চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্ব আরও বহুদিন আগেই প্রবেশ করেছে। তবে এবার নতুন করে প্রবেশ করল মেটাজগতে। আমাদের চারপাশে বাড়ছে বিমূর্ত ছায়া যোগাযোগ কিন্তু আবছা হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে সামনে বসে থাকা মানুষটির শেষ বিন্দু। আমাদের সন্তানেরা আর বিকেলে মায়েদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে যায় না। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে বাড়িতে বাবাদের বকুনি উপেক্ষা করে গায়ে কাদামাটি মেখে দামাল ছেলেদের ফুটবল খেলার সেই শৈশব হারিয়ে গেছে।

হাতে ছুঁয়ে বরফ-পানির খেলার চলও আজ আর নেই। হারিয়ে গেছে মুড়ি মাখা খেতে খেতে সাপ-লুডু খেলার খুনসুটির দিন। আজ কল্পনাও করা যায় না, তারুণ্যের যে মনকে কোনোদিন চার দেয়ালে বন্দি করে রাখা যায়নি, সেই মন কী করে বন্দি হয়েছে আজ চারকোনা এক মুঠোফোন কিংবা কম্পিউটার বা ট্যাবের পর্দায়।

বিনোদনের খেলাগুলো হারিয়ে যায়নি, শুধু খেলাগুলোর মূর্ত-বন্ধুরা হারিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। রক্ত-মাংসের মানুষেরা হেরে যাচ্ছে বিমূর্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে। যার সাথে খেলতে খেলতে জয়ী হলে আনন্দে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করা যায় না। ফাঁকিবাজি করে জিততে গিয়ে ধরা পড়ার খুনসুটি করা যায় না। মাড়ানো যায় না সবুজ ঘাসে বিকেলের সোনালি রোদ! আমরা কি এভাবে ভেবেছি কোনোদিন আমাদের শিশুদের কাছে সম্পর্কের টান, বন্ধুত্বের টানের থেকে বেশি হয়ে উঠবে প্রযুক্তির টান?

করোনা মহামারি যেন এক নিমেষে আমাদের শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়েছে। শারীরিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি নিষেধের বেড়াজালে ঘরে বন্দি শৈশবে চারকোনা অপার্থিব পৃথিবীর হাতছানি একেবারে এক নিমেষে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব নয়, তবে এখনই সময় লাগাম টানার। নতুবা করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে আমাদের শিশুদের স্বাভাবিক শৈশব হারিয়ে যাবে।

অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। করোনাকালে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশই শিশু। সেই হিসাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ৬ কোটির ওপর শিশু রয়েছে। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা প্রসারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী, যার মধ্যে শিশুরাও রয়েছে।

আমরা কি এভাবে ভেবেছি কোনোদিন আমাদের শিশুদের কাছে সম্পর্কের টান, বন্ধুত্বের টানের থেকে বেশি হয়ে উঠবে প্রযুক্তির টান?

বিটিআরসির ২০১৬ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রায় ৩.৫ শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে, যার বড় একটা অংশই যুক্ত থাকে নানা ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে। করোনা মহামারির সময়ে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিশুর শারীরিক, ভাষিক ও মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা।

ইতিমধ্যে নানা গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনাকালীন ডিজিটাল ডিভাইসে অতিমাত্রায় আসক্তির কারণে অনেক শিশুমনে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের অভ্যাসগত চাঞ্চল্য। পাশাপাশি শিশুর চোখ ও মাথা ব্যথার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঘরে বসে থাকার কারণে ওজন বেড়ে গিয়ে শারীরিক নানা ধরনের জটিলতারও সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া করোনা মহামারির সময়ে মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তির ফলে শিশুদের মাঝে মনোযোগের ঘাটতিজনিত মানসিক চঞ্চলতা বা ‘এডিএইচডি’ (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) [Attention-Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD)]-র ঝুঁকি বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, বর্তমানে ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে আক্রান্ত। বাংলাদেশের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের গবেষক দলের গবেষণায় জানা গেছে, করোনাকালীন স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুদের পাশাপাশি বিশেষ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিশুর ধৈর্য ও মনোযোগের কমতি লক্ষ করা গেছে।

অনেক সময় ধরে ফোন ব্যবহারের কারণে পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হওয়ায় শিশুর মাঝে ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বেড়ে গেছে। গবেষকগণ শিশুদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তি কমে যাচ্ছে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগকে অগ্রাহ্য করে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নেতা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আবার গত দেড় বছরের গৃহবন্দী শিশুদের অনলাইন শিক্ষা ও বিনোদনের থেকে হুট করে ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়। হঠাৎ কোনো বড় পরিবর্তন শিশু মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এক্ষেত্রে সময় নিয়ে ধৈর্য সহকারে শিশুর দৈনন্দিন কাজের তালিকাকে স্বাভাবিক সময়ের মতো করে নিয়ে আসতে হবে।

করোনা পরবর্তী আমাদের জীবন যদিও এখন আগের মতো নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিউ নরমাল বাস্তবতাকে ধীরে ধীরে শিশুর বয়স অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

প্রথমত, আপনি যদি খুব বেশি প্রযুক্তিতে আসক্ত হন, তাহলে স্বাভাবিকভাবে আপনার পরিবারের শিশুটিও সেটি করবে। তাই আগে আপনার নিজের আসক্তি দূর করুন।

একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিশুকে ডিজিটাল ডিভাইসের সামনে থাকার অভ্যাস করাতে হবে। শিশুকে ওই সময়ের বাইরে স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। শিশু যদি অনলাইনে ক্লাস করে, তাহলে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে সে কী করছে, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে একসঙ্গে শিশুর সাথে খেলুন বা ভিডিও দেখুন। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষণীয় ভিডিও শিশুর সাথে বসে দেখতে পারেন। আপনার শিশু যখন ফোনে কথা বলে, অনলাইন ক্লাস করে, ভিডিও দেখে বা গান শুনে তখন ফোনটি কানের কাছে ধরার পরিবর্তে পুরো কান ঢেকে থাকে এমন তারযুক্ত হেডফোন ব্যবহার করুন।

ইতিমধ্যে নানা গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনাকালীন ডিজিটাল ডিভাইসে অতিমাত্রায় আসক্তির কারণে অনেক শিশুমনে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের অভ্যাসগত চাঞ্চল্য। পাশাপাশি শিশুর চোখ ও মাথা ব্যথার সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

আপনার শিশুর মনোযোগ মোবাইল ফোনের মতো ছোট ডিভাইস থেকে ক্রমশ সরিয়ে বড় ডিভাইস যেমন—ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে নিয়ে আসুন। সব থেকে ভালো হয় টেলিভিশনে আপনার শিশুর পছন্দের প্রোগ্রাম দেখার অভ্যাসে ফিরিয়ে আনতে পারা গেলে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে আলো বন্ধ করে যেন শিশু কোনো ডিভাইস না দেখে। এতে চোখের উপর চাপ পড়ে। এছাড়া টেলিভিশন দেখার সময় শিশু যেন নিরাপদ দূরত্বে চোখের দৃষ্টি সীমার মাঝে বসে।

একটানা ২০ মিনিটের বেশি সময় কোনো ডিভাইস স্ক্রিনে শিশু যেন কিছু না দেখে তা খেয়াল রাখুন। কৌশলে অন্তত ২০ সেকেন্ডের একটা বিরতি নিয়ে নিন। চা বিরতি, নাস্তা বিরতি এর থেকে বেশিও হতে পারে। টিভি বা মোবাইল স্ক্রিনে কোনো কিছু দেখার ফাঁকে ফাঁকে কিছু সময় পরপর শিশুকে চোখের পাতা বন্ধ করার নির্দেশনা দিন।

আপনি যতই কাজে ব্যস্ত থাকুন না কেন প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় আপনার সন্তানের সাথে গল্প করার সময় বের করে নিন। প্রযুক্তির সুবিধা-অসুবিধা দুটোই সন্তানকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন। প্রযুক্তি নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক আলোচনায় সঙ্গী হোন নিজ সন্তানের। অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কী বিপদ হতে পারে, সেসব নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারেন।

আপনার সন্তানকে শান্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব দেবেন না। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও চালিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত রাখার অভ্যাস বদলে আপনার শিশুর অন্য কোনো প্রিয় কাজ করুন। শিশুর সাথে বয়স অনুযায়ী খেলা খেলুন।

শিশুদের ভাষিক, সামাজিক ও মানসিক বিকাশে খেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলার মাধ্যমে শিশুর বস্তু সম্পর্কে ধারণা বাড়ে, অনুধাবন ক্ষমতা টেকসই হয়, শিশুর ভাষার প্রকাশগত দিকসহ মানসিক শব্দভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হয়। খেলতে খেলতে শিশু সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা, বুদ্ধিগত দক্ষতাও অর্জন করে।

ঘরে শিশুর সাথে লুডু, কেরাম, দাবা খেলুন। বাড়ির ছাদেও কিছু খেলাধুলা করতে পারেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশুকে নিয়ে বিকেলে বা ভোরে হাঁটতে বের হোন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তার বয়সী শিশুদের সাথে ফুটবল, ক্রিকেটের মতো খেলার সুযোগ থাকলে দেওয়ার চেষ্টা করুন। ছুটির দিনে শিশুকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসুন। সবুজ ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে দিন। চারকোনা বাক্স থেকে পৃথিবী অনেক বড়, অনেক মজার, অনেক রঙিন- আপনার শিশুকে সেটি বুঝতে সাহায্য করুন। আপনিই পারেন আপনার সন্তানকে সুন্দর শৈশব উপহার দিতে!

শান্তা তাওহিদা ।। চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিশুবিকাশ বিশেষজ্ঞ