কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে বেশকিছু সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত করছে। বিগত দিনগুলোতে ঘটে যাওয়া কার্যক্রমের খবর স্থানীয় জনমনে একধরনের উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নেতা মুহিবুল্লাহকে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে হত্যার ঘটনা এবং অল্প দিনের ব্যবধানে একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছয়জন রোহিঙ্গার সহিংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ক্যাম্পের অভ্যন্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার অবকাশ তৈরি করেছে।

এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে ক্যাম্পে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের একাংশের মধ্যকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একই সাথে আইন বর্হিভূত কার্যক্রমের সাথে বেশকিছু রোহিঙ্গার দলগতভাবে জড়িয়ে পড়া ও তাদের যথেচ্ছ শক্তিমত্তা প্রদর্শনের সাম্প্রতিক নিদর্শনগুলো স্থানীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে ভিন্ন মাত্রা প্রদান করেছে।

বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) তথ্যানুযায়ী, গত চার বছরে (২০১৭ এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ এর অক্টোবর পর্যন্ত) উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অন্যান্য সংঘর্ষে প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা হতাহতের শিকার হয়েছে। এ ঘটনাগুলোর ডামাডোলে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ/আরসা) সংগঠনটির নাম অনেকবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে।   

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্য জুড়ে আরসা’র সন্ত্রাসী কার্যক্রম, বিশেষত পুলিশের উপর হামলার যে অভিযোগ সে দেশের সরকার করেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনী (তাতমাদো) রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংস জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করে। সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে রাখাইন রাজ্য অশান্ত হয়ে উঠে, আর সেখান থেকে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা জোরপূর্বক বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে নির্বাসিত হতে বাধ্য হয়।

গত চার বছরে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অন্যান্য সংঘর্ষে প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা হতাহতের শিকার হয়েছে। ঘটনাগুলোর ডামাডোলে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ/আরসা) সংগঠনটির নাম অনেকবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে।

মিয়ানমার সরকার আরসাকে ‘চরমপন্থী বাঙালি সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে এর সম্পর্কের অভিযোগ তুলে রোহিঙ্গা নিধনে তাদের গণহত্যা কার্যক্রমকে প্রকারান্তরে ন্যায্যতা প্রদানে সচেষ্ট ছিল। 

অনেকে মনে করেন যে, নির্বাসিত সাধারণ রোহিঙ্গাদের সাথে এই দলটির অনেক সমর্থকও বাংলাদেশে ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে এবং সুযোগ বুঝে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

গণমাধ্যমের বেশকিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ সংগঠনটির নাম ‘আল ইয়াকিন’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। কথিত আছে যে, এ সংগঠনটি ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে লিপ্ত এবং ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারে তারা শক্তির প্রয়োগ করে আসছে। বাংলাদেশ সরকার ও এর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যদিও এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে এমন কোনো সংগঠিত মিয়ানমার ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। তবে ক্যাম্পে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সময়ের সন্ত্রাসী ঘটনা এধরনের গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে। এছাড়াও ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মুখে এই নামটি এখন আর অজানা নয়। এরা আসলে কারা এবং এদের অস্তিত্ব কি আদৌ বিদ্যমান ও তা নিরাপত্তার উপর কি প্রভাব ফেলছে? সেটাই এখন প্রতিপাদ্য বিষয়।  

আরসা’র উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য পরিলক্ষিত হয়। মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য হলো, এ সংগঠনটি রাখাইন রাজ্যের অংশ নিয়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এটির পরিচায়ন মুখ্য বিষয়। যদিও ২০১৭ সালে এ সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তাদের উদ্দেশ্য হলো মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রাম। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবে। 

আরসা’র উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য পরিলক্ষিত হয়। মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য হলো, এ সংগঠনটি রাখাইন রাজ্যের অংশ নিয়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আতাউল্লাহ’র বক্তব্যে এ বিষয়টি পরিষ্কার ছিল যে, ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তাদের লক্ষ্য নয়, বরঞ্চ মিয়ানমারে তারা তাদের নাগরিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। আতাউল্লাহ তার বক্তব্যে ইসলামিক স্টেট বা আইএসআইএস-এর সাথে আল ইয়াকিন এর যোগসূত্র অস্বীকার করেছে। ভিন্ন ব্যাখ্যাসমূহ আরসা’র অস্তিত্ব ও কার্যক্রমকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলে।

অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার একসময় আরসাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টিলেজেন্সকে (আইএসআই) দায়ী করেছিল। একইসাথে ভারতের বেশকিছু মিডিয়া দাবি করে যে, আরসাকে পাকিস্তানের আইএসআই তহবিল এবং রসদ সরবরাহ করেছে।

২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলে আল ইয়াকিন ও পাকিস্তানের যোগসূত্র নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী সংবাদ উপস্থাপন করে। এ ধরনের সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে পাকিস্তানের এই নিরাপত্তা সংস্থার বিরুদ্ধে আল ইয়াকিনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে বেশকিছু অভিযোগের উল্লেখ রয়েছে। তবে এই অভিযোগগুলো স্বতঃসিদ্ধরূপে প্রমাণিত কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি।

তবে ক্যাম্পগুলোতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর উগ্রবাদ চর্চার বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসী দলগুলো তাদের মতবাদ প্রচারে ধর্ম ও ধর্মীয় স্থানের অপব্যবহার করেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে ও গবেষকদের বিশ্লেষণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এ ধরনের উদাহরণ পাওয়া যায়। ক্যাম্পে অবস্থিত এধরনের সন্ত্রাসী দলগুলোর অর্থের ও অন্যান্য রসদের জোগান নিয়ে নানা বক্তব্য রয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরে সাধারণ রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করা এ ধরনের দলগুলোর কাজ। এছাড়াও নিয়মিতভাবে আন্তঃসীমান্ত চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায় জড়িত থেকে এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের যথেচ্ছ ব্যবহার করে এরা অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। কিছু প্রতিবেদনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাঠানো রেমিটেন্সের অর্থের উপর এদের নজরের কথা আলোচিত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ২০১৭ এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। 

আরসা’র পরিচয়ের সংকট এখনো বিদ্যমান। তবে তাদের অস্তিত্ব, সেটা হয়তো কিছুটা বায়বীয়; কিন্তু ক্যাম্পবাসী রোহিঙ্গাদের আখ্যানে আরসা’র অস্তিত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

ক্যাম্পগুলোতে আল ইয়াকিন সমর্থকদের নেটওয়ার্ক যে ক্রমবর্ধমান এবং রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক নিপীড়নের জিঘাংসাকে পুঁজি করার অপচেষ্টায় ধর্মের অপব্যবহার করার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

প্রাথমিকভাবে তাই দরিদ্র রোহিঙ্গাদের দলে নিয়ে উগ্র মতবাদে দীক্ষিত করা এবং সহিংস অপরাধমূলক কাজে নিয়োজিত করার মধ্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে তাদের গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করাই এদের লক্ষ হতে পারে।

এহেন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ক্যাম্পে অবস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় বাংলাদেশি জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এটি মনে হয় যে, আরসা বা আল ইয়াকিন-এর অস্তিত্ব ও ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী দল হিসেবে এদের পরিচিতির প্রাধান্য মূলত মিয়ানমার সরকারের অবস্থানে ও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু গণমাধ্যমের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে।

আরসা’র পরিচয়ের সংকট এখনো বিদ্যমান। তবে তাদের অস্তিত্ব, সেটা হয়তো কিছুটা বায়বীয়; কিন্তু ক্যাম্পবাসী রোহিঙ্গাদের আখ্যানে আরসা’র অস্তিত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বেশ সচেষ্ট। অতি সম্প্রতি এ অভিযানগুলো আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৪-এর কাছের পাহাড়ি এলাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সেখানে অভিযান চালায় ও বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রসহ তিন রোহিঙ্গা অস্ত্র কারিগরকে আটক করে। ধারণা করা যায় যে, সাম্প্রতিক সময়ের সহিংস ঘটনাগুলোতে এদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। এ ধরনের অভিযান আরও পরিচালনা করার প্রয়োজন রয়েছে এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে আরও সমন্বয় সাধন করে এধরনের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার উগ্র সন্ত্রাসবাদের প্রতি ও যেকোনো ভিনদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের প্রতি শূন্য সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করে থাকে। আমরা আশা করতে পারি যে, নিরাপত্তা বাহিনী তাদের অবস্থান জোরদার করার মধ্য দিয়ে সে অবস্থা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। 

সর্বশেষে, এটি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সহায়তায় তাদেরকে মিয়ানমারের রাখাইনে নিজেদের আবাসস্থলে ফিরিয়ে নিয়ে, আইনি স্বীকৃতি প্রদান করার মাধ্যমে, এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে তথাকথিত আরসা অথবা অন্য যেকোনো গোষ্ঠীর সক্রিয় অবস্থান ও অপরাধমূলক কার্যক্রম রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় বাধা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষায় জড়িত সকল সংস্থাকে তাই একযোগে এহেন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও সচেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে।    

ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস ।। সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়