বিগত দেড় বছর ধরে চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে বারবার লকডাউনে মানুষের একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অধিকাংশ মানুষের জীবনেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে।

করোনাকালে আমাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। পিপিআরসি ও ব্র্যাক-বিআইজিডি জরিপের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির সময় ২ কোটি ৪৫ লাখ লোক দরিদ্র হয়েছে। কমেছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। এমন পরিস্থিতিতে দফায় দফায় ফুঁসে উঠছে নিত্যপণ্যের বাজার। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের দুমুঠো অন্ন জোগাড় করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের বাজারে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে, নানা ছলচাতুরী করে মানুষের পকেট কাটছেন এবং অন্যায়ভাবে মুনাফা লুটছেন।

টিসিবির ২০২০ সালের ১ মার্চ ও ৭ অক্টোবর পর্যন্ত বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোটা চালের গড় দাম বেড়েছে সাড়ে ৩১ শতাংশ, খোলা আটার ২০, খোলা ময়দার ৩৩, এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল ৪৩, চিনির ১৯, মোটা দানার মসুর ডাল ৩০ ও গুঁড়া দুধের ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভোজ্যতেলের পাঁচ লিটারের দাম ছিল ৫০৫ টাকা। সর্বশেষ আরেক দফা দাম বেড়ে হয়েছে ৭৬০ টাকা। ফলে পরিবারে মাসে ২৫০ টাকার মতো শুধু ভোজ্যতেল কিনতেই বাড়তি লাগছে। পেঁয়াজের দাম মোটামুটি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আগে দেশি পেঁয়াজ ৪০ টাকা কেজিতে কেনা যেত, তা কিনতে এখন ৮০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১২০-১৪০ টাকা থেকে ১৮০ টাকায় ছুঁয়েছে। আবার বেশিরভাগ সবজির কেজির দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

সাধারণত নিত্যপণ্যে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথাবার্তা উঠলে পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করে থাকেন।

শুধু যে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, তা নয়। বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের দাম। যেমন মাস তিনেক আগে বাজারে ১০০ গ্রাম ওজনের সাবানের দাম ছিল ৩৫ টাকা। সেটা এখন ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, শৌচাগারে ব্যবহার করা টিস্যুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম।

এক প্যাকেট টিস্যুর দাম ছিল ১৭ টাকা, যা এখন ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ফলে টিস্যুর পেছনে একটি পরিবারের মাসিক ব্যয় ১৮ শতাংশ বেড়ে গেছে।

ব্যবসায়ীরা নিত্যভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিকে অজুহাত দেখান। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, গম, চিনি, ডাল, গুঁড়া দুধ ও শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়তি।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষায় শুল্ক ছাড়কে বিকল্প উপায় হিসেবে ভাবা হচ্ছে। ভোজ্যতেল আমদানিতে তিন স্তরে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) রয়েছে। চিনিতে আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অগ্রিম কর (এটি) ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, এখন এক কেজি চিনিতে মোট কর দাঁড়ায় ২৮ টাকার মতো। আর প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে কর দাঁড়ায় ২০ টাকার বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ, তেল ও চিনির উপর শুল্ক-কর কমাতে এনবিআরকে অনুরোধ করেন। আর সে অনুযায়ী এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করেন। অবশ্য পেঁয়াজে ৫ শতাংশ শুল্ক তুলে নিলে দামে খুব ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। একই সাথে শুল্ক ছাড়ের সুবিধাটুকু যেন ভোক্তা পর্যায়ে পড়ে তার জন্য মাঠপর্যায় ও কেন্দ্রীয় ভাবে যথাযথ নজরদারি প্রয়োজন। কারণ ইতিপূর্বে চালসহ বেশ কয়েকটি পণ্যে শুল্ক হ্রাস করা হলেও ভোক্তা পর্যায়ে তার সুফল আসেনি।

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের হাতে। করোনাকালেও পুরো বছর জুড়ে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তৈরি করছে। খারাপ সময়ও নাকি কারও জন্য সুযোগ নিয়ে আসে। এ সুযোগে মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন।

অসাধু ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম দেশাত্মবোধ ও মানবিকতা বলতে কিছুই নেই, বিষয়টি পরিষ্কার। মানুষকে জিম্মি করে পকেট কাটা ও অর্থ আহরণই তাদের একমাত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ।

সাধারণত নিত্যপণ্যে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথাবার্তা উঠলে পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করে থাকেন। প্রশাসন মাঝে মধ্যে লোক দেখানো দু’একটি অভিযান পরিচালনা করেই ক্ষান্ত এবং সরকারকে অবহিত করছেন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলমান রয়েছে। প্রকৃত অর্থে এই ধারাবাহিকতাবিহীন, খণ্ডকালীন অভিযান বাজারে প্রভাব ফেলার পরিবর্তে বাজারকে আরও উসকে দেয়।

মানুষের জনদুর্ভোগ লাঘবে কার্যকরী ও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত, সমন্বিত বাজার তদারকি কার্যক্রম একটি উদ্ভাবনী মডেল চলমান ছিল।

যেখানে জেলা-উপজেলা প্রশাসন সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। কিন্তু বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার মতো অতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রশাসনের অগ্রাধিকার না থাকায় তারা সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর উদ্যোগ নিতে আগ্রহী নন। ফলে সরকারের অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগের সফল তৃণমূল মানুষ উপভোগ করতে পারছে না।

ইতিপূর্বে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে বাণিজ্য, খাদ্যসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসন ঐ খাতের, উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা এবং প্রশাসনের লোকজনকে নিয়ে করণীয় পরামর্শ সভা করে বিকল্প উৎস থেকে আমদানি করা, বাজার তদারকি জোরদার, মজুতদারি ঠেকানো, বিকল্প বাজার হিসেবে খাদ্য ও টিসিবির ট্রাক সেল চালুর উদ্যোগ নিতেন।

অসাধু ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম দেশাত্মবোধ ও মানবিকতা বলতে কিছুই নেই, বিষয়টি পরিষ্কার। মানুষকে জিম্মি করে পকেট কাটা ও অর্থ আহরণই তাদের একমাত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ। ধর্মীয় নীতিবাক্য ও উপদেশ তাদের এই চরিত্র বদল হওয়ার নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিত্যপণ্যের বাজারে চলমান অস্থিরতা দূর করতে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাজারে ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন পুরো নিত্যপণ্যের বাজার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। একই সাথে বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত নজরদারি বাড়াতে হবে।

বাণিজ্য, খাদ্যসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর নীতিনির্ধারণে ভোক্তাদের সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির পাশাপাশি তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করার জন্য এ সমস্ত অসাধু ব্যবসায়ীদের অপকর্ম গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করতে হবে।

এস এম নাজের হোসাইন।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)