বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি এখন অনেক উন্নতির দিকে। করোনায় বিধ্বস্ত বিশ্ব আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতিও স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সবকিছুই এখন আগের মতো স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যেই প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকা স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। যেখানে আবার আগের মতো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে যথাক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। এমতাবস্থায় সামনের দিনগুলোতে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ মতামত দিয়েছেন। কারণ করোনা সংক্রমণ কমে গেলেও তা নির্মূল করা যায়নি। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ আবারও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সংক্রমণ প্রতিরোধে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট, অফিস-আদালতসহ সব জায়গায় আগের মতোই মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানে কারও সংক্রমণ শনাক্ত হলে তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও করোনা পরীক্ষা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। জনসমাগম ও ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে।

প্রায় ১৯ শতাংশ মানুষ পেয়েছে ১ম ডোজ এবং ১০ শতাংশ মানুষ পেয়েছে ২য় ডোজ টিকা যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় অনেক কম। ভারতে ১ম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫৫ শতাংশ মানুষকে এবং টিকা সম্পন্ন করেছে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ।

দেশের আশি শতাংশ মানুষকে করোনা টিকার আওতায় আনার যে পরিকল্পনা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুত কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বছরের শুরুতে যে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হয়েছিল তা এখন একটি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। যদিও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে টিকাদানের এই কর্মসূচি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি, তবে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, প্রাপ্যতা সাপেক্ষে স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে গণটিকা প্রদানের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।

দেশজুড়ে গণটিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের এই সক্ষমতা অর্জনের জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স, গ্যাভি (Gavi, The Vaccine Alliance) কর্তৃক প্রদত্ত ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে গ্যাভি প্রতিষ্ঠার পর ২য় ব্যক্তি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পুরস্কার লাভ করেন। এর আগে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান আদর পুনেওয়ালা (Adar Poonawalla) এই পুরষ্কার লাভ করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে দেশব্যাপী ৭৫ লক্ষ ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নিয়মিত ৫ লক্ষ ডোজ টিকার সঙ্গে এই ৭৫ লক্ষসহ মোট ৮০ লক্ষ ডোজ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর সারাদেশে প্রায় ৮১ লক্ষ ডোজ করোনা টিকা দেওয়া হয়েছে যা অত্যন্ত ইতিবাচক। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি ৮১ লক্ষ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১ম ডোজ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ১৫ লক্ষ এবং ২য় ডোজ দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৬৭ লক্ষ মানুষকে। সেই হিসাবে, প্রায় ১৯ শতাংশ মানুষ পেয়েছে ১ম ডোজ এবং ১০ শতাংশ মানুষ পেয়েছে ২য় ডোজ টিকা যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় অনেক কম। ভারতে ১ম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫৫ শতাংশ মানুষকে এবং টিকা সম্পন্ন করেছে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ।

যেভাবে টিকা আসছে তাতে আমাদের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে আরও বেশ সময় লাগতে পারে। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য দেশে টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তা অর্জন করতে হলে আরও প্রায় ১১ কোটি মানুষকে ২ ডোজ টিকার আওতায় আনতে হবে। বিপুল পরিমাণ এই টিকার সংস্থান করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা আগে একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি।

সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যেভাবে টিকা আসছে তাতে আমাদের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে আরও বেশ সময় লাগতে পারে। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য দেশে টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

এ ব্যাপারে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে চীনের সিনোফার্ম এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ত্রিপক্ষীয় এই সমঝোতা অনুযায়ী সংলাপে সরকার চীনের সিনোফার্মের ‘বাল্ক’ টিকা সংগ্রহ করে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সহায়তায় বোতলজাত করে তা সরবরাহ করবে।

দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি তথা সম্ভাব্য পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে দেশে পর্যাপ্ত টিকা মজুদ নিশ্চিত করতে হবে এবং জনগণকে দ্রুত এই টিকার আওতায় আনতে হবে।

টিকার জন্য বহির্বিশ্বের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে দেশেই টিকা উৎপাদনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব সিনোফার্মের ‘বাল্ক’ আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে যাতে করে পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়