প্রাচীনকালে চীন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়েছিল। এগিয়ে থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা বলে কথা! এদেশে প্রথম কাগজ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল; বারুদের জন্মও এদেশেই। ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ (টিসিএম) তো এখন কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদেশের বিজ্ঞানীদের হাত থেকেই বিশ্ব পেয়েছে শঙ্কর ধান, যা ক্ষুধা মিটিয়ে চলেছে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের। চীনা বিজ্ঞানীরা এখন যেমন সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরে ডুব দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ছেন, তেমনি একক দেশ হিসেবে চীনকে মহাকাশ স্টেশনের মালিক বানিয়ে দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এই যে চীন মাত্র চার দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, তার কৃতিত্বও অনেকাংশেই বর্তায় দেশটির বিজ্ঞানীদের ওপর। বিজ্ঞান খাতে নব নব উদ্ভাবন চীনকে বলতে গেলে সবদিক দিয়েই বিশ্বে শক্তিশালী দেশ হিসেবে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে ও করছে। কিন্তু এতে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে নারাজ দেশটির সরকার ও জনগণ।

অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করছেন এখন চীনা বিজ্ঞানী বা গবেষকরা। সাধারণভাবে, বিশ্বে একটা নির্দিষ্ট সময়কালে যেসব বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, সেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক উদ্ধৃত প্রথম দশ শতাংশ গবেষণাপত্রকে এই ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। এতকাল এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি শীর্ষস্থানটি এসেছে চীনের দখলে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চীনা গবেষকরা প্রতিবছর গড়ে উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন ৪০,২১৯টি। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয় (৩৭,১২৪টি) ও যুক্তরাজ্যের অবস্থান তৃতীয় (৮,৬৮৭টি)।

উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের দিক দিয়ে চীনের শীর্ষস্থান দখলের খবরটি সম্প্রতি দিয়েছে জাপানের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি। এটি আবার জাপানের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। প্রতিটি প্রতিবেদনে তিন বছরের চিত্র তুলে ধরা হয়। আর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় তিন বছর সময়কাল শেষ হওয়ার ঠিক দুই বছর পর।

২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চীনা গবেষকরা প্রতিবছর গড়ে উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন ৪০,২১৯টি।

জাপানি প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান, রসায়ন, প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিত সংশ্লিষ্ট চীনা গবেষণাপত্রগুলো বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত হয়েছে। অথচ বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকেও এক্ষেত্রে বিশ্বে চীনের অবস্থান ছিল দশ নম্বরে। শতাব্দীর শেষ দিকে এসে চীনের অবস্থান দাঁড়ায় দুই নম্বরে, যুক্তরাষ্ট্রের পরের স্থানটিতে। এরপর প্রায় দুই দশক ধরেই দ্বিতীয় স্থানটি ধরে রেখেছিল চীন। এবার উঠে এসেছে এক নম্বরে।

কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে? জাপানি প্রতিবেদন বলছে, দুটি ফ্যাক্টরের কথা—

এক, চীনে আছে তরুণ মেধাবী গবেষকদের একটি বড় জনগোষ্ঠী বা ট্যালেন্ট পুল;

দুই, গবেষণা খাতে বিশাল বাজেট। ২০১৯ সালে চীনে ছিল ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ফুল-টাইম গবেষক ও উন্নয়নকর্মী। সেবছর চীনে গবেষণা খাতে ব্যয় করা হয় ২.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (৩৪,০০০ কোটি মার্কিন ডলার)।

২০১৯ সালে চীনে রেকর্ডসংখ্যক গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন, যাদের মোট সংখ্যা ছিল ৬১ হাজার। এক্ষেত্রে অবশ্য চীনের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়; ৯০ হাজার পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে সেবছর মার্কিন গবেষকরাই ছিলেন প্রথমে।

‘ওয়েব অব সায়েন্স’ নামক ডেটাবেজ বিশ্বের শীর্ষ এক শতাংশ সর্বোচ্চ উদ্ধৃত গবেষণাপত্রের হিসাব দিয়ে থাকে। এই ডেটাবেজ অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতিবছর এমন সর্বোচ্চ উদ্ধৃত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ৪,৪১৩টি। এক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাজ্যের অবস্থান যথাক্রমে দ্বিতীয় (৪,০৪৬টি) ও তৃতীয় (৯৭০টি)। বলা চলে, এই হিসাব অনুসারেও চীন যুক্তরাষ্ট্রের সমানে সমান। অথচ, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনা গবেষকরা এমন সর্বোচ্চ উদ্ধৃত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন প্রতিবছর গড়ে মাত্র ৫৭৯টি।

বস্তুত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে চীন অনেক এগিয়েছে। তবে, এটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চায় না দেশটির সরকার ও জনগণ। এক্ষেত্রে তারা আরও এগোতে চায়। আর সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ তথা মন্ত্রিপরিষদ দেশে বিজ্ঞানশিক্ষার আরও প্রসার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৫ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ১৪০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশকে বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং এ সংখ্যা ২০৩৫ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশে (৩৫ কোটি) উন্নীত করা।

২০২০ সালের হিসাব অনুসারে, চীনের জনসংখ্যার ১০.৫৬ শতাংশ বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত। এর মধ্যে ২৪.৩০ শতাংশ সাংহাইবাসী ও ২৪.০৭ শতাংশ বেইজিংবাসীও রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, চীনের বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন বয়সী গ্রুপের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিতের সংখ্যায় অনেক ফারাক রয়েছে। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিতের হার মাত্র ৮.৪৪ শতাংশ; গ্রামীণ এলাকায় আরও কম—মাত্র ৬.৪৫ শতাংশ। আবার নারীরাও এক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছে; তাদের ৮.৮২ শতাংশ বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত। সরকার চায় দেশব্যাপী এই গ্যাপ যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনতে।

কর্মপরিকল্পনায় সমাজের পাঁচটি নির্দিষ্ট গ্রুপের বিজ্ঞানশিক্ষার মান উন্নত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই পাঁচটি গ্রুপ হচ্ছে, টিনএজার (১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী); কৃষক; শিল্প খাতের শ্রমিক; বয়স্ক নাগরিক; সরকারি কর্মী ও কর্মকর্তাবৃন্দ। পরিকল্পনা অনুসারে, টিনএজারদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা হবে এবং তাদেরকে বিজ্ঞানী হতে উৎসাহিত করা হবে। আর এজন্য একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিজ্ঞানশিক্ষার মান উন্নত করা হবে এবং বিজ্ঞানশিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞানশিক্ষা সংশ্লিষ্ট উপায়-উপকরণ আরও সহজলভ্য করা হবে এবং ক্রমবর্ধমান হারে শিক্ষকদের গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, সাধারণ প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান, রসায়ন, প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিত সংশ্লিষ্ট চীনা গবেষণাপত্রগুলো বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত হয়েছে।

কৃষকদের বিজ্ঞানশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে পরিবেশ সংরক্ষণ, শক্তি ও সম্পদের সাশ্রয়, সবুজ উৎপাদন, দুর্যোগ মোকাবিলা, জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষার ওপর। কৃষকদেরকে প্রাচীন প্রথা-রেওয়াজ ও অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতেও উৎসাহিত করা হবে। গ্রামাঞ্চলের নারীদের বিজ্ঞানশিক্ষাও পাবে বিশেষ গুরুত্ব। আর এসবের লক্ষ্য চীনের গ্রামাঞ্চলকে আধুনিক করে গড়ে তোলা।

পরিকল্পনা অনুসারে, চীনের শিল্প খাতের কর্মীদের নতুন নতুন স্কিল অর্জনে সাহায্য করা হবে; তাদের জন্য সৃষ্টি করা হবে নতুন নতুন প্রশিক্ষণের সুযোগ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের দায়িত্বের কথাও পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। তারা কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে ও কর্মীদের বিজ্ঞানশিক্ষার মান উন্নত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। বিভিন্ন পর্যায়ের সরকার এ কাজে উদ্যোক্তাদের সাহায্য করবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে দেশের অগ্রগতির ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে বলে পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ-কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।

চীনে বিজ্ঞানশিক্ষা বলতে বোঝায় এমন শিক্ষা যা মানুষকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র ও কার্যকারণ বুঝতে সাহায্য করবে এবং এ বিশেষ জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে কমবেশি সক্ষম করে তুলবে। সে অর্থে বিজ্ঞানশিক্ষা হচ্ছে দেশের জনগোষ্ঠীর সার্বিক সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই, ২০০৬ সাল থেকেই চীনে বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা শুরু হয়। তার ফলে দেশে বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিতের হার দুই অংকে পৌঁছেছে। কিন্তু চীনা সরকারের লক্ষ্য উচ্চমানের উদ্ভাবন ক্ষমতাসম্পন্ন বিশাল মেধাবী জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। অভিজ্ঞতা বলছে, চীন যখন কোনো লক্ষ্য ঠিক করে তা অর্জনের চেষ্টা চালায়, তখন দেরিতে হলেও দেশটি তা শেষ পর্যন্ত অর্জন করে ছাড়ে। বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারে চীনের ১৫ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্যও অর্জিত হবে—এমনটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)