ট্রামলাইন ধরে হেঁটে যেতে যেতে এক কবি পৌঁছে গিয়েছিলেন মৃত্যুর পথে; সাতটি তারার তিমির ছুঁয়ে সেই কবি আলোকের অভিসারী। তিনি জীবনানন্দ দাশ—আধুনিকতাবাদী বাংলা কবিতার প্রভাবশালী কবি, মুহূর্তেই পাঠককে যিনি করে তোলেন কবিতাগ্রস্ত।

বহু বর্ষ জুড়ে সমালোচকেরা যাকে বলেন নির্জনতার কবি, প্রকৃতির কবি, চিত্রকল্পের কবি। সহৃদয় সংবেদনার এই কবি ছুঁয়ে, ছেনে দেখেছিলেন রূপসী বাংলার ট্রমা বা ক্ষতগুলো। শাশ্বত বঙ্গ, বৃহৎ বঙ্গ, আবহমান বাংলা বলে যে ভূখণ্ডকে আমরা ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে চিনতে চাই কল্পনার চোখ দিয়ে সেই বঙ্গকেই তিনি চিনতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ে আলোড়িত বঙ্গদেশকে স্পর্শ করেছিলেন তিনি।

এই তো সেদিন একুশ শতকের এই বাংলাদেশে পোড়ানো হলো কাশবন। সুনীল আকাশ জুড়ে ভেসে গেল কাশ পোড়ানো ছাই। মনে মনে ভাবি, রূপসীর ক্ষত দেখে হয়তো জীবনানন্দও লিখতেন একমুঠো এপিটাফ। সহজ শব্দে গাঁথতেন অসহজ কথার মালা। যেমন ‘রূপসী বাংলা’র পাণ্ডুলিপিতে এঁকেছিলেন ১৯৩২ সালের বাংলাদেশকে। যদিও আমরা এই বইয়ের কবিতাগুলোকে বরাবরই পড়ে ফেলি প্রকৃতির সরল উপস্থাপন হিসেবে। ভাবি, আর কিছু নয়, প্রকৃতির রূপভারাতুর বয়ান ছিল মৃত্যুবোধ তাড়িত কবির লক্ষ্য। প্রশ্ন জাগে, আরও গভীরতর লক্ষ্য কি তার ছিল? এমন কী ঘটেছিল—তাকে বলতে হলো, ‘বাসমতী, কাশবন, আকাঙ্ক্ষার রক্ত, অপরাধ মুছায়ে দিতেছে যেন বার বার... রাঙা রোদ, শালিধান, ঘাস, কাশ, মরালেরা বার বার রাখিতেছে ঢেকে আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু – আমাদের বিস্মিত নীরব রেখে দেয় – পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আঁচড় ঢের, অশ্রু গেছি রেখে : তবু ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব।’

আবহমান বাংলা বলে যে ভূখণ্ডকে আমরা ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে চিনতে চাই কল্পনার চোখ দিয়ে সেই বঙ্গকেই তিনি চিনতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ে আলোড়িত বঙ্গদেশকে স্পর্শ করেছিলেন তিনি।

আমার অনুমান রূপসী বাংলা এমন এক কাব্যিক প্রকল্পনা, প্রকৃতিকে হাতিয়ার করে যেটি প্রতিরোধের নন্দনতত্ত্বকে হাজির করেছে। বইটিকে বলা যায়, প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা কাব্যিক প্রতিরোধ। কিন্তু কেন? দ্রষ্টা কবির মতো তৃতীয় নয়ন দিয়ে তিনি কি দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যতের বঙ্গদেশকে? অব্যাহত ভাঙনের মুখোমুখি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দাঙ্গায় চাপা পড়া আবহমান বাংলাকে? কবির পক্ষ থেকে এ কথার জবাব আমরা পাব না, জানি। কিন্তু ইতিহাসের রক্তমাখা পাতাগুলো সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গভঙ্গের পর থেকে বেড়ে চলছিল সম্প্রদায়গত সংঘাত। ইতিহাসের কর্তাসত্তা নিয়ে ভারত জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল দুই শক্তি হিন্দু ও মুসলমান। 

তারই এক পর্বে, ১৯২৭ সালে জীবনানন্দ দাশ লিখছেন, ‘এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহকো আমার একা,/ হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,- মুসলমানের রেখা।’ ইতিহাসের এই যুগ্মধারার সত্য, সরলভাবে গৃহীত হয়নি রাজনীতির চোখ রাঙানিতে। আর তাই রাজনীতির ইতিহাস গিয়েছে বিচ্ছিন্নতার পথে। হয়তো মিলনের একটি বিন্দু খুঁজছিলেন জীবনানন্দ দাশ। প্রকৃতি যেন সেই মিলনবিন্দু।

ধর্ম ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত বাংলায় ঘাস পাখি বৃক্ষের কোনো ধর্ম পরিচয় নেই, সাম্প্রদায়িক চিহ্ন নেই। সৌন্দর্য সমেত বাংলার প্রকৃতি যেন আশ্রয়, ‘এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে।/ বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে।’ এক যুগান্তের এই গল্পের সঙ্গে ভিড়ে যায় বাংলার সাংস্কৃতিক অতীত; ফিরে আসে বেহুলা, শ্রীমন্ত, ধনপতি, লহনা, মুকুন্দরাম, চণ্ডীমঙ্গল, শঙ্খমালা, কাঁকনমালা, রাই প্রমুখ। কিন্তু বর্তমান? 

ইতিহাসের রক্তমাখা পাতাগুলো সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গভঙ্গের পর থেকে বেড়ে চলছিল সম্প্রদায়গত সংঘাত। ইতিহাসের কর্তাসত্তা নিয়ে ভারত জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল দুই শক্তি হিন্দু ও মুসলমান। 

বর্তমানের নিবিড় পর্যবেক্ষক তিনি; বনলতা সেন, ধূসর পাণ্ডুলিপি ও রূপসী বাংলার পাঠকরা অবাক হবেন এই ভেবে যে, এত তীক্ষ্ণ নিবিড়তা দিয়ে তিনি জীবনকে দেখলেন কবে! প্রকৃতপক্ষে দৈশিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে তিনি রেখেছেন আতশ কাচের নিচে। তার অধিকাংশ পাঠক এ ধারার কবিতা সম্পর্কে নীরব, নয়তো উদাসীন। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার ধারাক্রমিক ইতিহাস এই প্রমাণই হাজির করে যে, অতীতের আলোয় বর্তমানের পথ চিনে চিনে জীবনানন্দ দাশ দৃষ্টি অবনত করেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতে।

রূপসী বাংলার কিনারা থেকে শুনতে পেয়েছেন মহা পৃথিবীর আর্তনাদ, ‘কথা, কাজ, আশা, নিরাশার ভয়াবহ হৃত চক্ষু।’ বিষাদের অদ্ভুত স্বর তাই বলে গেল, ‘সময় কীটের মতো কুরে খায় আমাদের দেশ।’ তবু এক উজ্জীবন খুঁজেছিলেন তিনি; তার সঙ্গে এমন কথাও এলো, ‘নিরাশার খাতে ততোধিক লোক উৎসাহ বাঁচায়ে রেখেছে।’ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় মন্ত্রমুগ্ধ স্বরে লিখলেন, ‘আমাদের প্রভু বীক্ষণ দাও : মরি নাকি মোরা মহা পৃথিবীর তরে?’

জীবনানন্দ দাশ তত দিনে তৈরি করে ফেলেছেন জগৎ ব্যাখ্যার নিজস্ব শব্দভাণ্ডার : পৃথিবী, মানুষ, স্বপ্ন; এই মুখ্য শব্দগুচ্ছ হয়ে উঠেছে তার সমগ্র সাহিত্যে প্রবেশের প্রধান বীজমন্ত্র। যেন এরকম কিছু দার্শনিক প্রশ্ন বুকে করে হাঁটছেন তিনি, মানুষ কী? কী তার ভবিষ্যৎ? স্বপ্নের হাত ধরে কোথায় পৌঁছাবে মানুষ? অগণিত কবিতায় এ-ই যেন তার ভাব।

রাইনের মারিয়া রিলকে (Rainer Maria Rilke) যেমন খুঁজেছিলেন মানুষ ও দেবতার মধ্যবর্তী সত্তাকে, জীবনানন্দ তেমনি খুঁজছেন মানুষ ও সত্যকে; বলছেন, ‘মানুষ সত্য, তবু সত্য মানুষের চেয়েও গভীর।’ কিংবা, ‘ব্যক্তির ও মানবের সফলতা হবে?/ হয়তো এ ব্রহ্মাণ্ডের অবিনাশ অন্ধকার ছাড়া/ মানুষের ভবিষ্যতে কিছু নেই আর।’ 

মানুষ ও মানবতা সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার তর্ক প্রবণ উত্তর আছে তার কথাসাহিত্যে। অবশ্য বাঙালির পাঠাভ্যাসে তার উপন্যাস ও ছোটগল্পের আদর শোচনীয়ভাবে কম। কিন্তু বলে রাখি, আধুনিক মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্ক তৈরির দারুণ কারখানা জীবনানন্দের কথাসাহিত্য। তার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রেরা কথা বলে ও ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপের ঢঙে; যেন তারা পৌঁছাতে চায় জীবন রহস্যের গভীর মীমাংসায়। তার নায়কেরা চিন্তার দিক থেকে যতটা উত্তীর্ণ, অর্থনীতির দিক থেকে ততটাই পিছিয়ে পড়া। প্রত্যেকেই প্রবলভাবে নিঃসঙ্গ। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ; কিন্তু প্রত্যেকেই আবার জীবন-উন্মুখ। 

অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রায়শ তাদের জীবনের মোড়ে যতি টানতে চায়। কিন্তু স্তব্ধ হয় না কেউ। ‘নিরুপম যাত্রা’ উপন্যাসের প্রভাত ভাবতে পেরেছে, ‘তৃপ্তি পাই না, শান্তি পাই না, জীবনটা একটা দাঁড়কাকের বাসার মতো ছন্নছাড়া জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।’ ‘কারুবাসনা’র মতো ছোট্ট একটি উপন্যাসে জীবনানন্দ প্রগাঢ়ভাবে বুঝতে চেয়েছেন মানুষ ও শিল্পের লক্ষ্য। প্রধান চরিত্রটি ভাবছে, ‘কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সবসময়ই শিল্প সৃষ্টি করার আগ্রহ, তৃষ্ণা, পৃথিবীর সমস্ত সুখ-দুঃখ, লালসা, কলরব, আড়ম্বরের ভেতর কল্পনা ও স্বপ্ন চিন্তার দুশ্ছেদ্য অঙ্কুরের বোঝা বুকে বহন করে বেড়াবার জন্মগত পাপ। কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে।’

ধর্ম ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত বাংলায় ঘাস পাখি বৃক্ষের কোনো ধর্ম পরিচয় নেই, সাম্প্রদায়িক চিহ্ন নেই...

সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েও বলা যায়, জীবনানন্দের সাহিত্যে ‘মানুষ’ ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘পৃথিবী ও সময়’ নামের একটি প্রবন্ধে তিনি ভাবছেন ভারতীয় উপমহাদেশ ও বৈশ্বিক সংকট প্রসঙ্গে; কীভাবে ‘বিভিন্ন জাতীয়তা পৃথক সভ্যতা ও সংস্কৃতি মেনে নিয়েও এক অচ্ছিন্ন মানব সমাজের আশ্রয়ে মানুষ ও জাতি অন্তর্লীন অথচ স্বাধীন হয়ে থাকবার সুযোগ পেতে পারে।’ রাষ্ট্রনায়কদের ভাবনা বলে এইসব চিন্তা থেকে দূরে সরে থাকেননি জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক ইতিহাস সম্পর্কে বলেছেন, ‘মানব মৈত্রীর পরিবর্তে জাতি বিদ্বেষ, দেশে-দেশে সংঘর্ষ, নিরবচ্ছিন্ন রক্তান্ধকার-আধুনিক ইতিহাসের পৃষ্ঠা অশুদ্ধ ভাবনার ও বিমিশ্র বাসনার শূন্যতায় ও নিষ্ফলতায় আড়ষ্ট করে রাখছে।’ 

ঔপনিবেশিক শাসন, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক শোষণকে নিগূঢ় সমাজবিজ্ঞানীর মতোই যেন চিনেছিলেন তিনি। সেই সূত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেণি, শোষণ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে চিহ্নিত করেছেন ঘোরতর সমস্যা হিসেবে। যুদ্ধোন্মাদ পৃথিবীতে জাতিসংঘের কাজের প্রতি আস্থা ছিল না তার। সন্দেহ করেছেন, জাতিসংঘ হলো মুখ্যত ‘যুদ্ধজয়ী শ্বেত-পুরুষদের নিজেদেরই সুখ-সুবিধার ও শুভধ্যানে কাজে’ খাটা সংস্থা। সাম্প্রতিক বিশ্বে জীবনানন্দের সন্দেহ সত্য বলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবক্ষয়ের শিয়রে বসেও তার অন্তিম অন্বিষ্ট ছিল শুভবোধ, ভালো সমাজ ও ভালো রাষ্ট্র।

সভ্যতার কল্যাণকামিতায় সমবায়, সমষ্টি ও ব্যক্তি—তিন শক্তির ভূমিকা অনিবার্য বলে মেনে নিয়েছেন তিনি। প্রথাগত মানবতাবাদী চিন্তার মতো করে প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে নয় তার মানব কেন্দ্রিক ভাবনা। ‘আলোকপাত’ প্রবন্ধে বলেছেন, প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের অবদানকে ভালোবাসার কথা। কিন্তু মানব সভ্যতার নিদানকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেন এই উচ্চারণ, ‘মানুষই সত্য আলোর প্রয়োজনে / চারদিকের অন্ধ নদীর অসীম উন্মেষে।’

জীবনানন্দ দাশ স্থিতপ্রাজ্ঞ চোখে দেখেছিলেন পৃথিবীর ক্ষত। রক্তক্ষয় অমানিশা সত্ত্বেও মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি তিনি; ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমাদের এই গ্রহের জীবন-সাক্ষ্যের সবচেয়ে স্মরণীয় দৃষ্টান্ত মানুষ; কোনো বিস্ময়কর প্রমত্ততার মুহূর্তেও নিজেকে অন্য রূপ কল্পনা করা তার পক্ষে কঠিন।’ শিল্প অথবা জীবন—অবিকল্পভাবে যেকোনো একটি তার লক্ষ্য নয়। জীবনের দায় মিটিয়েই তিনি কবি, শিল্পীর দায় মিটিয়েই তিনি মুগ্ধ জীবনানন্দ।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়