আমার প্রথম কর্মস্থল সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড)। ফিলিপ গাইনের (যাকে আমরা ‘দাদা’ বলে ডাকি) গড়া প্রতিষ্ঠান। উনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের যোগসূত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। আমরা দুজনই এই বিভাগের ছাত্র। উনি অগ্রজ।

১৯৯৫ সালের একেবারে শুরুতে, মাস্টার্সের ফল প্রকাশের ৬ দিনের মাথায়, আমি সেডে জয়েন করি। ফিলিপদা’র কাছে আমাকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের দুজনেরই অন্যতম প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান। প্রথম দিনেই ফিলিপদা আমার টেবিলে এনে রাখলেন একটি টাইপ রাইটার, বললেন, ‘আগামী সাত দিন শুধু টাইপ করবা।’ দশ আঙ্গুলে টাইপ করার কৌশলও শিখিয়ে দিলেন। সেই শুরু। আজও টাইপ করে যাচ্ছি! পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, তখন টাইপ রাইটারে আঙ্গুল চালাতাম, এখন চালাই কম্পিউটারের কী-বোর্ডে।

সেডে দাদার কাছে টাইপের পাশাপাশি অনেককিছু শিখেছি। সেখানে কয়েকজন মেধাবী সহকর্মীও পেয়েছিলাম। তাদেরই একজন লুসিল সরকার। গত মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) তিনি ফেসবুকে আমাকে ইনবক্স করে লিখলেন, ‘আলিমুল ভাই, সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের বিষয়ে মানুষের অনীহা হওয়ার কি কোনো কারণ আছে? দেখা যায়, মানুষ কিছুটা কনসার্নড। আপনার কোনো লেখা আছে এ বিষয়ে বা কমেন্ট?’ আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম, ‘চীনের টিকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমরাও চীনা টিকা নিয়েছি।’ আমার সাবেক সহকর্মী ছোট করে বললেন, ‘আচ্ছা’। পরে মনে হলো, বিষয়টা নিয়ে লেখা দরকার।

চীনারাও চীনের তৈরি টিকাই নিচ্ছে। চলতি বছরের ৮ জুলাই পর্যন্ত চীনের জনগণ ১৩৫ কোটির বেশি ডোজ টিকা নিয়েছে।

চীনে কোভিড-১৯ ভাইরাসের অনেকগুলো টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে চারটি টিকা চীনা সরকার জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। চারটি টিকার মধ্যে দুটি দুই ডোজ করে দিতে হয়, একটি দিতে হয় তিন ডোজ করে এবং একটি এক ডোজ করে।

প্রথম দুটি হচ্ছে সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের টিকা। সবাই জানেন, এ দুটি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করেছে। বস্তুত, কোনো টিকা নিরাপদ ও কার্যকর কি না, তা বিচারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই সবচেয়ে যোগ্য সংস্থা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র অনুমোদন পাওয়ার আগেই আমরা, মানে চীনে অবস্থানরত বিদেশিরা সিনোভ্যাকের টিকা নিয়েছি ও নিচ্ছি। চীনে টিকা নেওয়া বিদেশির সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। চীনারাও চীনের তৈরি টিকাই নিচ্ছে। চলতি বছরের ৮ জুলাই পর্যন্ত চীনের জনগণ ১৩৫ কোটির বেশি ডোজ টিকা নিয়েছে।

চীনা সরকারের লক্ষ্য, চলতি বছরের মধ্যে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া। এতে দেশটি ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। নিজেদের দেশে তৈরি টিকার ওপর চীনাদের আস্থার বহিঃপ্রকাশও এটি। বলা বাহুল্য, চীনে এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়!

আসলে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকা বহুকাল ধরে পরীক্ষিত প্রযুক্তির ভিত্তিতে নির্মিত। এ টিকা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় নিষ্ক্রিয় পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস। এটি তাই মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, অথচ সক্রিয় ভাইরাস বা ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকাতে এ টিকা কার্যকর। এ ধরনের টিকা মানুষ গ্রহণ করলে তার শরীরের রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে; তৈরি করে অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডিই তাকে সত্যিকারের ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অনেকাংশে রক্ষা করে। সহজ করে বললে—টিকা গ্রহীতা ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও, আগে থেকে তৈরি অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল করে দেয়।

চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের তৈরি টিকা দুই থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করা যায়। অন্যদিকে, ফাইজার ও মডার্নার টিকা সংরক্ষণ করতে হয় শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও অনেক নিচের তাপমাত্রায়। এ জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চীনের দুটি টিকার চাহিদা বেশি। আর তাই চীন ইতোমধ্যেই বিশ্বের বৃহত্তম টিকা-সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে।

চীন ১২ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪৮ কোটি ডোজের বেশি টিকা সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে ৫০টির বেশি দেশে চীন টিকা রফতানি করেছে ও করছে এবং ১০০টির বেশি দেশে টিকা সহায়তা দিয়েছে ও দিচ্ছে। চীনের টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। চীন বাংলাদেশকে দুই দফায় ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টিকা উপহার হিসেবে দিয়েছে। পরে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে আরও দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমে সিনোফার্ম ও পরে সিনোভ্যাকের টিকাকে জরুরি ব্যবহারের জন্য এই বলে অনুমোদন দিয়েছে যে, এই দুটি টিকা কার্যকর ও নিরাপদ।

সবাই জানেন, বিশ্বের গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোও যাতে টিকা পেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে বিশ্বে ‘কোভ্যাক্স’ নামক একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যে কয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থা এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জেনেভাভিত্তিক গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (GAVI – The Global Alliance for Vaccines and Immunizations)। এই গ্যাভি গত ১২ জুলাই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি অনুসারে, এই দুই চীনা কোম্পানি ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কোভ্যাক্সকে ৫৫ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করবে। এর মধ্যে সিনোফার্ম চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে ৬ কোটি ডোজ, বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ৬ কোটি ডোজ ও আগামী বছরের প্রথমার্ধে ৫ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করবে। অন্যদিকে, সিনোভ্যাক জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ কোটি ডোজ, বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ১৫ কোটি ডোজ এবং আগামী বছরের প্রথমার্ধে ১৮ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন, চীনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাহিদাপত্র এবং সর্বশেষ গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের আস্থা প্রমাণ করে যে, চীনের কোম্পানি সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের তৈরি টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। কিন্তু তারপরও আমি এখানে দু’একটি গবেষণার ফল তুলে ধরতে চাই।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনে ৪০,৩০০ জনের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সিনোফার্মের টিকা কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ৭৮.১ শতাংশ কার্যকর। এই পরীক্ষার ফল প্রকাশের অনেক আগে থেকেই অবশ্য বিভিন্ন দেশে সিনোফার্মের টিকার ব্যবহার শুরু হয়ে যায় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ার পরই বাংলাদেশ সরকারও সিনোফার্মের টিকা সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে।

এদিকে, সম্প্রতি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে চিলিতে পরিচালিত এক গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। গবেষণার ফল অনুসারে, চীনের সিনোভ্যাকের টিকা ৯০.৩ শতাংশ ক্ষেত্রে কোভিডে আক্রান্তদের অবস্থা গুরুতর হওয়া ঠেকাতে সক্ষম। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আরও বলছে—সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা যারা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৬৫.৯ শতাংশ কোভিডে আক্রান্ত হননি; যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৮৭.৫ শতাংশকে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়নি বা তারা বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন এবং আক্রান্তদের মধ্যে ৮৬.৩ শতাংশ রোগীর মৃত্যু ঘটেনি।

আমি এখানে মাত্র দুটো গবেষণার ফল উল্লেখ করলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোর ফল মোটামুটি একই রকম। সবকটি ট্রায়ালেই চীনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকার কার্যকারিতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ন্যূনতম মানের চেয়ে অনেক বেশি বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আর এ কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমে সিনোফার্ম ও পরে সিনোভ্যাকের টিকাকে জরুরি ব্যবহারের জন্য এই বলে অনুমোদন দিয়েছে যে, এই দুটি টিকা কার্যকর ও নিরাপদ।

‘টিকার কার্যকারিতা’ বলতে মোটা দাগে কী বোঝায় সেটা অবশ্য আগে বুঝতে হবে। টিকা গ্রহণকারীদের অধিকাংশ ভাইরাসে সংক্রমিত হবেন না বা হলেও ভাইরাসকে তাদের শরীরে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি ধ্বংস করে দেবে। যারা টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্ত হবেন, তাদের অধিকাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না, তারা বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হয়ে উঠবেন; টিকা নেওয়ার পরও যাদেরকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হবে, তাদের অধিকাংশকে আবার আইসিইউতে নেওয়ার দরকার হবে না। টিকা নেওয়ার পর কোভিডে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কাও খুবই কম।

বেইজিংয়ে আমাদের আবাসিক ভবনের লিফটে বিশালাকৃতির একটি পোস্টার শোভা পাচ্ছে বিগত কয়েক মাস ধরেই। পোস্টারে টিকা সম্পর্কিত দশটি প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া আছে চীনা ভাষায় ও ইংরেজিতে। একটি প্রশ্ন এমন, ‘টিকা নেওয়ার পরও কি আমাকে মাস্ক পরতে হবে?’ উত্তর হিসেবে লেখা আছে, ‘টিকা শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে এবং ধীরে ধীরে সংক্রমণের আশঙ্কা হ্রাস করবে। তবে, কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকর নয়। টিকা গ্রহণের পরও কারো শরীরে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি সৃষ্টি নাও হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তারা ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন...। সুতরাং টিকা নেওয়ার পরও সকলের উচিত মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে চলা।’

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)