ছবি : সংগৃহীত

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অত্যন্ত সজ্জন শিক্ষক ছিলেন। মৃদুভাষী এবং স্মিত হাসি লেগেই থাকতো তার মুখে। সম্ভবত আমাদের তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ চলছিল। একদিন তিনি ক্লাসে আসার আগে আমাদের সহপাঠীদের একজন পুরো ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে অমার্জিত একটা বাক্য লিখেছিল এবং নজরুল স্যার ক্লাসে চলে আসায় সে আর বাক্যটি মুছে ফেলতে পারেনি। স্যার এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে ডাস্টার নিয়ে বাক্যটি মুছে ফেললেন এবং এরপর এক বাক্যে যা বললেন, তার মর্মার্থ হলো, খুব নিচু স্তরে জন্মলাভকারীর পক্ষেই এ ধরনের কথাবার্তা লেখা ও উচ্চারণ করা সম্ভব।

সদ্য সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের গত দুই তিন মাসের বিশ্রম্ভালাপ শুনে নজরুল স্যারের কথাটি বারবার মনে পড়েছে। হতে পারে তিনি ভালো পরিবারের সন্তান, কিন্তু ভালো শিক্ষা লাভ করেননি। না পারিবারিক, না প্রাতিষ্ঠানিক, না রাজনৈতিক।

জাতীয় সংসদে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের যে শিক্ষা তা তার অসংসদীয় শব্দ প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। পরিবেশগত ও অবস্থানগত ভব্যতাও তাকে শিক্ষিত করে তুলতে পারেনি। একটা চেয়ার তাকে অশিষ্ট, দুর্বিনীত করে তুলেছিল।

বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কিশোরী নাতনি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেত্রীদের সম্পর্কে তার অশালীন মন্তব্য, চলচ্চিত্রের একজন নায়িকার সঙ্গে টেলিফোনে তার আলাপ অশ্রাব্য হলেও আমিসহ অনেককে তা শুনতে হয়েছে। এমনকি একটা অনুষ্ঠানে, ভিডিও দেখে বিয়ের অনুষ্ঠান বলেই মনে হয়েছে, সেখানে মুরাদ হাসানকে কাদের মা’দের তিনি কী করবেন চিৎকার করে বলতে বলতে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে।

একজন ব্যক্তির নৈতিক মান কতটা নিচু হলে তার পক্ষে এ ধরনের শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব তা বোঝার জন্য জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের চোখের অন্তরালে তিনি কী কী করেছেন তা একমাত্র স্রষ্টাই জানেন। তবে দৃশ্যত যা বলেছেন ও করেছেন তাতে তিনি নৈতিক স্খলনের দোষে দোষী।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথমবার কোনো মন্ত্রীকে নৈতিক স্খলনজনিত কারণে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা ঘটল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটা কাজ করেছেন। আশির দশকের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার সরকারের সময় একজন অতি ক্ষমতাবান মন্ত্রী, যিনি খ্যাতনামা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তার বিরুদ্ধে একজন নারী রোগী অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগ গুরুতর ছিল, কিন্তু মন্ত্রী বহাল তবিয়তে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অসংখ্য অভিযোগ ছিল, তিনি সেসব অভিযোগকে আমলে না নিয়ে তার অপকর্ম চালিয়ে যেতে দ্বিধা করেননি।

ডা. মুরাদ হাসানের গত দুই তিন মাসের বিশ্রম্ভালাপ শুনে নজরুল স্যারের কথাটি বারবার মনে পড়েছে। হতে পারে তিনি ভালো পরিবারের সন্তান, কিন্তু ভালো শিক্ষা লাভ করেননি। না পারিবারিক, না প্রাতিষ্ঠানিক, না রাজনৈতিক।

উন্নত দেশগুলোতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নৈতিক স্খলনকে সহ্য করা হয় না। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। অথবা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে অপসারণ করা হয়। গত আগস্ট মাসেই নিউইয়র্কের জনপ্রিয় গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমো (Andrew Mark Cuomo)-কে নৈতিক স্খলনের অপরাধে অপসারণ করা হয়েছে। এন্ড্রু’র কারণে ক্যুমো পরিবারের দু’শ বছরের রাজনৈতিক ঐতিহ্য কলঙ্কিত হয়েছে। তার পিতা মারিও ক্যুমোও একাধিক মেয়াদে নিউইয়র্কের গভর্নর ছিলেন। ডজনখানেক নারী এন্ড্রু ক্যুমোর বিরুদ্ধে আপত্তিকর যৌন আচরণের অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগকারীরা এন্ড্রুর কোনো আচরণ প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন (Bill Clinton) ও মনিকা লিউনস্কি (Monica Lewinsky)-র পর্যায়ে গিয়েছিল মর্মে অভিযোগ না করলেও এন্ড্রু তাদের সঙ্গে যা করেছিলেন তা আমেরিকান শালীনতা অনুযায়ী আপত্তিকর যৌন আচরণই ছিল। এন্ড্রু তদন্ত কমিটির শুনানিতে বলেছেন যে, তিনি যা করেছেন তা তিনি তার ব্যক্তিগত আচরিত অভ্যাস অনুযায়ীই করেছেন, যা দোষনীয় পর্যায়ে যেতে পারে বলে তিনি ভাবেননি। যেমন করমর্দনের সময় অভিযোগকারী নারীদের হাতে জোরে চাপ দেওয়া, কাঁধে বা কোমরে হাত রাখা এবং আলিঙ্গনের সময় গালে ঠোঁট স্পর্শ করা। কিন্তু সম্মতি ছাড়া এসব কর্ম আইনত শাস্তিযোগ্য, এবং এন্ড্রু ক্যুমো যথাবিহিত শাস্তি লাভ করেছেন। আমেরিকান বলে নয়, সকল সংস্কৃতিতেই অভ্যাসের দাস এমন লোকজনের অস্তিত্ব রয়েছে।

মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে বিল ক্লিনটনের আচরণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছিল। ইংরেজি ভাষায় যাকে ‘পেনিট্রেশন’ বা সোজা বাংলায় ‘যৌন সঙ্গম’ না হলেও উভয়ের মধ্যে যা যা হয়েছিল তা পেনিট্রেশনের চেয়েও ভয়াবহ ছিল। দিনের পর দিন তারা পেনিট্রেশন ছাড়া সকল যৌনকর্ম করেছেন। গভর্নর অল্পতেও পার পাননি, কারণ তার অভিযোগকারীরা তাদের সম্মতিহীন যৌন আচরণের অভিযোগ করেছেন।

ক্লিনটন ও লিউনস্কি যা করেছেন তা দু’জনের সম্মতিতে। দু’জনই তদন্তকারীদের কাছে তা স্বীকার করেছেন। ক্লিনটন জাতির কাছে তার স্ত্রী হিলারি (Hillary Clinton), কন্যা চেলসিয়া (Chelsea Clinton), তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, হিলারি তাকে ক্ষমা করেছেন। তা সত্ত্বেও এক ধরনের জোড়াতালির মধ্য দিয়ে ক্লিনটন অনিবার্য ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন থেকে রক্ষা পেয়েছেন।

উন্নত দেশগুলোতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নৈতিক স্খলনকে সহ্য করা হয় না। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।

আমেরিকান প্রশাসনের দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের নৈতিকতার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার চেষ্টা নিরন্তর। সিনিয়র বুশ (George H. W. Bush) ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে যখন তার প্রশাসনের লোকজন বাছাই করার পর্যায়ে ডিফেন্স সেক্রেটারি হিসেবে প্রস্তাব করেন টেক্সাসের জন জি টাওয়ার (John Goodwin Tower)-র নাম। প্রেসিডেন্ট কারও নাম প্রস্তাব করলেও সিনেট তা নিশ্চিত না করলে প্রেসিডেন্ট তার পছন্দনীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারেন না। সিনেটের আপত্তির কারণ জন টাওয়ার মদ্যপায়ী এবং বহু নারীতে আসক্ত। তার মতো একজনকে প্রশাসনে নেওয়া যায় না। বুশ যত বলেন এসব ছোটখাটো মানবিক দুর্বলতা। সিনেট কিছুতেই অনুমোদন দেবে না। বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন এবিসি টেলিভিশনের স্যাম ডোনাল্ডসন (Sam Donaldson) জন টাওয়ারের একটা সাক্ষাৎকার নেয়। টাওয়ার বলেন যে, ডিফেন্স সেক্রেটারির দায়িত্ব পেলে তিনি মদ্যপান ছেড়ে যাবেন। তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু নারীসঙ্গ লাভ কি অন্যায়? আমি তিন বছর যাবৎ বিপত্নীক। অন্যেরা যেভাবে প্রেম করে, ডেটিংয়ে যায়, আমিও যাই। এর মধ্যে অপরাধ কোথায়, স্যাম।’ তবুও কংগ্রেস তাকে অনুমোদন দেয়নি। ডিফেন্স সেক্রেটারি হন ডিক চেনি (Dick Cheney)।

আমেরিকায় নৈতিকতার মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে শুধু শীর্ষ পদগুলোতেই নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। অনেক কংগ্রেসম্যানের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারীদের পক্ষ থেকে সম্মতি বহির্ভূত যৌন আচরণের অভিযোগ উঠেছে এবং হাউজ এথিকস কমিটির শুনানি ও এফবিআই এর তদন্ত এড়াতে তারা কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেছেন।

বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের অভিযোগ ছাড়াও কোনো নারীকে যৌন উত্ত্যক্তকর টেক্সট মেসেজ পাঠানো, ইমেইল, টুইটারে আপত্তিকর ছবি পাঠানোর মতো অভিযোগেও পদত্যাগ করার, দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া বহু ঘটনা রয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যেসব কংগ্রেসম্যানকে নৈতিক স্খলনের অভিযোগে পদত্যাগ করতে হয়েছে, তারা ছিলেন, নিউইয়র্কের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান এরিক মাসা (Eric Massa), ইন্ডিয়ানার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মার্ক রবার্ট শোঅল্টার (Mark Robert Showalter), নিউইয়র্কের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ক্রিস লী (Chris Lee), নিউইয়র্কের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান এন্থনি ওয়েনার (Anthony Weiner), টেনেসির রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান স্কট ডেসজার্লাইস (Scott DesJarlais), অরিগনের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান ডেভিড উ (David Wu), লুইজিয়ানার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ভ্যান্স ম্যাকঅ্যালিস্টার (Vance McAllister), টেক্সাসের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ব্লেক ফ্যারেনথোল্ড (Blake Farenthold), ইলিনয়ের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান (হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের সাবেক স্পিকার) ডেনিস হ্যাসটার্ট (Dennis Hastert), পেনসিলভেনিয়ার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান টিম মার্ফি (Tim Murphy), মিনেসোটার ডেমোক্রেট সিনেটর অ্যাল ফ্রাংকেন (Al Franken), টেক্সাসের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জো বার্টন (Joe Barton), মিশিগানের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান জন কনইয়ার জুনিয়র (John James Conyers Jr.), অ্যারিজোনার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ট্রেন্ট ফ্রাংকস (Trent Franks), পেনসিলভেনিয়ার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান প্যাট মাহিন (Pat Meehan), ওহাইয়োর রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জিম জর্ডান (Jim Jordan), ক্যালিফোর্নিয়ার কংগ্রেসম্যান ক্যাটি হিল (Katie Hill), ফ্লোরিডার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ম্যাট গায়েটজ (Matt Gaetz)।

মানুষ ইন্দ্রিয় তাড়নার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু মাত্রা ও পরিমিতি বোধ, শিষ্টাচার বলেও কিছু শব্দ আছে। কোড অব এথিকস আছে। কাকে কোথায় কী করতে হবে, কে কী বলতে পারে সেজন্য নৈতিকতার মানদণ্ড রয়েছে। সীমা লঙ্ঘন করার শাস্তির বিধান আছে। ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুরাদ হাসানের পরিণতি সবার জন্য শিক্ষণীয় হোক!

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ।। সাংবাদিক