ছবি : সংগৃহীত

সফলতা এমন এক জিনিস যা সব দুঃখকে ভুলিয়ে দেয়। একজন মানুষ যখন এভারেস্ট জয় করেন তার বিজয়ী মুখের ছবি দেখে আমরাও কেউ মনে রাখি না যে, মানুষটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কত চেষ্টা, সাধনা আর পরিশ্রম করে আজ পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছেন। সব সফলতার পেছনের গল্পটা একই রকম। কেবল পেছনের দৃশ্যপট আমরা ভুলে যাই।

২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী খুচরা ই-কমার্সের বাজার ছিল ২.৯৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালে ছিল ৩.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২০ এ এসে দাঁড়িয়েছে ৪.২০৬ ট্রিলিয়ন ডলারে, ২০২২ সালে প্রত্যাশিত বাজার ৬.৫৪ ট্রিলিয়ন ডলার। যা ৩ বছরে দ্বিগুণের কাছাকাছি হবে।
আমরা যদি বিগত ১০/১৫ বছরের প্রবৃদ্ধি দেখি তখন কিন্তু আমরা দেখব যে, অতীতে আমরা বেশ পিছিয়ে ছিলাম। সে তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক অনেক ভালো। বাংলাদেশে ২০২০ সালে ই-কমার্সে ১৬ হাজার কোটি টাকার বাজার বলা হচ্ছে এবং ২০২১ সালের শেষে এটা ২৪ হাজার কোটি টাকা হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এবার লক্ষ্যমাত্রা থেকে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা কমও হতে পারে। সেটা সাম্প্রতিক সময়ের নানা সমস্যার কারণে হয়ে থাকবে। 

আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগে বাংলাদেশে ই-কমার্সের সূচনা হয়। আমরা অনেকে সেটা ভাবতেই পারি না। কারণ তখন ব্যাংক কার্ড, এটিএম বুথ এমনকি পজ মেশিনের ব্যবহারও খুব সীমিত ছিল। আর মোবাইল ব্যাংকিং ছিল স্বপ্নের পর্যায়ে। মোবাইলইতো ছিল সোনার হরিণ। তাই ই-কমার্সের শুরুর চ্যালেঞ্জটাও খুব কঠিন ছিল। 

যদি আমরা ধরে নিই, প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে ই-কমার্স শুরু হয়েছে মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন আসার পর, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার পর, ফেসবুকের গ্রাহক বাড়ার পর, মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয় হওয়ার পর কিংবা ক্যাশ অন ডেলিভারি সেবার সাথে ক্রেতাদের পরিচিতি তৈরি হওয়ার পর। তাতেই কি বলা যায় শুরুটা ভালো ছিল? মোটেই নয়। যারা আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে শুরু করেছেন তারা জানেন কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে!

ক্রেতারা ফোন করে নিশ্চিত হতে চাইতেন সবকিছু ঠিক আছে কি না? তাদের আস্থা অর্জন করা ছিল খুব কঠিন একটা কাজ। আজকের মতো এতো ই-কমার্স ভিত্তিক কুরিয়ার সেবা ছিল না। নিয়মিত কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো কেজি প্রতি অনেক টাকা চার্জ করতো। তাও তাদের সেবা এলাকা ছিল খুব সীমিত। বড় বড় কয়েকটি শহরের বাইরে সেবা পাওয়া যেত না। 

প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে ই-কমার্স শুরু হয়েছে মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন আসার পর, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার পর, ফেসবুকের গ্রাহক বাড়ার পর...

এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠা হলো ই-ক্যাবের। মাত্র ৫০টি সদস্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে ২০১৪ সালে যখন ই-ক্যাব যাত্রা শুরু করে তখন অনেকে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। যেখানে স্বয়ং ক্রেতারাই সন্দিহান সেখানে কি বলা যায় এর শুরুটা ভালো ছিল? না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভালোতে রূপান্তর করতে হয়েছে। এসময় যেসব সমস্যা হতো সেগুলো হলো ই-কমার্স মার্চেন্টের টাকা মেরে কুরিয়ার কোম্পানি লাপাত্তা, এরকম ভুরি ভুরি ঘটনা ঘটেছে।

ক্রেতা সেজে পণ্য অর্ডার দিয়ে পথে ছিনতাই করা, এরকম ঘটনা এখনো ঘটছে তবুও দিন দিন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলেই আমরা সকলে ই-কমার্সের সেবাকে উপভোগ করছি। আর সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি না পাওয়া কিংবা ভুল পণ্য পাওয়া অথবা টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়া এসব চক্র তো সবসময় ছিল। এখনো আছে। পার্থক্য হলো আগে বিক্রি কম ছিল বলে প্রতারণা কম হতো এখন বিক্রি বেশি বলে সমস্যা বেশি হয়। তবে সমস্যার হার কমেছে কিন্তু সার্বিক বিক্রি বাড়ার কারণে পরিমাণও বেড়েছে। 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৮ সালে দৈনিক ডেলিভারি ছিল ৫০ হাজার আর সমস্যা হতো ৭৫০টি। তা মোট বিক্রির ১.৫ %। ২০২০ সালে দৈনিক বিক্রির অর্ডার বা ডেলিভারি ১ লাখ আর সমস্যা হতো ৫০০টি ডেলিভারিতে, যা মোট অর্ডারের ০.৫ %। ২০২১ সালের প্রথম অর্ধে দৈনিক অর্ডারের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখে আর সমস্যা ছিল হয়তো দৈনিক ২০০০টি। যা মোট বিক্রির ১% এবং আজকের এই সময়ে বা ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে দৈনিক মোট অর্ডার ২ লাখ ৫০ হাজার এর মধ্যে সমস্যা হচ্ছে হয়তো ৫০০টি, যা মোট বিক্রির ০.২%। তাহলে সার্বিক চিত্র কিন্তু ইতিবাচক। এটা কোনো পরিসংখ্যান না হলেও বাস্তবচিত্র কিন্তু মোটামুটি এরকম বা এর কাছাকাছি। এর মানে এই নয় যে, এই উন্নতিও এমনিতেই হয়েছে।  

এই যে গ্রাফিক্যাল উন্নতি এটা মোটেই সহজে হয়নি। সরকারের সাথে বসে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনকে যেমন অনেক দাবি আদায় করতে হয়েছে। আবার উদ্যোক্তাদের দক্ষ এবং ক্রেতাদের সচেতন করার জন্য শত শত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

 ঠিক এই সময়ের মধ্যে ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম বা উই [Women and e-Commerce forum (WE)] প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাত দিন সময় দিয়ে এখানে অনেকগুলো মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লাখ লাখ মানুষকে জড়ো করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের তথ্য ও ধারণা দেওয়া হয়েছে, ক্রেতাদের ভরসা দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছরের পরিশ্রমের ফলেই আজ ক্রেতা-ভোক্তার পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গা তৈরি হয়েছে।

নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ই-কমার্স সেক্টর দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে তার মানে এই নয় যে, কোনো সমস্যা ছিল না। এখনো গ্রামীণ পর্যায়ে ডেলিভারি সময়মতো দেওয়া যায় না কারণ লজিস্টিক দুর্বলতা।

আমরা যদি শুধু করোনা পরিস্থিতির কথা ভাবি, করোনাকালীন সরকারের কাছ থেকে ব্যবসা চালুর অনুমতির পরও রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা মার খেয়েছে ডেলিভারিম্যানেরা। অনেক বাধা-বিপত্তি, নিরাপত্তা ঝুঁকি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলা করে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করে গত দেড় বছরে দ্বিগুণের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এই খাত। যেখানে নিয়মিত প্রবৃদ্ধি ছিল ৫০%। সেখানে তা দেড় বছরে ক্ষেত্রবিশেষে ৩০০% প্রবৃদ্ধিও এসেছে। ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের ভিড়ে নারী উদ্যোক্তারা বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা সবচেয়ে কম অভিযোগের মুখে পড়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা যায় ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তির হার ৮৪% যা অনেক মার্কেটপ্লেসের চেয়ে বেশ ভালো। তাহলে শুরুটা ভালো বা আরামদায়ক ছিল এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

গত দেড় বছরে এই প্রবৃদ্ধি এবং নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ই-কমার্স সেক্টর দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে তার মানে এই নয় যে, কোনো সমস্যা ছিল না। এখনো গ্রামীণ পর্যায়ে ডেলিভারি সময়মতো দেওয়া যায় না কারণ লজিস্টিক দুর্বলতা। এখনো ই-কমার্স উদ্যোক্তারা সহজে ঋণ পান না কারণ তাদের সকল ই-কমার্স উদ্যোক্তার দৃশ্যমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। 

সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ভুগছে ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তারা। এখনো অনেক নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা পরিবারের অমতে তার উদ্যোগ পরিচালনা করছেন। বাইরে থেকে দেখে ভেতরের গল্পটা বোঝা যায় না। করেনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী উদ্যোক্তারা। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই বড় প্রতিষ্ঠানের মতো বিনিয়োগকারী নেই। অনেকে পথে বসেছেন, অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। আমরা ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের পাশে ছিলাম বলে তারা আশা না হারিয়ে কেউ আবার নতুন করে শুরু করেছেন কেউ নতুন করে যুক্ত হয়েছেন। সেটা যে কেউ ‘উই’ এর গ্রুপ পোস্টগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন। 

তার মানে এটা বলছি না যে, বিগত এক বছরে কিছু প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় মডেল ও প্রতারণার কারণে এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অবশ্যই হয়েছে। বড় একটা ধাক্কা লেগেছে। এই ধাক্কা সামাল দিয়ে উঠতে সময় লাগবে। আস্থার সংকট এবং প্রবৃদ্ধি দুটোই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে বলছেন, সরকারি নীতি ও বিধির কারণেও তারা আশঙ্কিত। 

বাইরে থেকে দেখে ভেতরের গল্পটা বোঝা যায় না। করেনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী উদ্যোক্তারা। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই বড় প্রতিষ্ঠানের মতো বিনিয়োগকারী নেই।

প্রথমত যে ক্ষতিটা হয়েছে আমরা চাইলেও আর পেছনে ফিরে যেতে পারব না। বর্তমানে প্রায় ৩% মানুষ নিয়মিত অনলাইনে কেনাকাটা করে। অনলাইনে মোট ক্রেতার সংখ্যা এক কোটির মতো। এই সংখ্যা কিন্তু খুব নগণ্য। ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ও স্মার্টফোন ইউজারের কথা চিন্তা করলে আরও পাঁচগুন বেশি মানুষের অনলাইনে কেনাকাটা করার সুযোগ আছে এই সময়ে এবং লাস্ট মাইল ডেলিভারি (Last Mile Delivery) ও সেবা নিশ্চিত করলে তা দশগুনও হতে পারে। সে সুযোগটা আমরা নিতে পারছি না। আস্থার সংকট, ডিজিটাল পরিকাঠামোর দুর্বলতা ও লজিস্টিক দুর্বলতার কারণে। কিন্তু এই খাতের প্রবৃদ্ধি থেমে নেই। প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে তা সত্য এবং তা সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসবে। 

যে নীতিমালা তৈরি হয়েছে তার মাধ্যমে কিছু বাধ্যবাধকতা আসলেও গ্রাহকদের নিরাপত্তা দেওয়া যাচ্ছে এটা একটা বড় ব্যাপার। কারণ এটা না হলে হয়তো আরও ১০ হাজার কোটি টাকা মার্কেট থেকে অপসারিত হতো। আর সেটা আমাদের সকলের জন্যই খারাপ হতো। বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষ লোকের যে কর্মসংস্থান হয়েছে এটা একটা বিবেচ্য বিষয়।

বর্তমানে যেসব সমস্যা রয়েছে, পেমেন্ট গেটওয়েতে অর্থ ছাড় না হওয়া, ডিজিটাল লেনদেন কমে যাওয়া এবং প্রচুর অভিযোগের নিষ্পত্তি না হওয়া। এই সমস্যাগুলোকে শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করলে ভবিষ্যৎ ভালোর দিকে যাচ্ছে। কারণ সরকার ডিজিটাল কমার্স সেল গঠন করেছে এই সেল শুধু তদারকি করবে না এই খাতের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে।

ইউনিক বিজনেস আইডি (ইউবিআইডি)এর মাধ্যমে ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তারা স্বীকৃতি পাবে। কেন্দ্রীয় অভিযোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মামলা হওয়ার আগেই বিক্রেতারা তাদের অভিযোগের সমাধান করতে পারবে। লজিস্টিক প্লাটফর্মের মাধ্যমে প্রতিটি ডেলিভারি নিশ্চিত করা যাবে। এই সমাধানগুলো এসেছে সমস্যা তৈরি হওয়ার কারণে। তাই সাময়িকভাবে হোঁচট খেলেও ভবিষ্যৎ ইতিবাচক বলে আমরা মনে করি।

তবে ভবিষ্যতে সমস্যা থাকবে না এটা বলা যাবে না। ক্রস বর্ডার ই-কমার্স এবং গ্রামীণ ই-কমার্সের উন্নয়ন না হলে সমস্যা থাকবেই। এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের পেশাদার উদ্যোক্তা হিসেবে মূলধারারা উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে করে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বৃহৎ উদ্যোগের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা ঝরে না পড়েন। সুতরাং চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা সবসময় তাদের সাথে থাকব।

নাসিমা আক্তার নিশা ।। প্রেসিডেন্ট, ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)
nishabd2012@gmail.com