চলার পথে অধিকাংশ সময় যদি অন্যের অন্যায়ের প্রতিবাদে ব্যয় করতে হয় তাহলে স্বকীয় চিন্তা চেতনা প্রকাশ করার সময়টুকু কিন্তু সংকীর্ণ হয়ে যায়। তাই পরগাছা লোকজনকে এত গুরুত্ব দিলে একসময় নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়ে যায়। ওরা তো থাকবেই, ওরা আছে, ওরা সবসময়ই ছিল। সুতরাং প্রতিবাদ নিজের রুচি পছন্দ অনুযায়ীই করতে হবে। অন্যথায় আমাকে তো ওদের স্তরেই নেমে যেতে হবে তাই না? আমার প্রতিবাদের ভাষা যদি প্রতিপক্ষ না বোঝে বা কুপোকাত না হয়, তাতে দুঃখ পাওয়ার বা আফসোস করার কিছুই নেই। শুধু বুঝে নিতে হবে ওদের সীমাবদ্ধতা এতটুকুই।

লুঙ্গি, গামছা, ধুতি সবকিছুই সুন্দর, অতি মনোরম। আমাদের স্বকীয়তার অংশ। তবে কে, কীভাবে তা ব্যবহার করল সেটি আলোচ্য বিষয় হতে পারে। নাচের ভঙ্গি, নাচের মুদ্রা ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। অনেক অব্যক্ত ভাবই এ মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে যায়। ইংরেজিতে যাকে ‘ননভারবাল কমিউনিকেশন’ বলে।

পরীমণির বিষয় বহুদিন ধরে লেবু চিপতে চিপতে তেতো হয়ে গেছে। এই ইস্যুতে প্রতিবাদী সংগ্রামীদের সাথে সাথে তিনি নিজেও প্রতিপক্ষকে অনেকবার নাচের মুদ্রার মাধ্যমে নিজের ভাব প্রকাশ বুঝিয়েছেন। তার সাথে আমিও সহমর্মী হয়েছি এবং আরও অনেকের জন্যই হব। দেশের অনেকেই তার প্রতি হয়ে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। শুধু নায়িকা হিসেবে নয়। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে।

বরেণ্য সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী তার প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। একবার দু’বার নয়, বারবার। শেষমেশ তিনি পরীকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখেছেন। এক জায়গায় তিনি নিজের মায়ের সাথেও তুলনা করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে আব্দুল গাফফার চৌধুরী আমাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। আমার মায়ের আপন বড় ভাই বাংলাদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালাম। তিনি সাহিত্য জগতে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর অগ্রজ, অতি কাছের মানুষ। তার বহু লেখায় তিনি শামসুদ্দীন আবুল কালামের সাথে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন।

রোমে আমার মামার মৃত্যু হওয়ার পর থেকে গাফফার চৌধুরীকে আপন মায়ের ভাই বলেই জেনে এসেছি। গত পঁচিশ বছর আমি তাকে কাছ থেকে দেখেছি। তার হাতের লাঠি হয়ে চলেছি। বিমানে চাকরির সুবাদে সবসময় তার টিকেট কেটেছি, ফ্লাইটে উঠিয়ে দিয়েছি। নিজ হাতে সিটবেল্ট বেঁধে দিয়েছি। বহুবার তার স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি।

বিমানে একবার এক ব্যক্তি লবিং করে তিনটি পদোন্নতি একসাথে নিয়ে নেওয়ার ইতিহাস গড়েছিলেন। আর সেখানে ভুক্তভোগী হয়েছিলাম আমি। আমার জুনিয়র হয়েও সেই ব্যক্তি আমার উপর উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। তখন বিমানে কর্মরত মামার অন্য এক ভাগ্নে আমার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কথা মামাকে জানিয়েছিলেন। মামা তখন ঢাকায়। আমাকে ডেকে পাঠালেন। অনেক লোকের সামনে জিজ্ঞেস করলেন, পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ কি? এর উত্তর আমি তাকে তখন দেইনি। দিতেও চাইনি। আমার মন খারাপ দেখে ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, ‘বিমান অফিসে যাব। মা তুমি খোঁজ নাও চেয়ারম্যান অফিসে কখন থাকবেন।’

ঘন্টাখানেক পর তিনি লাঠিতে ভর করে, গাড়িতে রবীন্দ্র সংগীত গাইতে গাইতে বিমান অফিসে হাজির হলেন। বিমানের চেয়ারম্যান স্যার মামাকে দেখে অবাক! তিনি মামাকে বললেন, ‘গাফফার ভাই আপনি কষ্ট করে এতদূর আসলেন! ফোন করলেই হতো।’ তখন মামা বললেন, ‘আমার ভাগ্নির উপর হয়ে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আসলাম। আপনার এখানে এত অনিয়ম জামাল ভাই!’

এটি আমার ব্যক্তিগত জীবনের স্মৃতি, যা কখনো ভোলার নয়। এত বড় ঘটনা বলার কারণ একটাই। না চাইতেই মামা অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ করেছিলেন। যা তার মতো একজন মানুষের কাছ থেকে আমার প্রাপ্য ছিল কি না আমি জানি না।

সেই মামা যখন পরীকে নিয়ে কবিতা লিখলেন তখন ভেবে অবাক হলাম, এত বড় একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের প্রতি কতটা দায়িত্ববান, কতটা কর্তব্যপরায়ণ! হয়তো পরী রক্তের বাঁধনে তার কেউই নয়।

যা বলতে চাই, নাচের মুদ্রা দেখিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়, লুঙ্গি-ধুতিও পরা যায়, যেমন খুশি তেমন সাজাও যায়। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু বারবার একই রকম প্রতিবাদে গুরুত্ব অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে যায় বৈকি। না চাইতেই কেউ যদি গুরুজনের সম্মান আর স্নেহ পেয়ে যায় তা ধরে রাখতে ধৈর্য আর আত্মসম্মানবোধও থাকতে হবে।

আমি উনিশ বছর বয়সে বিমানে চাকরি পেয়েছিলাম। চাকরি পেয়ে যেদিন বাবার অনুমতি নিতে গিয়েছিলাম, সেদিন তিনি প্রথমে নিষেধ করেছিলেন এই ভেবে যে, আমি ছোট মানুষ, দেশ-বিদেশে গিয়ে কীভাবে চাকরি করব? তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন, “মা, কাদার মধ্যে থেকেও কাদা গায়ে না লাগিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব! সেটি ‘আত্মমর্যাদাবোধ’।”

পরী নিজে অনিন্দ্য সুন্দরী। সেইসাথে অভিনয় গুণে সামনে হেঁটে যাওয়ার অনেকটি পথ বাকি রয়েছে। ভিডিওতে দেখলাম, জন্মদিনে ছোট এক দুধের শিশুকে অকস্মাৎ খুব জোরে জোরে চিৎকার করে ভড়কে দিচ্ছে। তা বেশ দৃষ্টিকটু। দেখে ভীষণ হতবাক হলাম! পরীর আশে পাশে কারা, যারা তাকে এরকম বোধবুদ্ধিহীন করে পুতুলের মতো নাচাচ্ছেন?

পরীর সাথে দেখা হলে বলতে চাই, পরী, আপনি আপন প্রতিভা বিকাশে মগ্ন হোন। আপনার ‘প্রীতিলতা’ দেখার প্রতীক্ষায় রয়েছি।

সাবিনা শারমিন ।। সাবেক ব্যবস্থাপক, প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স