনো পরিষ্কার জবাব নেই।

সরকারের আইন মেনে তারা বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ রেখেছে। কিন্তু সেই আইন প্রতিপালনে তাদের কোনো চেষ্টা বা উদ্যোগ কখনোই দেখা যায়নি। এখন ক্যাবল অপারেটররা ঢালাও সব বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রেখে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।

সরকার কোনো টিভি চ্যানেল বন্ধ করেনি। তারা শুধু ক্লিন ফিড সম্প্রচারের ১৫ বছরের পুরনো আইনটি কার্যকরের চেষ্টা করছে, তাও পর্যাপ্ত সময় দিয়ে।

এটা যে চাপ সৃষ্টির কৌশল তা স্পষ্ট; কারণ অন্তত ২৪টি চ্যানেল আছে, যা বিজ্ঞাপন ছাড়াই চলে। কিন্তু আইন মানার দোহাই দিয়ে ক্যাবল অপারেটররা সেই চ্যানেলগুলোও বন্ধ রেখেছিল। তবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ স্পষ্ট করেই বলেছেন, কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করবে না সরকার। ক্লিন ফিড আছে, এসব চ্যানেলও যারা সম্প্রচার করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রয়োজনে আইন অমান্যকারীদের লাইসেন্স বাতিলের কথাও বলেছেন তিনি।

এখন প্রশ্ন হলো, ক্লিন ফিডটা সরবরাহ করবেন কারা? আমরা চোখের সামনে ক্যাবল অপারেটরদের পাচ্ছি বলে, সবাই মিলে তাদেরই সব দায় দিচ্ছি। এখানে পক্ষ কিন্তু তিনটা। ক্যাবল অপারেটররা সর্বশেষ ধাপ। প্রথম ধাপ অবশ্যই ব্রডকাস্টার মানে বিদেশি টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ।

কোনো বিদেশি চ্যানেল যদি বাংলাদেশের বিশাল বাজার ও দর্শকদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং তাদের কাছে পৌঁছাতে চায়, তাহলে অবশ্যই তারা তাদের চ্যানেলের ক্লিন ফিড সরবরাহ করবে। এরপর আছে বিদেশি চ্যানেলের দেশি ডিস্ট্রিবিউটর। তারা যদি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চায়, অবশ্যই তারা ক্লিন ফিড সরবরাহ করবে। তারপর আসে কেবল অপারেটররা। তারা যদি তাদের গ্রাহক ধরে রাখতে চায়, তাহলে অবশ্যই ক্লিন ফিড তৈরির চেষ্টা করবে। হতে পারে কেবল অপারেটররা ডিস্ট্রিবিউটরদের উপর চাপ দিল, ডিস্ট্রিবিউটররা ব্রডকাস্টারের ওপর চাপ দিল। যার প্রয়োজন বেশি, উদ্যোগটা তাকেই নিতে হবে। অথবা তিন পক্ষ মিলেও একটা উপায় বের করতে পারে।

এতদিন প্রায় বিনা পয়সায় বাংলাদেশের মতো বিশাল বাজার দখল করে ব্যবসা করছিল তারা। এখন ব্যবসা করতে হলে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে। যারা ক্লিন ফিড নিশ্চিত করতে পারবে, তারাই শুধু বাংলাদেশে সম্প্রচার করতে পারবে। এখানে সরকারের কিছু করার নেই। সরকার শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করবে। যারা আইন মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

এখন সাধারণ মানুষ তো এতকিছু বুঝবে না। দেশি হোক আর বিদেশি, তারা তাদের পছন্দের চ্যানেল দেখতে চাইবে। এটা ঠিক বাংলাদেশের সব শ্রেণির দর্শকরাই বিদেশি টিভি চ্যানেল দেখেন। শিশুদের কাছে জনপ্রিয়, কার্টুন বা প্রকৃতি বিষয়ক চ্যানেল। গৃহিণীরা ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল দেখেন নিয়মিত। তাছাড়া বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা, এনডিটিভিসহ বিভিন্ন দেশের নিউজ চ্যানেলেরও প্রচুর দর্শক আছে বাংলাদেশে। সবচেয়ে বেশি আছে বিভিন্ন স্পোর্টস চ্যানেলের দর্শক।

বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করতে হলে কন্টেন্ট ভালো করতে হবে। উন্মুক্ত আকাশের এই সময়ে মানুষ দেশি না বিদেশি চ্যানেল সেটা বিবেচনা করবে না। তারা ভালো কন্টেন্ট দেখতে চাই।

গত ১ অক্টোবর থেকে এইসব দর্শক তাদের পছন্দের চ্যানেল দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই বঞ্চনার ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করতে চেয়েছিল ক্যাবল অপারেটররা। একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, সরকারের বাধার কারণেই তারা বিদেশি চ্যানেল দেখাতে পারছিল না। তবে এখানে আমি সরকারের করার কিছু দেখি না।

প্রথম কথা হলো, সরকার কোনো টিভি চ্যানেল বন্ধ করেনি। তারা শুধু ক্লিন ফিড সম্প্রচারের ১৫ বছরের পুরনো আইনটি কার্যকরের চেষ্টা করছে, তাও পর্যাপ্ত সময় দিয়ে। এখন কার্যকরের সময়ে এসে আরও সময় চাওয়া বা ঢালাও ভাবে চ্যানেল বন্ধ রেখে সরকারের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করা কোনো কাজের কথা নয়। যত পক্ষই থাকুক, একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমি শুধু কেবল অপারেটরদেরই দেখব। কারণ আমি টাকার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে সেবা কিনি। যথাযথ সেবা না পেলে আমি কিন্তু যথাযথ টাকা তাকে দেব না। শুধু বাংলাদেশের ৩৪টা চ্যানেলের জন্য তো আমি মাসে ৫০০ টাকা দেব না। আমি অত কিছু বুঝি না, আমি আমার পছন্দের সব চ্যানেল দেখতে চাই।

আলোচনা শুনে মনে হতে পারে, ক্লিন ফিড বুঝি নতুন কিছু বা জটিল কিছু। কিন্তু ক্লিন ফিড আসলে এক বৈশ্বিক বাস্তবতা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বিদেশি চ্যানেলের ক্লিন ফিড সম্প্রচারিত হয়। এমনকি সক্ষমতায় বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে থাকা নেপালও ক্লিন ফিড সম্প্রচার করে। বাংলাদেশ বরং অনেক দেরিতে ক্লিন ফিড সম্প্রচারে গেছে। যেকোনো মূল্যে এটা এখন ধরে রাখতে হবে।

এটা ঠিক ক্লিন ফিড নিশ্চিত করতে পারলে, বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনেক লাভ হবে। দর্শক বাড়বে, বিজ্ঞাপনও বাড়বে। কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে, বাধ্য করে দর্শকদের বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলো দেখানো যাবে না। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করতে হলে কন্টেন্ট ভালো করতে হবে।

বাংলাদেশের মানুষ টিভি দেখে। তারা ভারতীয় নাটক দেখে। বাংলাদেশে যদি সেই মানের নাটক বানানো হয়, তাহলে অবশ্যই তারা বাংলাদেশের নাটক দেখবে। নিউজ চ্যানেলগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে।

উন্মুক্ত আকাশের এই সময়ে মানুষ দেশি না বিদেশি চ্যানেল সেটা বিবেচনা করবে না। তারা ভালো কন্টেন্ট দেখতে চাই। তাই বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোকে এখন মনোযোগ দিতে হবে, উন্নতমানের অনুষ্ঠান বানানোর দিকে। ধরে নিচ্ছি, বিদেশি চ্যানেলের ক্লিন ফিড সম্প্রচার বাধ্যতামূলক হলে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর আয় বাড়বে।

অনেকগুলো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে, যাদের কমন পণ্য বাংলাদেশ ও ভারতে বাজারজাত হয়। ভারতের টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিলে তাদের বাংলাদেশের বাজারও কাভার হয়ে যায়। আলাদা করে বিজ্ঞাপন না দিলেও চলে। ক্লিন ফিড নিশ্চিত হলে সেই কোম্পানিকে বাংলাদেশের বাজার ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের টিভিতেও বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তবে বাংলাদেশের টিভিগুলোকে সম্ভাব্য সে বাড়তি আয়ের একটা অংশ বিনিয়োগ করতে হবে ভালো অনুষ্ঠান বানানোর জন্য।

বাংলাদেশের মানুষ টিভি দেখে। তারা ভারতীয় নাটক দেখে। বাংলাদেশে যদি সেই মানের নাটক বানানো হয়, তাহলে অবশ্যই তারা বাংলাদেশের নাটক দেখবে। নিউজ চ্যানেলগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে। অনেকগুলো বিটিভি হলে, দর্শক দেখবে কেন?

ক্লিন ফিড সম্প্রচার নিশ্চিত হলে অনেকভাবেই বাংলাদেশ লাভবান হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ক্লিন ফিড নিশ্চিত হলে বাংলাদেশের টেলিভিশন শিল্পে ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ বাড়বে। আর টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর দাবি, ক্লিন ফিড নিশ্চিত হলে ১২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন পাচার বন্ধ হবে। তবে এটা অফিসিয়াল হিসাব। অনানুষ্ঠিকভাবে আরও অনেক অর্থ পাচার হয়। সেটাও বন্ধ করতে হবে। আর ক্লিন ফিড নিশ্চিত হলে শুধু স্যাটেলাইট চ্যানেল নয়; শক্ত ভিত্তি পাবে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্প; নাটক, গানসহ নানা অনুষ্ঠান। তবে প্রশ্নটা শুধু টাকার নয়; ক্লিন ফিড নিশ্চিত করার সাথে আমাদের আত্মমর্যাদা, সম্মান, দেশপ্রেমেরও গভীর সম্পর্ক আছে।

এমনিতে ভারতে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল সম্প্রচারিত হয় না। অনেক চেষ্টায় বিটিভি দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে। তারা নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল এমনভাবে দিয়ে রেখেছে, যাতে বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি চ্যানেলের পক্ষেই সেখানে সম্প্রচারে যাওয়া সম্ভব নয়। বিপরীতে আমাদের আকাশ, আমাদের বাজার এতদিন সবার জন্য ছিল উন্মুক্ত।

ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো দেদারসে চলছিল এখানে। তাতে শুধু আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোই ঝুঁকিতে পড়েছে তা নয়, ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সর্বগ্রাসী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। তাই সরকারের নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বাংলাদেশে চ্যানেল দেখাতে হলে, বাংলাদেশের আইন মেনেই দেখাতে হবে। 

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com