ছোটবেলায় ট্রেন চড়া মানে ছিল জালালাবাদ এক্সপ্রেসে করে সিলেট যাওয়া। সন্ধ্যার পরপর হেলেদুলে ট্রেনটা রওনা দিত। তখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ হঠাৎ হীরে মানিকের মতো জ্বলে উঠত দূরবর্তী কোনো আলো। এর মধ্যেই সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ের মাঝামাঝি এলাকায় ট্রেন এলে আমরা হুড়মুড় করে ট্রেনের জানালা লাগিয়ে দিতাম। কারণ এ এলাকায় এলেই বৃষ্টির মতো পাথর পড়া শুরু হতো।

তখন একটা কথা চালু ছিল, এ এলাকায় রাত হলে পাহাড় থেকে জিন-ভূত নেমে আসে। তারাই পাথর ছোড়ে। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সেটা কল্পনা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রহস্যের জন্ম অদেখার মধ্যে।

৩৫/৪০ বছর পর সেসব জনপদ নিশুতি রাতে আলো ঝলমল হয়ে থাকে। দিনের বেলায় তো কথাই নেই। কিন্তু পাথর ছোড়া কমেনি। বরং যে পাথর রাতের বেলায় ছোড়া হতো, এখন তা প্রকাশ্য দিবালোকে হচ্ছে। এখন বোঝা গেল, এ জিন-ভূতের কাজ নয়। রেল লাইনের দু’পাশের লোকজনই ট্রেনে ঢিল ছুড়ে।
ট্রেনের উপর মানুষের এত ক্ষোভ কেন? রেলওয়ে তাদের কী এমন ক্ষতি করেছে! একটা কিছু হলেই মানুষ ট্রেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রেললাইন উপড়ে নেয়। অথচ এ রেলেই লোকজন সস্তা কিংবা বিনা টিকেটে চড়ে। রেল যোগাযোগকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা।

ট্রেনের উপর মানুষের এত ক্ষোভ কেন? রেলওয়ে তাদের কী এমন ক্ষতি করেছে! একটা কিছু হলেই মানুষ ট্রেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রেললাইন উপড়ে নেয়...

প্রত্যেকটি রেল স্টেশনের আশেপাশে একটা করে বাজার দেখা যায়। অনেক বড় বড় শহর বিকশিত হয়েছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে। মজার ব্যাপার হলো, যেসব এলাকার মানুষ বেশি রেলওয়ের সুবিধা নেয়, তারাই রেলওয়ের ক্ষতি করে বেশি। তারা যেমন সহিংস কর্মকাণ্ড চালায়, তেমনি তাদের মধ্যে বিনা টিকেটে ট্রেনে চড়ার প্রবণতাও বেশি।  

এতদিন ট্রেনে ঢিল ছোড়া ছিল একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা। কিন্তু এখন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৩ অক্টোবর রেলমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত, মোট ৯ মাসে চলন্ত ট্রেনে ১১০টি ঢিল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৯ জন ট্রেন যাত্রী আহত হয়েছেন। ট্রেনের জানালার গ্লাস ভেঙেছে ১০৩টি। এসব ঘটনার বেশিরভাগ রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলে ঘটেছে।’

লক্ষ্য করুন, এই ৯ মাসের বড় একটা বড় সময় ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল লকডাউনের জন্য। রেলমন্ত্রীর মতে, ঢিল ছোড়ার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো হচ্ছে, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ জেলার স্বল্পকিছু রেলওয়ে স্টেশন, বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম রেলওয়ে স্টেশন, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশন, সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী রেলওয়ে স্টেশন, নাটোরের আব্দুলপুর রেলওয়ে স্টেশন, গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন, পঞ্চগড়ের কিসমত, ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া, বগুড়ার ভেলুরপাড়া রেলওয়ে স্টেশন, পাবনার মুলাডুলি রেলওয়ে স্টেশন, পাবনার ভাঙ্গুরা রেলওয়ে স্টেশন, পাবনার বড়ালব্রিজ রেলওয়ে স্টেশন, জামতৈল রেলওয়ে স্টেশন, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর রেলওয়ে স্টেশন, খুলনার ফুলতলা রেলওয়ে স্টেশন এবং চুয়াডাঙ্গা আউটার এলাকা।

এছাড়াও রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো, ফেনীর ফাজিলপুর-কালীদহ, নরসিংদী, জিনারদী ও ঘোড়াশাল, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-বাড়ককুণ্ড ও পাহাড়তলী এলাকা।

এমন নয়, রেলওয়ের সেবায় অসন্তুষ্ট হয়ে লোকজন এসব করছে। বরং এসময় রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে। গত দশ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে রেলওয়ে খাতে। ২০০৭-১০ সাল পর্যন্ত তিন বছরে রেল খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা। এরপর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) খাতটিতে বিনিয়োগ ছিল ৪৩ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) তা হয় ৬৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা।

নতুন নতুন ইঞ্জিন এসেছে। অনেকগুলো রেললাইন ডাবল হয়েছে। অত্যাধুনিক সুবিধার কোচ এসেছে। গতি ও আরাম দুটোই বেড়েছে ট্রেনে। এমন বাস্তবতায় রেলকে নিয়ে মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠার কথা। যত্নশীল হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে উল্টো।

নিকট-ভবিষ্যতে আমরা কক্সবাজার-ঢাকা রুটে টুরিস্ট ট্রেন চালু করব। এমন একটা অবস্থায় ট্রেনের জানালায় গ্রিল লাগানোর সিদ্ধান্ত হবে দুর্বৃত্তদের কাছে আমাদের নৈতিক পরাজয়।

মানুষের মধ্যে এ ‘ধর্ষকাম’ মনোভাব সৃষ্টি হলো কেন তা নিয়ে সামাজিক গবেষণা প্রয়োজন। এই ঢিল ছোড়া কী শুধুই মজার ছলে করা হয়? মাঝে মাঝে প্রশ্নটা আমার মনে জাগে। প্রায় রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী ঢিল ছোড়ার অপরাধে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের দেখলে কিন্তু এটা নিছক ‘মজার ছলে’ করা বলে মনে হয় না। বেশিরভাগ গ্রেপ্তারকৃতের বয়স বিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে তাতে এই বয়সী কারো ঢিল ছোড়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে মজা নেওয়ার অবকাশ থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস হয় না। এসব শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে হলে মেনে নেওয়া যায়।

আরেকটা বিষয় হলো, রেলওয়েতে নতুন ইঞ্জিন ও কোচ এলেই ঢিল ছোড়া বেড়ে যায়। ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে নিকট অতীতে আসা কোচগুলোর অবস্থা বছর দুয়েকের মধ্যেই বেহাল হয়ে গেছে। বিপুল বিনিয়োগ করে সেসব ত্বরিত মেরামত করতে হচ্ছে। এতে কার বা কাদের লাভ হচ্ছে—একবার খতিয়ে দেখা দরকার। কাদের সঙ্গে রেলওয়ের পুঁজির দ্বন্দ্ব সেটাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, ট্রেনের জানালায় লোহার গ্রিল লাগানো হবে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত, ইউরোপকে অনুসরণ করছে। ভারত ‘ভিস্তা ডোম’ নামের টুরিস্ট রেল কোচ চালু করেছে। যে কোচের একটা বড়ো অংশ কাঁচের। যেখানে সামাজিক সকল সূচকে আমরা ভারত থেকে এগিয়ে, সেখানে আমরা নিরাপত্তার অভাবে ট্রেনকে বানাচ্ছি লোহার খাঁচা, বিষয়টা বড়ই লজ্জাকর।

মাথা ব্যথার চিকিৎসায় মাথা কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু এর পরিণতি আমাদের অজ্ঞাত। রেল দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রী উদ্ধারের প্রধান স্থান হয় জানালা। সেই জানালায় গ্রিল বসালে দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজ দুরূহ হয়ে উঠবে।

নিকট-ভবিষ্যতে আমরা কক্সবাজার-ঢাকা রুটে টুরিস্ট ট্রেন চালু করব। এমন একটা অবস্থায় ট্রেনের জানালায় গ্রিল লাগানোর সিদ্ধান্ত হবে দুর্বৃত্তদের কাছে আমাদের নৈতিক পরাজয়।

রেলওয়ের দুই আড়াই হাজার পুলিশ দিয়ে এই বিশাল নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব নয়। যে বিশটি স্পটে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে, সেসব স্পটের জেলা পুলিশ ও প্রশাসনকে এর দায়ভার নিতে হবে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে এর পেছনের রহস্য উদঘাটনে নিয়োগ করা যেতে পারে। কোনোভাবেই দুর্বৃত্তদের কাছে হার মানা যাবে না। 

জয়দীপ দে ।। কথাসাহিত্যিক