ঢাউস একটা বিসিএস গাইড ছিল আমাদের বাসায়। অসাধারণ জ্ঞান নিয়ে সাধারণ একটা বই। ছোটবেলায় আমার কাজ ছিল ওই বই উল্টে দেখা আর এটা সেটা জানা। ওখানে অজস্র বইয়ের নাম ছিল। তার মধ্যে একটি ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। লেখক হাসান আজিজুল হক। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে লেখক আর বইয়ের নামটা মাথায় ঢুকে গেল। আমাদের শহরের পাবলিক লাইব্রেরির পুরানো বুক শেলফে অনেক বইয়ের মাঝখানে বইটা পেলাম।

কলেজে, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন। বইটই হাতড়ে বেড়াই। এক বৃষ্টির বিকেলে করবী গাছের গল্পটা পড়ে ফেলি। কিছুই বুঝি না—ধোঁয়াশা কুয়াশার ছায়া। ইনাম কে? সুহাস কী করল? বুড়ো বাবাটা কাঁদছে কেন? বাংলা অভিধান খুলে আত্মজার অর্থ দেখি। করবী ফুলের নাম জানি। কিন্তু করবী গাছের সঙ্গে আত্মজার কী সম্পর্ক? বুঝি না। মাথায় বাজতে থাকে ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ, এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ, এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ।’

ষাটের দশক প্রসঙ্গে পড়তে গিয়ে জানলাম। হাসান আজিজুল হক এপারের লোক নন। রাঢ় বঙ্গের মানুষ। দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় এসেছেন। থাকেন রাজশাহীতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক তিনি। মনে মনে তার জীবন নাট্যের দৃশ্যগুলো যেন দেখতে পাই। আমিও তো লিখতে টিখতে চাই। পাশাপাশি চাই মাস্টারি করতে। ব্যাপারটা খারাপ না। মাস্টারি আর লেখালেখি।

নব্বই দশককে কেন্দ্র ও প্রান্ত নিয়ে জোর টানাটানি ছিল। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকেও তেমন ছিল। ঢাকায় না এসে কবি লেখক হওয়া কঠিন—ঢাকামুখী ঢাকাবাদীদের এরকম একটা ভাবনা ছিল। কিন্তু হাসান আজিজুল হক কী করে ঢাকার বাজারে পাত্তা পেলেন? নিশ্চয়ই লেখার জোরে!

একদিন এক বন্ধুর সৌজন্যে পেয়ে যাই রাঢ় বঙ্গের গল্প। টানা পড়ে শেষ করে ফেলি সবগুলো গল্প। মনে হতে থাকে অদ্ভুত এক সময় জীবন ও অঞ্চলের ভেতর ঢুকে পড়েছি। ওই ভাষাও আগে শুনিনি। ‘শকুন’ পড়তে পড়তে মন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। ‘তৃষ্ণা’ পড়তে গিয়ে ভেসে ওঠে ঢ্যাঙা, হাবাগোবা বাসেদের মুখ।

হাসান আজিজুল হক হেসে হেসে জবাব দিচ্ছিলেন। বলেছিলেন, ‘সব লেখা গুছিয়ে হয় না। হয়তো শুরুতে যে অনুচ্ছেদ লিখেছি সেটি চলে যাচ্ছে লেখার মাঝখানে...

বুকের ভেতর কামনা ও ঈর্ষার হলকা বইয়ে দেয় ‘মন তার শঙ্খিনী’; হামিদার ভয় জাগানিয়া উক্তি, আজ যেচি আমি সোয়ামীর বাড়ি, তোর ছেলে রইল আমার পেটে। খানিকটা শোধ দেলোম।’ আমাদের ওই লাইব্রেরিতেই পেয়ে যাই ‘লাল ঘোড়া আমি’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘অতলের আঁধি’; এখন স্মৃতি হাতড়ে দেখতে পাচ্ছি, আমাদের বন্ধুদের প্রত্যেকের ‘আমি’ হয়ে ওঠার মুহূর্তে প্রধান লেখকদের একজন ছিলেন হাসান আজিজুল হক।

সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক আমাদের অবশ্য পাঠ্য লেখক ছিলেন। পত্রিকায় আমরা তার লেখা, সাক্ষাৎকার পেলেই নিবিষ্ট শিক্ষার্থীর মতো হৃদয় দিয়ে পড়তাম। লেখা কীভাবে হয়ে ওঠে তার টেকনিকগুলো বোঝার চেষ্টা করতাম তার কথা থেকে। মনে আছে তার সাক্ষাৎকারের একটা সংকলন ছিল; ওটা কিনেছিলাম নীলক্ষেতের ফুটপাত থেকে।

ভাবতাম হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা হলে মন্দ হত না। সেই সুযোগ পেলাম ২০০৪ সালে। ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক একটি সফরে আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল দুটো, হাসান আজিজুল হক ও পদ্মা নদী। তার সঙ্গে আলাপ ও আড্ডার সুযোগ পেলাম আমরা।

তিনিও বেশ সময় নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাকে খুব বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হয়নি। সম্ভবত তার লেখার মুহূর্ত ও পরিকল্পনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেছিলাম। হাসান আজিজুল হক হেসে হেসে জবাব দিচ্ছিলেন। বলেছিলেন, ‘সব লেখা গুছিয়ে হয় না। হয়তো শুরুতে যে অনুচ্ছেদ লিখেছি সেটি চলে যাচ্ছে লেখার মাঝখানে। আবার শেষে লিখব বলে যা ভেবেছিলাম, তা চলে এসেছে একেবারে শুরুর দিকে। এরকম আগু-পিছু হয়।’ এইটুকু মনে আছে।

এক দশক পর ২০১৫ সালে আবার দেখলাম তাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত একটি কনফারেন্সে আমি ছিলাম মুখ্য বক্তা। হাসান আজিজুল হক ছিলেন সভাপতি। দশ মিনিট পেরুতেই স্যার বললেন, আপনি আর পাঁচ মিনিট পাবেন। ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। সভাপতি আমাকে থামিয়ে দিলেন। আমি বললাম, স্যার আমি কিন্তু আরও সময় পাব। হাসান আজিজুল হক বললেন, নাহ, আপনি আর সময় পাবেন না। আমি মুচকি হেসে বসে পড়লাম। তার সঙ্গে আমার আর কোনো প্রত্যক্ষ স্মৃতি নেই। তাকে ঘিরে আমার সব স্মৃতি তার লেখা ও বই কেন্দ্রিক।

কয়েক দশক ধরে পার্টিশন লিটারেচার বা দেশভাগের সাহিত্য বেশ মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের এই শাখায় হাসান আজিজুল হক অনিবার্য একটি অধ্যায়।

স্মৃতির বাইরে আমি একটি কথায় ভাবি—হাসান আজিজুল হককে ছাড়া বাংলা গল্পের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। আরেকটি জিজ্ঞাসা জাগে, তিনি কেন মনোযোগ পেলেন? তার ভাষা তো জলবৎ তরল নয়। চাইলেই তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যায় না তার গদ্য। গল্পেও নেই টানটান উত্তেজনা। বরং এক নিস্তরঙ্গ ভঙ্গিতে গল্পের স্রোত ধীরে ধীরে চলতে থাকে।

পাঠক হিসেবে ডানে, বামে, সামনে, পেছনে এক দুবার তাকাতে হয়। পড়তে গিয়ে ঠিক করে নিতে হয় বাক্যের নিশানা, অর্থের লক্ষ্য, সংলাপের মর্মার্থ। অর্থাৎ পাঠকের তীক্ষ্ণ মনোযোগ দাবি করে। এই অসহজ বাণী বিন্যাস নিয়েই তিনি দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেন। কিন্তু জনপ্রিয় হলেন না।

হাসান আজিজুল হক মনোযোগ পেলেন তিনটি কারণে; প্রথমত, একটি অচেনা অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষকে ধারণ করলেন; দ্বিতীয়ত, গল্পের ভেতর ছড়িয়ে দিলেন চিন্তার বীজ; তৃতীয়ত, সাহিত্য, রাজনীতি ও প্রতিরোধের ভাষাকে জারি রাখলেন। এসবের কোনোটিই তার গল্প উপন্যাসকে আটকে রাখল না নির্দিষ্ট সময়ের সীমায়। তার নির্মিতির ভেতরই রয়ে গেল ক্লাসিক উপাদান।

তিনি হয়ে উঠলেন বাংলা গল্পের ধ্রুপদি নির্মাতা। গল্পের প্রথম বাক্য থেকে শেষ বাক্যে পৌঁছতে পাঠককে পাড়ি দিতে হয় কত পথ, চড়াই-উতরাই। সংকেতময় একটি শব্দ, বাক্য কিংবা চরিত্রের উল্লেখ নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। আর গল্পের শেষ বাক্যে এসে যায় সব চেয়ে সংবেদী উক্তিটি। আখ্যানের সমস্ত ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে ওই বাক্য।

‘শকুন’ গল্পের শেষে আছে, দিনের চড়া আলোয় তাকে অদ্ভুত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মরা শকুনিটার মতোই।’ অথচ পুরো গল্প জুড়ে শকুন ছিল ঘৃণ্য একটি জীব; তার তুলনা চলছিল বদখদ চেহারার, ভয়ের,

দেশ হারানোর দগদগে ক্ষত কি সহজে মিলিয়ে যায়? দেশ তো মানুষের জন্মদাগ। হাসান আজিজুল হক তার স্মৃতির ভেতর থেকে শোনালেন জন্মদাগের গল্প।

বিভীষিকার, সুদখোর মহাজনের। গল্পের শেষ অনুচ্ছেদে জানতে পারছি, মৃত শিশু দেখতে গাঁয়ের সবাই এলেও আসেনি শুধু কাদু শেখের বিধবা বোন। কেন এলো না?

রাতের অন্ধকারে জমিরুদ্দির সঙ্গে কী করছিল সে? মৃত সন্তানটি কি ওরই? গল্প শেষ হয়েও শেষ হয় না। কাদু শেখের বিধবা বোনের জন্য মায়া জন্মায়। ভাবনার অনেকগুলো দুয়ার খোলা রেখে সংশয়ের পাথর চাপিয়ে দিয়ে বিদায় নেন কথক হাসান আজিজুল হক।

কয়েক দশক ধরে পার্টিশন লিটারেচার বা দেশভাগের সাহিত্য বেশ মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের এই শাখায় হাসান আজিজুল হক অনিবার্য একটি অধ্যায়।

সেই কোন রাঢ় অঞ্চল থেকে পূর্ব বাংলার নদ-নদী জলাভূমিতে এলেন তিনি। কাঁটাতারের অন্য পারে রেখে এলেন সমস্ত স্বপ্ন, কল্পনা, স্মৃতি। পূর্ব বাংলাকে ঘিরে শুরু হলো তার আরেকটি স্বপ্নযাত্রা। কিন্তু স্মৃতি কি সহজে মরে? দেশ হারানোর দগদগে ক্ষত কি সহজে মিলিয়ে যায়? দেশ তো মানুষের জন্মদাগ। হাসান আজিজুল হক তার স্মৃতির ভেতর থেকে শোনালেন জন্মদাগের গল্প।

দেশের মানচিত্র বদলায়, রাষ্ট্রের কাঠামো বদলায়, কিন্তু স্মতি সত্তা ভবিষ্যতের ভেতর পুষ্পিত দেশ চেতনার অবসান ঘটে না। সেই গল্পও সহজে ফুরায় না। ইতিহাসের দেশহারা মাটিহারা অসংখ্য মানুষের কান্না বুঝতে হলে হাসান আজিজুল হকের কাছে আমাদের যেতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা সুফলা মলয়জ শীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটাব ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে। প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দান তো উপাদান মাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে তোলা হলো। মানুষের হাতে দেশের জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি।’ মানুষের দেশ ভাঙা এবং দেশ সৃষ্টির ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক ও চিরায়ত হয়ে থাকবেন হাসান আজিজুল হক।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়